বিরাট কোহলি, একজন রহস্যময় চ্যাম্পিয়ন

একটা ঝড় বয়ে গেল। উপমহাদেশের বহু এলাকায় সেই ঝড় তাণ্ডব চালালো। ক্ষয়ক্ষতি হল। মানুষের কষ্টের সীমা নেই। তবে আর এক ঝড় বয়ে গিয়েছে ক্রিকেট দুনিয়ায়। সেই ঝড়ে কারও ক্ষতি হয় না। সেই ঝড় আনন্দে ভাসায় প্রতিটা ক্রিকেট পাগল দর্শককে। সেই ঝড়ে দমকা হাওয়ায় মন প্রফুল্ল হয় বিরাট সমর্থকদের।

দীপাবলির উৎসবে মাতোয়ারা গোটা ভারত। কিন্তু ভারতের এই উৎসবের রেশ কিন্তু শুরু হয়েছে খানিক আগে ভাগেই রাত। সে উৎসবের উপলক্ষ এনে দিয়েছেন বিরাট কোহলি। অথচ দু’বছর আগে এই কোহলিই দীপাবলি পালনের পরামর্শ দিয়ে দেশের মানুষের চরম সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু বছর দুই ঘুরে আবার যখন দীপাবলি আসন্ন ঠিক তখনই গোটা ভারত মেতে উঠল কোহলি বন্দনায়।

অবিশ্বাস্য এক ইনিংসের মাধ্যমে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে হারানোয় কোহলি এখন যাপন করছেন পুরো ভারতবাসীর হৃদয়ের মণিকোঠায়। আর দীপাবলি নিয়ে এবারও বিরাট কোহলি শুভেচ্ছা বার্তা দিলেন। দুই বছর আগে যে শুভেচ্ছা বার্তায় তীব্র সমালোচনার রোষানলে পড়েছিলেন, এবার তিনি সিক্ত হলেন অজুত, লক্ষ, নিযুত পেরিয়ে কোটি কোটি মানুষের ভালবাসায়। 

৮২ রানের ইনিংস। পঞ্চাশ পেরিয়ে আর ৩২ রানের সংযোজন, সেঞ্চুরিও না। তাও এই ইনিংসটি বিরাট কোহলির ক্যারিয়ার ফ্রেমে আটকে থাকবে উজ্জ্বল ভাবে। এই ইনিংসটি নিয়ে আলোচনা হবে বহুদিন। কারণটা শুধুই পরিস্থিতি। ম্যাচের যে মুহূর্ত থেকে কোহলি এই ইনিংসটি খেললেন সেটা এক কথায় অনবদ্য, অবিশ্বাস্য। তাছাড়া, ভারত-পাকিস্তান মহারণে প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচ এক ঝটকায় ছিনিয়ে দেওয়ার গল্পটা তো আর ছোট গল্পের মত শেষ হয়ে যেতে পারে না।

শেষ দৃশ্যের মঞ্চস্থ হয়ে যায়, কিন্তু মুগ্ধতার রেশ থেকে যায় অনেক দিন। মেলবোর্নের এ ম্যাচে কোহলির ইনিংসটাও ঠিক এমন। বর্ষণমুখর বিকেল পেরিয়ে লাল আভার সন্ধ্যা, দীপাবলির সারি সারি প্রদীপের উৎসবের মাঝেও একজন বিরাট কোহলির নাম বার বার উঠে আসছে। তাকে নিয়ে কি-বোর্ডে ঝড় উঠছে, পসরা বসছে শব্দসম্ভারের। তাতেও বোধহয় কাব্যের রসদে অপূর্ণতা।

বিরাট কোহলি ক্যারিয়ারে ৭১ টি সেঞ্চুরি করেছেন। বাইশ গজে নিজের ব্যাটিং মুন্সিয়ানা দিয়ে বলতে গেলে নিজেকে একদম মহামানবতূল্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু দিন শেষে তিনিও একজন সাধারণ মানুষ। মহামানব- এগুলো উপমা মাত্র। কোহলির এমন সব ইনিংসে আমরা ডুবে যাই বলেই তাকে ‘মহামানব’ বিশেষণে বিশেষায়িত করি। তাকে নিয়ে অতি আকাঙ্খার সমুদ্রে আমরা ডুব দিই। আর সেই আশার সমুদ্রে উল্টো যখন ঝড় আসে আসে তখনই আমাদের মনের আকাশে কালো মেঘের আস্তরণ পড়তে শুরু করে। 

কোহলিকে নিয়ে এমন উচ্চাশাই হয়েছিল বিশ্ব ক্রিকেটের। দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে কোহলি হঠাৎই প্রত্যাশার চাপ সামলাতে ব্যর্থ হলেন। বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়, তাঁর ব্যাটে সেঞ্চুরি আসে না। আমাদের মনের আকাশেও মেঘ জমতে শুরু করে। অভিমানের সুরে আমরাও বলে বসি, কোহলি ইজ ফিনিশড।

সেই কোহলি এশিয়া কাপে সেঞ্চুরি করলেন। সহস্র দিন পর সেঞ্চুরি। সহস্র দিন পর কোটি কোহলি ভক্তদের একটা দীর্ঘশ্বাস। কোহলিও বোধহয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিলেন। কিন্তু বড্ড গুরুত্বহীন ম্যাচের সেঞ্চুরিতে কোহলির এমন তৃপ্ত হওয়াটা তো মানায় না। হয়তো পাহাড়সহ প্রত্যাশার চাপ কিছুটা পূরণ করতে পেরেছিলেন বলেই একটু তৃপ্তি খুঁজে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেও আরও অনেক বড় কিছুর অপেক্ষায় ছিলেন। অতঃপর তিনি ৮২ রানের ইনিংসটি খেললেন। আমাদের স্নায়ুতে আলোড়ন সৃষ্টি করলেন। মুখ থেকে অস্ফুটস্বরেই বলতে বাধ্য করলেন, ‘ভিনটেজ কোহলি ইজ ব্যাক’। 

তিমিরে হারিয়ে যাওয়ার সময় আলো হিসেবে পেয়েছিলেন নিজের সহধর্মিণী আনুষ্কা শর্মাকে। বিরাট কোহলির সেঞ্চুরি শূণ্য দিনগুলোতে সমালোচনার তীক্ষ্ণ তীরের আক্রমণ যে তাকেও সইতে হয়েছে। তাই বিরাট কোহলির এমন ইনিংসের দিনে আবেগের স্রোতে ভেসে গিয়েছিলেন তিনিও। নিজের কন্যা সন্তানকে নিয়ে নেচে, চিৎকার করে উদযাপন করেছেন। একটা সময় আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। ভালবাসায় ভরানো অসীম আবেগ নিয়ে ইন্সটাগ্রামে তিনি পোস্ট করেন।

সেখানে লেখেন, ‘তুমি অনিন্দ্য সুন্দর! আজ রাতে তুমি মানুষের মন আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছ। তাও আবার দীপাবলির আগে। প্রিয়, ভালোবাসা, তুমি অসাধারণ একজন মানুষ। আমি এইমাত্র আমার জীবনের সেরা ম্যাচটা দেখলাম। আমাদের ছোট্ট মেয়েটা হয়তো বুঝতেও পারবে না, কেন তাঁর মা রুমের মধ্যে এভাবে নেচেছে আর চিৎকার করেছে।’

আনুষ্কা এর পর এটাও যোগ করে বলেন, ‘একদিন হয়তো সে বুঝবে যে এই রাতে তাঁর বাবা জীবনের সেরা ইনিংসটা খেলেছিল। সেটাও আবার কঠিন একটা সময় পার করে আসার পর। প্রাউড অফ ইউ।’

একদম সত্যিকার অর্থেই, দীর্ঘ এক কঠিন সময়ই পার করেছিলেন বিরাট কোহলি। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর টি-টোয়েন্টির ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে দিলেন। কিন্তু এরপর তাকে ওয়ানডে অধিনায়কত্ব থেকেও সরিয়ে দেওয়া হল। এর কিছু দিন বাদে, টেস্ট ক্যাপ্টেন্সিও ছেড়ে দিলেন তিনি। সব হারিয়ে বিরাট কোহলির ফর্মও তখন মধ্যসাগরে। যেকোনো সময়ই ডুবে যেতে পারেন। এই বিশ্বকাপের আগেই এমন হুংকারও দেয়া হয়েছিল, বিরাট কোহলি আর এখন অটোমেটিক চয়েস নন।

 

এমন কঠিন সব সময়কে পাশ কাটিয়ে স্বরূপে ফেরাটা বড্ড কঠিন। কিন্ত বাইশ গজে যিনি বছরের পর বছর বোলারদের আগ্রাসন থামিয়েছেন অবলীলায়, তাঁর পথযাত্রা কি এই সব প্রতিকূলতায় থেমে যাবে? বিরাট কোহলি থামলেন না। মেলবোর্নে ম্যাচের দিনে হারিস রউফের ওভারের পঞ্চম বলটাই তিনি যে ছক্কাটি মারলেন, তাতেই যেন বুঝিয়ে দিলেন, ‘দ্য কিং ইজ ব্যাক উইদ হিজ কিংডম’। 

এরপর ম্যাচ জেতার যে উদযাপনটা তিনি করলেন সে বহিঃপ্রকাশে উঠে আসলো, নিজের ইনিংসের চেয়েও ভারতের ম্যাচ জয়ে তিনি বেশি উচ্ছ্বসিত। গ্রেটদের গ্রেটনেসটা তো এই জায়গাতেই। সবার ঊর্ধ্বে দল, সেটা হোক নিজের সুসময়ে, হোক সেটা বহুদিন ধরে দারুণ কোনো ইনিংসের অপেক্ষার দিনে। কোহলি অবশ্য দুটোই পেয়েছেন।

ম্যাচজয়ের অসীম আনন্দে ভেসেছেন, একই সাথে নিজের ইনিংসকে নিয়ে গিয়েছেন চূড়ায়। এমন চূড়াতেই তো কোহলিকে মানায়। জীবনে অনেকবারই কোহলি হয়তো সেই চূড়া থেকে পদদলিত হতে পারেন। কিন্তু বারবার যেন ফিরে আসেন স্বমহিমায়, সেটিই আমাদের কাম্য। কোহলিকে নিয়ে আরও বিশেষণ লেখা হোক, শব্দের মিশেলে রচিত হোক আরও কাব্য। রাজার রাজত্বে রাজার আগমনে আপাতত স্বাগত বাণী চলতে থাকুক… 

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link