বিরাট ও ব্যাঙ্গালুরু, ভরসা ও ভালবাসার এক অটুট বন্ধন

তেমনই এক বাজি ধরেছিল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু। সেই বাজির প্রতিক্রিয়াতেই তো জন্ম নিয়েছে প্রতিজ্ঞা, ভরসা আর প্রতিদানের অমর অধ্যায়। 

একটা বন্ধন। অটুট এক সম্পর্ক। বিরাট কোহলি আর রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর এই সম্পর্ককে ঘিরে বানানো যেতে পারে এক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচিত্র। বিশ্বাস আছে, প্রেম আছে, ভালবাসা আছে, সেই সাথে আছে ব্যর্থতাও। একেবারে জমে ক্ষীর হয়ে যাওয়ার মত গল্প।

ভালবাসার অপূর্ব উদাহরণের সবচেয়ে দু:খজনক অধ্যায় বিরাট ও ব্যাঙ্গালুরুর শিরোপা জিততে না পারা। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ আজ প্রাপ্ত বয়স্ক। সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ১৮ খানা ঘূর্ণন পেরিয়েছে। বদলে গেছে কতকিছু। কিন্তু বদল ঘটেনি বিরাট ও ব্যাঙ্গালুরুর। সম্পর্কে ফাটল ধরেনি কখনোই, ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়েও ফ্রাঞ্চাইজি থেকে কোন অহেতুক চাপ সহ্য করতে হয়নি বিরাটকে।

বিরাটও অবান্তর সব আবদারে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেননি ফ্রাঞ্চাইজিটিকে। কেননা আজকের দিনের এই বিরাট হওয়ার পেছনে যে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর অবদানও কোন অংশে কম নয়। সেই ২০০৮ সালের দিকে যাত্রা শুরু করে আইপিএল। সে সময়ে ভারত অনূর্ধ্ব ১৯ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বিরাট। সবার ধারণা ছিল তিনি হবেন সময়ের সেরা তারকা।

কিন্তু সম্ভাবনার বহু প্রদীপ তো অকালেই ঝড়ে গেছে, তবুও তো কারও না কারও বাজির ঘোড়া হয়েছে প্রত্যেকেই। তেমনই এক বাজি ধরেছিল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু। সেই বাজির প্রতিক্রিয়াতেই তো জন্ম নিয়েছে প্রতিজ্ঞা, ভরসা আর প্রতিদানের অমর অধ্যায়।

দিল্লির ঘরের ছেলে বিরাট কোহলি। এমনকি রঞ্জি ট্রফিতেও প্রাদেশিক দলের হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা ততদিনে হয়ে গেছে বিরাটের। স্বাভাবিকভাবেই তরুণ প্রমিজিং ব্যাটার হিসেবে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের ডেরায় যাবেন বিরাট, তেমনটিই ছিল অনুমিত। তবে কি করে বিরাট ব্যাঙ্গালুরুর হলেন?

বেশ হুলুস্থুল এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল আইপিএল অভিষেক আসর ঘিরে। নিয়ম-কানুন তখনঅ ততটা পরিপক্কতা পায়নি। কিন্তু আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিল থেকে স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেওয়া হল। আইপিএল দলগুলো যেহেতু প্রাদেশিক রাজধানীর প্রতিনিধি, সেহেতু দলগুলোতে নিদেনপক্ষে চারজন থাকতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রদেশ থেকে। এছাড়াও অন্তত চার জন অনূর্ধ্ব-২২ বছর বয়সী খেলোয়াড়কে রাখতে হবে দলের সাথে।

আইপিএলের প্রাথমিক লক্ষ্যই তো ছিল, খেলোয়াড়দের উন্নয়ন। ব্যবসা তো তখনও হয়ে ওঠেনি মুখ্য। তবে কিছু চতুর এজেন্ট ব্যবসার সুযোগ খুঁজে নিলেন। আইপিএল ড্রাফটের সময়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড়রা ছিলেন মালয়শিয়াতে।

বিশ্বকাপের সময়ে এজেন্টরা ভারতের টিম হোটেলে প্রবেশ করে খেলোয়াড়দের নানামুখী প্রলোভন দেখাতে থাকেন। তাতে করে খেলোয়াড়দের মানসিকতায় বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে- এমন ভাবনা থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড়দের জন্যে বিশেষ এক খেলোয়াড় ড্রাফট অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে প্রতিটা দল দু’জন করে খেলোয়াড়কে দলে নিতে পেরেছিল।

সেই ড্রাফটে নাম ছিল বিরাট কোহলিরও। তিনিই তো ছিলেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক। সেই ড্রাফটে ভাগ্যচক্রে ব্যাঙ্গালুরুর আগে খেলোয়াড় ডাকার সুযোগ পায় দিল্লি। ড্রাফটে উপস্থিত সবাই ধরেই নিয়েছিল- এই বুঝি বিরাট গেল। কিন্তু না অবাক করে দিয়ে দিল্লি ডেয়ারডেভিলস দলে নিল প্রদীপ সাঙ্গওয়ানকে। তিনিও ছিলেন সম্ভাবনাময় বা-হাতি পেসার।

তখনকার পরিস্থিতি বিচারে দিল্লীর এমন সিদ্ধান্ত মোটেও ভুল ছিল না। কেননা তাদের দলে সেই মুহূর্তে তুখোড় সব ব্যাটারদের উপস্থিতি ছিল শুরু থেকেই। বীরেন্দ্র শেবাগ, গৌতম গম্ভীর, এবি ডি ভিলিয়ার্স, তিলাকারত্নে দিলশান, দীনেশ কার্তিকের মত ব্যাটারদের ভীরে বিরাটের মত তরুণকে সুযোগ দেওয়াও তো যেত না।

দিল্লির পরপরই খেলোয়াড় ডাকার সুযোগ পায় ব্যাঙ্গালুরু। চোখের পলক পড়ার আগে তারা প্রায় বুলেট ট্রেনের গতিতে বিরাট কোহলির নাম উচ্চারণ করে। তখনও কিন্তু বিরাট এতটা দিগগজ হয়ে ওঠেনি। স্রেফ এক সম্ভাবনাময় তরুণ। প্রথম তিন মৌসুমে তিনি সেই অর্থে পারফরমও করতে পারলেন না।

মাত্র ২১.৭৫ গড়ে রান করেছেন তিনি সেই সময়টায়। পাঁচ-ছয় নম্বরে ব্যাট করতে নেমে তিনি মোটে দুইটি হাফ সেঞ্চুরি করতে সক্ষম হন। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ছেড়ে দেবে বিরাটকে- ২০১১ মেগা নিলামের আগে তেমন গুঞ্জনই ছিল প্রবল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিরাটকে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে রেখে দেয় ব্যাঙ্গালুরু।

এক অজানা তরুণের উপর সেদিন বাজি ধরেছিল ব্যাঙ্গালুরু। এরপর থেকে বদলে গেছে সমস্তকিছু। স্রেফ শিরোপা না জিততে পারার আক্ষেপ- এই গল্পের বেদনাদায়ক এক সমাপ্তি। কিন্তু আরেকটা অধ্যায় তো যুক্ত করার সময় আছে পর্যাপ্ত। বিরাটের জন্যে কি ব্যাঙ্গালুরুর বাকি খেলোয়াড়রা লড়বেন, যেমনটি লড়েছিল ২০২২ সালে মেসির জন্যে গোটা আর্জেন্টিনা?

Share via
Copy link