ক্রিকেটে আম্পায়ার’স কল কী ও কেন?

অনেকেই দেখেছি ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম এ আম্পায়ারের কল জিনিসটা কী বা কেন আছে সেটা নিয়ে সন্দিগ্ধ থাকেন; তাই পুরো ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি। প্রথমেই আমাদের জানতে হবে আম্পায়ারের কল কী?

অনেকেই দেখেছি ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম এ আম্পায়ারের কল জিনিসটা কী বা কেন আছে সেটা নিয়ে সন্দিগ্ধ থাকেন; তাই পুরো ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি। প্রথমেই আমাদের জানতে হবে আম্পায়ারের কল কী?

ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম বা ডিআরএস প্রথম ২০০৮ সালে ক্রিকেটে চালু হয়। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন রকম পরিবর্তন হয়েছে, শুরুর দিকে পদ্ধতিটি অনেকটাই বিতর্কিত ছিল, তাই শুরুর দিকের পরিবর্তন ও বিতর্কিত ঘটনার মধ্যে এখন ঢুকছি না। বর্তমানে পদ্ধতিটি অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনগৃহীত।

একজন খেলোয়াড় বা দল এলবিডব্লিউ বা ক্যাচ আউটের জন্য রিভিউ নিতে পারে। অন ​​ফিল্ড আম্পায়ার তারপর রিভিউটি টিভি আম্পায়ারের কাছে (তৃতীয় আম্পায়ার ও বলা যায়) পাঠানোর জন্যে একটি টিভি আকৃতির বক্সের ইশারা করেন। এলবিডব্লিউ সিদ্ধান্তের জন্য আম্পায়ারের কল প্রযোজ্য, যদিও লো ক্যাচের ক্ষেত্রেও অন ফিল্ড আম্পায়ারের কল প্রযোজ্য, তবে সেটি সফ্ট সিগন্যাল বলা হয়, প্রথমে আমি এলবিডাব্লিউ এর ক্ষেত্রে আসছি ।

ব্যাটার লেগ-বিফোর-উইকেটে আউট হয়েছে কিনা তা নির্ধারণ করতে, বল ট্র্যাকিংয়ে তিনটি জোন গুরুত্বপূর্ণ। তিনটি লাল মানে আউট।

পিচিং জোন – ডেলিভারি বৈধ বলে নিশ্চিত হয়ে (অর্থাৎ নো বল নয়) গেলে এটি বল ট্র্যাকিংয়ের প্রাথমিক অংশ। পিচিং হল, যেমন শব্দটি নির্দেশ করে, যেখানে বল পিচে পড়ছে। যদি এটি অফ স্টাম্পের বাইরে বা অফ এবং লেগ স্টাম্পের মধ্যে লাইনে পিচ পড়ে তবে এটি লাল হিসাবে বিবেচিত হয়। যদি বলটি লেগ স্টাম্পের বাইরে পিচ পড়ে, তবে এটি নট আউট বলতে পারেন।

ইমপ্যাক্ট জোন – বল ট্র্যাকিংয়ের পরবর্তী অংশটি যেখানে বলটি প্যাডের সাথে প্রথম স্পর্শ করে। যদি বলটি স্টাম্পের লাইনে আঘাত করে তবে এটি লাল। যদি এটি অফ স্টাম্পের বাইরে বা লেগ স্টাম্পের বাইরে আঘাত করে তবে এটিকে নট আউট হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

উইকেট জোন – বল ট্র্যাকিংয়ের শেষ অংশ যেখানে বল স্টাম্পে আঘাত করবে বলে অনুমান করা হয়। উইকেট জোন স্টাম্পের গোড়া থেকে অফ স্টাম্পের বাইরের প্রান্ত এবং লেগ স্টাম্পের বেলের শীর্ষ পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত।

এখন, আম্পায়ারের কল পিচিং জোনের জন্য প্রযোজ্য নয় কারণ বল ট্র্যাকিং প্রযুক্তি অত্যন্ত নির্ভুলতার সাথে বল কোথায় পিচ করেছে তা সনাক্ত করতে পারে। এটি হয় লাল বা সবুজ।

ইমপ্যাক্ট জোনের জন্য, যদি প্রযুক্তিটি চূড়ান্তভাবে বলতে না পারে যে বলটি যখন প্যাডের সাথে প্রথম স্পর্থ করছে তখন বলটি স্টাম্পের লাইনে আছে কি না, তাহলে মাঠের আম্পায়ারের কল চালু থাকে।

উইকেট জোন – এখানে ডিআরএস সবচেয়ে জটিল হয়ে ওঠে। বল ট্র্যাকিং প্রযুক্তি বল প্যাডে স্পর্শ করার পরে বল স্টাম্পে আঘাত করার পথের একটা আনুমানিক পথের প্রতিচ্ছবি দেয়। আমরা পর্দায় যা দেখি তা হল একাধিক আনুমানিক পথের মধ্যে একটি। অনেকে ভাবেন এটা একটিই প্রেডিক্টিভ পাথের চিত্র, কিন্তু সেটা ঠিক না।

একটু বুঝিয়ে বলি, ধরা যাক মিশেল স্টার্ক বা ডেল স্টেন বল করছেন, এবং তাঁদের বল সুইং বা রিভার্স সুইং হতে পারে। এবারে, এলবি যেহেতু, ধরে নিচ্ছি বলটি ইনসুইং বা অফ কাটার ছিল। আপনারা প্রত্যেকেই জানেন, বল পিচে পড়ার পড়ে কতটা কাট করবে, বা বাতাসে কতটা সুইং করবে, ঠিক কত মিলিমিটার ডেভিয়েশন হবে, সেটা বোলার নিজেও নিশ্চিত থাকতে পারেন না। একটি বল যদি ব্যাটসম্যান খেলেন, আর না খেলে ছেড়ে দেন, সেটা বাতাসে কতটা বাঁক নিয়ে কিপারের কাছে বা স্ট্যাম্প এর দূরত্বে পৌঁছাবে, সেটা প্রতিটি বলের ক্ষেত্রে আলাদা হবে। মুরলীধরণ বা শেন ওয়ার্ন যখন স্পিন করেন, প্রতিটি বল একই পরিমানে ঘোরে না।

প্যাড পর্যন্ত পথ টা অনুসরণ করলেও, তারপরে যেটুকু দূরত্ব বাকি থাকে, সেই পথটা প্রেডিক্ট করা হয় ওই বোলারের (বা একই ধরণের বোলারদের) আগে করা একই ধরণের বহু ডেলিভারির গতিপথের একটা আনুমানিক গড় ডেভিয়েশন বা স্পিন ইত্যাদি হিসেবে করে। ধরা যাক একজন অফ স্পিনারের দুসরায় এলবির আপিল হলো। অফ স্পিনারের আগে করা অসংখ্য দুসরার গতিপথ ডিআরএস সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করা থাকে।

এই সিস্টেম তাঁর নিজস্ব এলগোরিদম দিয়ে যে গতিপথটিকে বর্তমান বলের গতিপথের সবচেয়ে কাছাকাছি মনে করে, সেটাকেই টিভির পর্দায় দেখানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গতিপথ সঠিক অনুমান করলেও, পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে, হতেই পারে যে বর্তমান বলটি আসলে ডিআরএসের দেখানো গতিপথের থেকে একটু কম বা বেশি ঘুরতো, কেননা বলটা তো একজন মানুষ করছেন, কোনো বোলিং মেশিন নন, যে প্রতিটি বল একই গতিতে ও একই জায়গায় পড়ে একই রকম ভাবে যাবে।

এই কারণে, আম্পায়ারের কলের নিয়ম অর্থপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়।

যদি বলটির ৫০% এর বেশি অংশ স্ট্যাম্প এ বা বেল এ আঘাত করছে বলে দেখা যায়, তাহলে আম্পায়ার নট আউট দিলেও সেটিকে আউট দেওয়া হয়। আবার যদি বলটির ৫০% এর কম অংশ স্ট্যাম্প বা বেলে আঘাত করে, সেক্ষেত্রে নট আউট সিদ্ধান্ত বহাল থাকে, কিন্তু আম্পায়ার যদি আউট দেন, সেক্ষেত্রে বল স্টাম্পে ১% টাচ হলেও আউট, কেননা সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হচ্ছে আম্পায়ারের দৃষ্টি ডিআরএসের ভুলটাকে সংশোধন করছে, প্রকৃতপক্ষে হয়তো বলটি আরো বেশি পরিমানে স্টাম্পে লাগতো। একমাত্র যদি ডি আর এস দেখায় যে বল পুরোপুরি ভাবে স্ট্যাম্প মিস করছে, তবেই আউট এর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নট আউট দেওয়া হয়।

একইভাবে আম্পায়ার নট আউট দিলে, বলের অন্তত ৫০% অংশ উইকেটে না লাগলে ধরে নেওয়া হয় সেটা ডিআরএস এর মার্জিন অফ এরর এর কারণে ভুল দেখাচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে বলটি স্টাম্পে লাগতো না, অতএব আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

কিন্তু, বেশিরভাগ ক্রিকেট ভক্ত আম্পায়ারের কলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন নন বা চান না সহজ জিনিসকে জটিল করে তুলতে। ক্ষোভ বা বিতর্ক তখনই ঘটে যখন আম্পায়ারের কল ভক্তদের পছন্দের দল/খেলোয়াড়ের বিপক্ষে যায় বা যখন বলের আনুমানিক গতিপথ আমাদের চোখ যা দেখে তার সাথে মেলে না।

আপাতত খুব ওপর ওপর বোঝানোর চেষ্টা করলাম, যদি পাঠকরা আগ্রহী থাকেন, তাহলে আরো ডিটেলস এ কিছু আলোচনা করা যাবে, কিভাবে এই মার্জিন অফ এরর হিসেবে করা হয়, এবং ক্রিকেটের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো ডি আর এস কন্ট্রোভার্সি, আজমলের বলে সচিনের ২০১১ সেমিফাইনালে বেঁচে যাওয়া নিয়ে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...