কোমল কোমল হৃদয় তবু শিখার চেয়ে গাঢ়;
আমায় তুমি বাধ্য করো,চড়বে ব্যাটের পারদ।
সমগ্র জগৎটাই সৃষ্টিকর্তার অপার মহীমা। লক্ষ লক্ষ প্রজাতির উদ্ভিদকূল প্রত্যক্ষীভূত হয়। অদূরে সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে বেড়ে ওঠে এক বটবৃক্ষ। নিবিড়,শীতল ছায়া প্রদানকারী। কত শত পথিক তাঁর ছায়াতলে এসে বিশ্রাম করেছে। তাঁর সুনাম করে গেছে। অথচ জীবন দ্ব্যর্থক! মুদ্রার লুকিয়ে থাকা অপর পিঠ দেখতে সে দিদৃক্ষু। অবলীলায় বটবৃক্ষের ওপর চলতে থাকে একের পর এক ঠোকর। আঘাত করতে উদ্যত। সৌজন্যে কাঠঠোকরা।
এদিকে চোখের ভিতর জীমূতমন্দ্র। স্বাভাবিক। কারণ – বাবা গত এক মাস ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী। পারিবারিক ব্যবসার বেহাল অবস্থা,বসবাসের জন্য রয়েছে কেবল ভাড়া করা বাড়ি। সব মিলিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি গ্রাস করেছে জীবনে। রঞ্জি ম্যাচ চলাকালীন খবর এলো বাবা ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকের উদ্দেশ্যে গমন করেছেন। ১৮ বছরের তরুণের ঘাড়ে সমস্ত দায়িত্বভার চেপে গেল। সামলাতে বড্ড কষ্ট হলেও নুইয়ে পড়েননি তিনি,ভরসার চওড়া কাঁধ তাঁকে উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছিল নিয়তি।
ভারতীয় ক্রিকেট সভ্যতার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ‘শচীন’ শব্দটি বোনা। ফুলেরও এক সময় সুবাস কমে আসে। ব্যতিক্রম হয়নি সচিনের ক্ষেত্রেও। ফিরতে হয়েছে তাঁকেও। অপলক দৃষ্টিতে একশত কোটি ভারতবাসী প্রত্যক্ষদর্শী রইল নদীর এক কূল ভাঙনের। কিন্তু নিয়তি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে না।
অপর কূল গঠনের কাজ জারি রেখেছেন। কোথাও একটা শঙ্খধ্বনি শোনা গেল। যুদ্ধের আহ্বান! মালিঙ্গার হাত থেকে সাদা রঙের ক্রিকেট বোমা বেরিয়ে আসতেই তা ‘নাইকি’ ব্যাটের সজোড় আঘাতে ফিরে গেলো হোবার্টের গ্যালারিতে। হ্যাঁ, পন্টিং, ক্লার্ক, হেইডেনদের দেশের মাটি। তেইশ বছর বয়সী ছোকরার চোখে-মুখে তখন স্পর্ধার ছাপ স্পষ্ট হতে থাকল।
সাদা-কালো টিভির পর্দায় স্কোর কার্ড ০/১; এমন অবস্থায় উমর গুল, সাঈদ আজমল, আইজাজ চিমার সামনে ফেলে দেওয়া হলো তাঁকে। শচীন টেন্ডুলকারও প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন। বিস্ময় কাঁধের অধিকারী ছেলের ব্যাট থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো স্ট্রোকের ফুলঝুড়ি। বেরিয়ে এলো মনোমুগ্ধকর কভার ড্রাইভ,পুল শট। পরবর্তী প্রজন্মের টিম ইন্ডিয়ার ট্রাম্প কার্ড। সবুজ বর্ণে মোড়া ওই রণাঙ্গণ পেয়ে গেল তাঁর নতুন অর্জুনকে।
গ্রীষ্মের সকাল। অ্যাডিলেডে গরমাগরম পরিবেশ। উদ্ধত্যপূর্ণ ক্যাঙারুদের হয়ে বল হাতে দৌড়াচ্ছেন জনসন। বোলারের দিক বরাবর ডিফেন্সিভ শট খেললেন চিকু। বল তুলে সোজা চিকুর পিঠে তাক করলেন জনসন। যতটা জোরে আঘাত পেলেন তিনি,তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আঘাত ফিরিয়ে দিলেন ক্যাঙারুদের। অমত্র্য টাইমিং এর দরুণ ‘এমআরএফ’ ব্যাট থেকে বিভিন্ন স্টাইলিশ শটের বাহার বেরিয়ে আসতে লাগল। চিকুর ব্যাটের মারফত ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগলো শচীন,লক্ষ্মণদের অতীতকালে ওয়ার্ন, লি, ম্যাকগ্রাকে শাসন করার স্মৃতি।
পদে পদে তাঁর ব্যাট শাসন করে গেছে ফকনারের মধ্যম গতির পেস,স্টেইনের বিষাক্ত পেস,জনসনের মারণঘাতী বাউন্সার, মালিঙ্গার ইয়র্কার। তাঁর দিকে নিক্ষেপিত বর্শার ন্যায় মর্মভেদী স্লেজিং আর সমালোচনাগুলোকে সযত্নে সাজিয়ে রেখেছেন এবং সেগুলো দিয়ে স্থাপত্য-ভাস্কর্যের শিল্পীর ন্যায় সৃষ্টি করে চলেছেন রেকর্ডের ইমারত।
কখনও একদিনের ক্রিকেটে দ্রুততম দশ হাজার রানের রেকর্ড আবার কখনও সবচেয়ে কম বলের মোকাবিলা করে ভারতীয় হিসেবে একদিবসীয় ক্রিকেটে শতরানের রেকর্ড। কখনও এক আইপিএল সিজনে চার-চারটে শতরানের রেকর্ড। এক উপন্যাস লেখা হয়ে যাবে তাঁকে নিয়ে। কঠিন পরিশ্রমের সমার্থক শব্দ তিনি।
শচীন পরবর্তীযুগে দিল্লীর সেই ছেলেকেই বর্তমানে দেখা যায় বটবৃক্ষ রূপে দাঁড়িয়ে থাকতে। কখনও তাঁকে দেখা যায় বোলারদের কাছে ঠোকর খেতে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াতে ট্রোলারদের হাতে ঠোকর খেতে। অথচ নিজ জায়গাতে স্থির থেকে তিনি তরুণ ক্রিকেটারদের ছায়া প্রদান করে গেছেন সর্বক্ষণ। বরং তারা উপকৃত হয়েছেন বলা বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
সাথে যুক্ত থেকেছেন বেশ কিছু চ্যারিটির কাজেও। সান্ধ্যকালের ঝড় অর্থাৎ শচীনের অবসরের পর যিনি ঝলমলে,রঙিন ছাপগুলো বিন্দু বিন্দু করে সঁচিত করে রচিত করেছেন একচ্ছত্র শাসন। হয়ে উঠেছেন ধনী,গরিব, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে ১৩৫ কোটি ভারতবাসীর ভরসার কাঁধ। জারি রেখেছেন সৌরভের স্পর্ধা, শচীনের ক্লাস, শেবাগের আগ্রাসন।
দুই এপ্রিলের সেই রাতে ক্রিকেটের অবিসংবাদিত মহাতারকাকে কাঁধে তুলে নিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনিই শচীনের যোগ্য উত্তরসূরি। শচীন হয়তো সেদিনই কানে কানে কোহলিকে বলে গিয়েছিলেন, ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা।’