রেনেসাঁ নায়কের দিন বদলের গান

স্টিভ জবস একবার বলেছিলেন, ‘আপনি সামনের দিকে তাকিয়ে কখনোই তিনটি ডটকে সংযুক্ত করতে পারবেন না, আপনাকে এজন্য অবশ্যই পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।’ তিন বছরের অপেক্ষা ফুরিয়ে বিরাট কোহলির পুরনো রূপে ফিরে আসা যেন জবসের সেই কথারই পুনরাবৃত্তি ঘটায়। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যেন বিরাট কোহলির ক্যারিয়ারের পুর্নজাগরণই ঘটল। 

অস্ট্রেলিয়াতে ব্যাটিং করাটা কোহলি সব সময়ই উপভোগ করেন। কিন্তু এবার যেন ছাপিয়ে যাচ্ছেন পূর্বের সব রেকর্ডকে, পাকিস্তানের বিপক্ষে অতিমানবীয় এক ইনিংস খেলে ভারতকে এনে দিয়েছেন অবিশ্বাস্য এক জয়। রানের ধারাটা অব্যাহত রেখেছেন পরের ম্যাচেও, তুলনামূলক দুর্বল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও তুলে নিয়েছেন ফিফটি। অধিনায়কত্ব ছাড়ার পর প্রথমবারের মত পূর্বের বিধ্বংসী রূপ দেখা যাচ্ছে কোহলির। কেবল রান করা নয়, রান করার ধরণেও পাওয়া যাচ্ছে ভিনটেজ কোহলির ছাপ। 

এমনকি অস্ট্রেলীয় গ্রেট এবং সাবেক ভারতীয় কোভ গ্রেগ চ্যাপেল, যিনি কিনা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের খুব বড় ভক্ত নন, তিনিও মেতেছেন কোহলি বন্দনায়। পাকিস্তানের বিপক্ষে তাঁর ইনিংসকে আখ্যায়িত করেছেন ‘ঈশ্বরের সংগীত’ নামে। তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে এই ধরনের ইনিংসই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে যৌক্তিক করে তোলে। এটা এক ধরনের শিল্প, গত পনেরো বছরে এরকম কাউকে আমি দেখিনি।’

অথচ গত বছর দুয়েক ধরে কোহলি ঠিক কোহলি সুলভ রানের মাঝে ছিলেন না। মাঝে মাঝে বড় ইনিংসের দেখা পেতেন কিন্তু সেটা ঠিক কোহলি সুলভ ব্যাটিং এ না। তাঁর ফর্মে ফিরে আসার কারণ খুঁজলে তিন মাস পেছনে ফিরতে হবে। পাওয়ার হিটিং এর এই যুগে কোহলি ভরসা রেখেছেন তাঁর ব্যাটিং টেকনিক এবং নিখাদ টাইমিং এর উপর। এশিয়া কাপের পূর্বে বিশ্রাম এবং আফগানিস্তানের বিপক্ষে আপাতদৃষ্টিতে  গুরুত্বহীন এক ম্যাচে সেঞ্চুরি করে জানান দিয়েছিলেন তিনি ফিরছেন।  নতুন কিছু করার বদলে কোহলি ফিরেছিলেন বেসিক ক্রিকেটেই। 

অস্ট্রেলিয়াতে পৌঁছানোর আগেই কোহলি কাজ করেছেন নিজের ব্যাটিং নিয়ে। এই ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা এবং কোচ রাহুল দ্রাবিড়ও। গত বিশ্বকাপের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারত এখন আরও বেশি আক্রমণাত্নক ক্রিকেট খেলে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে সামনে রেখে তাই তাঁরা পরিবর্তন এনেছে ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ এবং অর্ডারে। 

রোহিত বলেন, ‘দল হিসেবে উন্নতি করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমাদের মনে হয়েছে আমাদের আরও বেশি আক্রমণাত্নক হওয়া উচিত। একই সাথে আমাদের মনে রাখতে হবে, নতুন কিছু করতে গেলে শুরুতে  ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু তাই বলে পিছিয়ে আসা যাবে না।’

সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর ম্যাচ শেষে ভারতের এই দুই সিনিয়র ক্রিকেটার এক সাক্ষাৎকারে একসাথে বসেছিলেন। সেখানেই কোহলি বলেন, ‘আমি দল থেকে নিশ্চয়তা পেয়েছি নিজের মত করে ব্যাট করার। এটা খুবই জরুরি। এমন বার্তা পেলে মন খুলে ব্যাট করা যায়। বিশ্বকাপ অনেক বড় একটা আসর এবং যদি আমি ভাল খেলে দলের জন্য অবদান রাখতে পারি, তাহলে রাহুল ভাইয়ের বড় অবদান থাকবে মাঝের ওভারে আমার স্ট্রাইক রেটে উন্নতি আনার জন্য।’

আফগানিস্তানের বিপক্ষে সে ম্যাচে শেষ ৭২ রান করতে কোহলি খেলেছিলেন মোটে ২৯ বল। সেই পুরনো ধাঁচেই যেন শুরুতে সেট হয়ে পরে অলআউট অ্যাটাকে গিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রপার ক্রিকেটীয় শট খেলতে পছন্দ করি। বড় ছক্কা হাঁকানো আমার শক্তির জায়গা নয়। আমি ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী ছয় মারতে জানি, তবে গ্যাপ খুঁজে রান এবং বাউন্ডারি বের করতেই আমি বেশি পারদর্শী।’

কোহলির এই মনোভাব যেন ছড়িয়ে গিয়েছে পুরো ভারত দলের মধ্যেই। পাওয়ার প্লেতে তাড়াহুড়ো করে উইকেট না হারিয়ে বরং মাঠের আয়তন কাজে লাগিয়ে রান বের করাতেই বেশি মনোযোগী দেখা গিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটারদের। প্রয়োজন অনুসারে আক্রমণাত্মক হচ্ছেন ব্যাটাররা, কিন্তু অতি আগ্রাসী হচ্ছেন না কেউই। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে রোহিত শর্মা সেটা করেছেন, প্রথমে সেট হয়েছেন, এরপর তুলে নিয়েছেন অর্ধশতক।

বিরাট কোহলিও হেঁটেছেন পুরনো পথে, প্রথম ২৫ বলে যেখানে করেছেন ২৪ রান সেখানে পরের ৩৭ রান করতে খেলেছেন মাত্র ২০ বল। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচেও শুরুতে বলের চাইতে রানসংখ্যা কম ছিল কোহলির, কিন্তু শেষ ২৫ বলে ৫৭ রান তুলে পুরো ম্যাচের চিত্রনাট্যই বদলে দিয়েছেন। বিশ্বকাপের আগে হায়দ্রাবাদে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৬৩ কিংবা গুয়াহাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অপরাজিত ৪৯ রানের ইনিংস খেলার পথেও একই অ্যাপ্রোচ অনুসরণ করেছেন কোহলি। প্রথমে উইকেটে সময় কাটাও, বলের গতির সাথে চোখটাকে সইয়ে নাও, তারপর নিজের শক্তিমত্তা কাজে লাগিয়ে ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠো। 

পেসার ভুবনেশ্বর কুমারও স্বীকার করে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার পেস সহায়ক কন্ডিশনে শুরুতে রান তোলা কঠিন। তিনি জানান, ‘আমরা বোলিং ইউনিট প্রায়ই প্রথম ১০ ওভারের তুলনায় শেষ ১০ ওভারে হিসেবের চাইতে ১৫-২০ রান বেশি হজম করি। প্রায় সব দলেই এটা ঘটছে। শুরুর দিকে একটু রয়ে সয়ে খেলে পরের দিকে আক্রমণে যাচ্ছে ব্যাটসম্যানরা।’

তাছাড়া ভারতের টপ অর্ডারের দুশ্চিন্তাবিহীন ব্যাটিংয়ের পেছনের কারণ হল চার নম্বরে সুরিয়াকুমার যাদবের ফর্ম। ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী মূহুর্তের মাঝেই ব্যাট চালিয়ে খেলতে পারছেন তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘ব্যাট করতে নামার আগে প্রত্যেকেরই আলাদা পরিকল্পনা থাকে। প্রত্যেকের নিজস্ব গেম প্ল্যান খুবই জরুরি। তো টপ অর্ডারের ব্যাটাররাও সেটাই করছে, নিজেদের প্ল্যানমত উইকেটে সময় কাটিয়ে আক্রমণাত্নক হচ্ছে। আমি তাঁদের ব্যাটিং খুবই উপভোগ করছি।’

কেবল সুরিয়াকুমার একাই নন, পুরো বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীরাই এবার বুঁদ হয়ে আছে ভারতীয় ব্যাটারদের ব্যাটিং দেখতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link