১০ দিনেও ‘শেষ না হওয়া’ টেস্ট!

‘আমি খুশি যে ম্যাচটা কোন ফলাফল দেখেনি। এটা প্রমাণ করে যে সেখানে জয়/হারের চাইতেও বড় কিছু ছিল। এটাই আমাদের ক্রিকেট।’

ক্রিকেট লেখক লুইস দাফুসকে ম্যাচ শেষে সেদিন কথাগুলো বলেছিলেন সে ম্যাচে ইংল্যান্ড দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা এজে হোমস।

  • পটভূমি

টেস্ট ম্যাচে তো পঞ্চম দিনকেই সবচেয়ে কঠিন বলে ধরা হয়। পিচের ময়েশ্চার, উইকেট ভেঙে যাওয়া সবকিছু বিবেচনায় পঞ্চম দিনে ব্যাট করা অনেক কঠিন। আর সেখানে ১৯৩৯ সালে কাভার না দেওয়া উইকেটে একটা টেস্ট ম্যাচ ১০ দিন হয়ে গেল! টি-টোয়েন্টির এই যুগে হয়তো আপনাকে চমকে দিতে এই একটা তথ্যই যথেষ্ট।

ডারবানের গল্প এটা। সিরিজের তৃতীয় টেস্ট জিতে ইংল্যান্ড ১-০ তে এগিয়েই ছিল। ডারবানে সিরিজের চতুর্থ টেস্টেও ফল দেখতেই মাঠে নেমেছিল ইংলিশরা। কিন্তু কে জানত, ফল দেখতে চাওয়া টেস্ট ম্যাচ শেষ অব্দি ইতিহাস হয়ে যাবে! যা হোক, দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক অ্যালান মেলভিল টসে জিতে নিয়েছিল ব্যাটিং!

  • প্রথম দিন

দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ওপেন করতে নেমেছিলেন অ্যালান মেলভিল আর ভ্যান ডার বিলজ। উইকেট ফ্লাট ছিল, আকাশও পরিষ্কার ছিল, ম্যাচে সময়ের কোন ব্যাপার ছিল না, ক্রিজে দুজন তাই ছিলেন বেশ সাবলীল। ইংলিশ বোলাররা এদের কাউকেই টলাতে পারছিলেন না।

ভ্যান ডার বিলজ ছিলেন বেশ আক্রমণাত্মক, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি বেশ রয়েসয়েই খেলছিলেন। কিন্তু ইংলিশ বোলাররা লাঞ্চের আগে একমাত্র যে সুযোগটা পায় সেটাও কিন্তু কাজে লাগাতে পারেনি। লাঞ্চের ঠিক আগে অ্যালান মেলভিল প্রায় রানআউট হয়েই গিয়েছিলেন কিন্তু ইংল্যান্ড দলের ফিল্ডার পেইন্টার সে থ্রোকে স্ট্যাম্পেই লাগাতে পারেনি। লাঞ্চে যাওয়ার সময় দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর তাই কোন উইকেট না হারিয়েই ৪৯!

মেলভিল তাঁর প্রথম বাউন্ডারিটা মারেন লাঞ্চের ঠিক পরে যেটা কিনা আবার ছিল নো বল। প্রথম সেশনের পুরোটা খেলে মাত্র ৪৯ রান করা দক্ষিণ আফ্রিকান এই জুটি দ্বিতীয় সেশনেই রানের ফোয়ারা ছোটাতে লাগলেন। কিন্তু এই হাত খুলে খেলাই যেন কাল হল দক্ষিণ আফ্রিকার জন্যে। ইংলিশ বোলার রাইটের বলটা ছিল শর্ট লেংথে, মেলভিলও চেয়েছিলেন পুল করে বাউন্ডারি মারতে। কিন্তু বিধি বাম! বল মেলভিলের ব্যাট না, খুঁজে নিল স্ট্যাম্পটাই!

৫ বাউন্ডারিতে সাজানো মেলভিলের ৭৮ রানের ইনিংসের স্থায়িত্ব হল মাত্র ২০০ মিনিট!

দলীয় ১৩১ রানের মাথায় প্রথম উইকেট হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা আবার খোলসবন্দী হয়ে গেল। কিন্তু তারপরও সুযোগ এসেছিল ইংল্যান্ডের সামনে। মেলভিলকে আউট করা রাইটই যদি পরে বিলজের ৭১ রানের মাথায় নিজের বলে নিজের ক্যাচটা ছেড়ে না দিতেন, দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোরবোর্ড নিশ্চিতভাবেই আরেকটা উইকেট দেখত।

যা হোক, উইকেটে বিলজ আর নতুন যোগ দেওয়া এরিক রোয়ান সেট হয়ে গেলে আবারও বাউন্ডারি হাকাতে শুরু করেন ভ্যান ডার বিলজ। ম্যাচের পুরো নিয়ন্ত্রণ আসলে তিনি নিজের কাঁধে নিয়ে নেন। বিলজকে জীবন দেওয়া রাইটকেই তিনি মারেন ৫ টা চার, ওভারে নেন ২২ রান! এরপর রাইটকে মারা ছয়টা যে প্যাভিলিয়নের ছাদে গিয়ে পৌছাল, এটাও সম্ভবত উল্লেখ করার মতই।

কিন্তু পার্কসের ইয়োর্কারে রোয়ান আউট হয়ে গেলে আবারও খোলসবন্দী হয়ে যান ভ্যান ডার বিলজ। তবে দিনের খেলা শেষ হবার আগেই নিজের কাঙ্খিত সেঞ্চুরি পেয়ে যান তিনি।

দক্ষিণ আফ্রিকার দলীয় সংগ্রহ প্রথম দিনশেষে ছিল ২২৯/২ !

  • দ্বিতীয় দিন

দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই বিপর্যয় দেখে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস। উইকেটে ভ্যান ডার বিলজের সাথে থাকা ব্রুস মিচেলকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে আউট করেন রাইট। এরপর উইকেটে যোগ দেন সবসময়ই আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলা ডাডলি নার্স। কিন্তু পরিস্থিতির প্রয়োজনে তিনিও বিলজের সাথে ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করে ফেলেন। সেই ধীরে চলা এমনই যে প্রথম এক ঘন্টায় দক্ষিণ আফ্রিকা নেয় মাত্র ১৭ রান, আগের দিনের সেঞ্চুরিয়ন বিলজের এদিন প্রথম রান করতে লেগেছিল ৩২ মিনিট!

তবে এতে করে ইংলিশ বোলাররা আরো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। পেসার কেন ফার্নেস তো একের পর এক বিলজের শরীর বরাবর বল ছুঁড়তে থাকেন। তবে তাতেও বিলজকে এক বিন্দু টলাতে পারছিলেন না তিনি। শেষমেশ লাঞ্চ ব্রেকে দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর দাঁড়ায় ২৭১/৩!

দুপুরের খাবারে বিলজ কি খেয়েছিলেন কে জানে, তবে লাঞ্চ ব্রেকের পরই বিলজের মহাকাব্য থেমে যায়। পার্কসের এক অফ কাটারে ১২৫ রানের মাথায় ৪২৮ মিনিট ক্রিজে থাকার পরে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান তিনি। এরপর ব্যাট করতে আসা কেন ভিলজোন উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিলে দক্ষিন আফ্রিকার স্কোর দ্রুতই ২৭৮/৫ হয়ে যায়।

এরপর এরিক ডাল্টন আর নার্স মিলে বহাল তবিয়তেই দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এবারও সেই আগের নিয়মেই- ধীরে চলো! তবে একটা সময়ে গিয়ে মনে হয় ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে যায় ডাল্টনের, রাইটকে দিনের প্রথম ছয়টা মেরে বসেন তিনি। ঠিক এরপর থেকেই রানের গতি একটু করে বাড়াতে থাকেন তিনি, সেটা এমনই যে নিজেদের ৯০ রানের পার্টনারশিপে ৫৭ রানই ছিল ডাল্টনের অবদান। কিন্তু লেগ সাইডে ফার্নেসের বলে লেস এমিস দুর্দান্ত এক ক্যাচ নিলে ডাল্টনকেও প্যাভিলিয়নে ফিরে যেতে হয়।

এরপর আর সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকার আর কোন উইকেট পড়েনি। রনি গ্রিভসনকে সাথে বাকি দিনটা বেশ আরামেই কাটিয়ে দেন নার্স। দক্ষিণ আফ্রিকাও দিন শেষ করে ৬ উইকেট হারিয়ে ৪২৩ রান করে। উইকেটে নার্স ৭৭ আর গ্রিভসন ২৬ রানে ছিলেন অপরাজিত। নার্সের ভাষায় যেটা ছিল, ‘এটা টাইমলেস টেস্ট, আমি এখানে স্কোর করার কোন প্রয়োজন দেখিনা।’

  • তৃতীয় দিন

তৃতীয় দিন ছিল প্রথম দুই দিন খেলার পর ম্যাচের প্রথম বিশ্রামের দিন। এ দিন মাঠে কোন বল গড়ায়না।

  • চতুর্থ দিন

তৃতীয় দিন, মানে যেদিন মাঠে একটা বলও গড়ায় না সেদিন রাতে বৃষ্টি হয়। চতুর্থ দিন খেলা শুরুর আগে তাই সবাই মাঠের পিচ নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, উইকেট একটু পরিবর্তন হয়নি। তবে চতুর্থ দিনের প্রথম সেশনের পুরোটাই ছিল মেঘলা কন্ডিশনের। নার্সও খুব সম্ভবত একদিন আগে কিভাবে খেলছিলেন তা ভুলে গেছিলেন, তিনি স্ট্রোক খেলার চেষ্টা করছিলেন বারবার। ইংলিশ ফিল্ডারদেরও একদিন বিশ্রামের পর মাঠে একটু বেশিই প্রাণবন্ত লাগছিল।

এতে করে নার্সও দ্রুত সেঞ্চুরি পেয়ে যান, পার্টনারশিপটাও সেঞ্চুরি দেখতে বেশি নেয়না। কিন্তু পুরো টেস্টেই যেটা দেখা যাচ্ছিল, নার্সকেও দেখতে হল তাই। বেশি স্ট্রোক খেলতে যাওয়াই কাল হল তার জন্যে। পার্কসের ইয়োর্কারে ১০৩ রানের মাথায় প্যাভিলিয়নে ফিরে যান তিনি।

গ্রিভসনের জন্যে টেস্টটা ছিল তার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট, আর প্রথমবারের মত তিনি ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার মধ্যে চাপের লেশমাত্র দেখা যাচ্ছিল না। নার্সের ডিসমিসালও গ্রিভসনের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলতে পারেনি। বরং ভেরিটিকে ড্রাইভে চার মেরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫০০ রানে তিনিই পৌছে দেন।

পার্কসের পাঁচ উইকেট, উইকেটে স্পিন ধরায় ভেরিটির দ্রুত দুই উইকেট লাভ, সব মিলিয়ে হঠাৎই যেন এরপর সুসময় দেখতে শুরু করে ইংল্যান্ড। দক্ষিণ আফ্রিকা অল-আউট হয়ে যায় মাত্র ৫৩০ রানে!

দক্ষিণ আফ্রিকা এরপর বল হাতে নিলে সেখানেও ব্যাটিংয়ের মত ছড়ি ঘোরাতে শুরু করে। বব নিউসনের পেসে প্রথমেই ইনসুইংগারে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান পল গিব। এরপর লেন হাটনের সাথে এডি পেইন্টার যোগ দিলে দুইজনই বিচক্ষণতার সাথে নিউসনের পেস মোকাবেলা করতে থাকেন। তবে দিনের শেষে বৃষ্টি বাগড়ায় সেদিন আর ৩৫ এর বেশি করা হয়না ইংল্যান্ডের।

হাটনের ২৪ আর পেইন্টারের ৬ এ সেদিনের খেলা ইংল্যান্ড শেষ করে ৩৫/১ নিয়ে!

  • পঞ্চম দিন

পঞ্চম দিনে হাটন আর পেইন্টার যখন ব্যাট করতে নামেন, আবহাওয়া ছিল মেঘলা। তবে এদিনও পিচ ছিল একেবারেই প্রথম দিনের মত। টেম্পারমেন্টের প্রমাণ দিয়ে ইংলিশ ব্যাটসম্যানেরাও তাই দক্ষিণ আফ্রিকান বোলারদের খেলে যাচ্ছিল বেশ সাবলীলভাবেই। দিনের প্রথম দুই ঘন্টাতেই তাই ইংল্যান্ডের রান ৫০ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু ৬৪ রানের মাথায় ভুল বোঝাবুঝিতে হাটন রান আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান।

এরপর ক্রিজে এসে পেইন্টারকে সাথে নিয়ে নরম্যান গর্ডন লাঞ্চ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ইনিংসে কোন বিপদ ঘটতে দেননি। তবে বিপদ কিন্তু একেবারেই যে কাটাতে পেরেছিলেন তাও নয়। লাঞ্চের পর দ্বিতীয় সেশনেই নরমান গর্ডন স্লিপে ক্যাচ তুলে দেন, যদিও সে যাত্রায় দক্ষিণ আফ্রিকান ফিল্ডারদের কল্যাণে তিনি বেঁচে যান।

কিন্তু এরপরই দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের আক্রমণে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়তে থাকে ইংল্যান্ডের ইনিংস। দিন শেষে যেটা দাঁড়ায় ২৬৮/৭ এ!

ইংল্যান্ড কি ফলোঅন এড়াতে পারবে?

  • ষষ্ঠ দিন

ষষ্ঠ দিনের শুরুতেই ল্যাংটনের তান্ডবে ইংল্যান্ডের ইনিংস গুটিয়ে যায় বেশ অল্প রানেই। এমিসের ৮৪ এর পর আর কেউ প্রতিরোধ গড়তে না পারায় ইংল্যান্ড অলআউট হয়ে যায় ৩১৬ রানেই, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ২১৪ রান দূরে থেকে।

এমনিতেই টাইমলেস টেস্ট ম্যাচ, সময়ের কোন সমস্যা নেই। দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক তাই ইংল্যান্ডকে ফলোঅনে না পাঠিয়ে আবারও ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক মেলভিল এর মধ্যে আবার ইনজুরি বাধিয়ে বসেন। তাই ওপেন করতে বিজলের সাথে পাঠানো হয় মিচেলকে।

মজার ব্যাপার হল, ম্যাচের ষষ্ঠ দিনেও পিচে তখন অব্দি কোন ফাটল ধরেনি আর এরই সুযোগ নিয়ে দুই ওপেনার দলের লিড বাড়িয়ে নিচ্ছিলেন আর পার্টনারশিপ ১৯১ এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার কোন উইকেট ইংল্যান্ড নিতে পারেনি। নিজের রান যখন ৮৯, তখন ভেরিটিকে পুল করতে গিয়ে বোল্ড আউট হয়ে ফিরে যান মিচেল।

আর এরপরই দ্রুত আরো ২ উইকেট হারিয়ে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। সিলি পয়েন্টে রোয়ান আর শর্ট লেগে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান ভ্যান ডার বিজল। দিনের শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার রান দাঁড়ায় ১৯৩ রানে ৩ উইকেট। তবে ম্যাচে তখনও ইংল্যান্ড থেকে ওরা ৪০৭ রান এগিয়ে!

  • সপ্তম দিন

দিনের শুরুটাই দক্ষিণ আফ্রিকার জন্যে হয় বিপদ নিয়ে। শর্ট লেগে হাটনের ক্যাচে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান নার্স। ইনজুরি সত্ত্বেও তাই মাঠে নেমে যেতে হয় মেলভিলকে। তিনি আর ভিলজন মিলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বেশ দ্রুতগতিতেই টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। লাঞ্চের আগেই তাই দক্ষিণ আফ্রিকা যোগ করে ফেলে ৯৯ রান, ইংল্যান্ডের চাইতে লিড ছিল ৫০৬ রানের!

লাঞ্চের পরেও ইংলিশ বোলারদের ওপর এই দুই জুটির দাপট বেশ ভালভাবেই অব্যাহত ছিল। ইনজুরি নিয়ে ফুটওয়ার্কের স্বল্পতা সত্ত্বেও মেলভিল চালিয়ে যাচ্ছিলেন বেশ ভালভাবেই আর অধিনায়ককে যোগ্য সঙ্গ দিচ্ছিলেন ভিলজন। কিন্তু এই জুটির রান ১০৪ হয়ে গেলে পার্কসের বলে বোল্ড হয়ে ভিলজন প্যাভিলিয়নে ফিরে যান। এসময় ভিলজনের রান ছিল ৭৪।

ভিলজনের স্থানান্তরে ক্রিজে আসেন ডাল্টন আর এসেই তিনি আবারও চওড়া হতে শুরু করেন, আর এবারও তাঁর ভিক্টিম ঐ রাইটই। তবে এবার রাইটও কিন্তু ছেড়ে কথা বলেননি। নিজের বলেই ফিরতি ক্যাচে প্যাভিলিয়নে পাঠিয়ে ছেড়েছেন ডাল্টনকে। ডাল্টন চলে গেলে এরপর অধিনায়ক মেলভিলও খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারেননি। ১৯৭ মিনিট ব্যাটিংয়ের পর ১০৩ রান করে ফার্নেসের বলে আউট হয়ে ফিরে গেছেন প্যাভিলিয়নে।

মেলভিল ফিরে যাবার পর টেলএন্ডারে দক্ষিণ আফ্রিকার রান কিছুটা বাড়ানোর দায়িত্ব নিলেও, শেষ অব্দি গ্রিভসন সফল হতে পারেননি। খুব দ্রুতই তাই মুড়িয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস। ফার্নেসের ৪ টা আর রাইটের ৩ উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বিতীয় ইনিংসে করতে পারে মাত্র ৪৮১, ইংল্যান্ডের জেতার জন্যে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৬৯৬!

টাইমলেস টেস্টের হিসেবে এটা খুব বড় কিছু হবার কথা না।

যা হোক, ৬৯৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাট কর‍তে শেষ বিকেলে ওপেন করতে নামেন হাটন আর গিব, কিন্তু নিউসন মাত্র একটা বল করার পরই আম্পায়ার আলোক স্বল্পতায় খেলা বন্ধ ঘোষণা করেন।

  • অষ্টম দিন

খুবই আশ্চর্যজনকভাবে অষ্টম দিনেও পিচের আচরণ একেবারেই বদলায়না। হাটন আর গিব তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের ওপর চড়াও হয়ে রান তুলতে থাকে বেশ ভালভাবেই। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার রান যখন ৭৮, নিজের ৫৫ রানে মিচেলের বলে বোল্ড আউট হয়ে যান হাটন, দক্ষিণ আফ্রিকাও অনেকটা সময় পর একটা ব্রেক থ্রু পায়।

এডরিচের ফর্মটা ভাল যাচ্ছিলনা বেশ কয়েক ম্যাচ ধরেই। তবুও অধিনায়ক ওয়ালি হ্যামন্ড এডরিচকে নিয়েই বাজি ধরেন, নিজের আর পেইন্টারের আগে এডরিচকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়ে দেন । তা এডরিচও এবার অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিতে শুরু করেন। গিবকে নিয়ে ইংল্যান্ড ব্যাটিং ইনিংসের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন।

দ্রুতই গিবের সেঞ্চুরি আর এডরিচের হাফ-সেঞ্চুরি হয়ে যায়, মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকান ফিল্ডাররাও অস্থির হয়ে ওঠেন । কিন্তু এই অস্থিরতার প্রতিদানে ইংলিশ ব্যাটসম্যানেরা যেন ধৈর্য্যের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠেন আর দিনশেষে? দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাপ্তি ঐ এক উইকেটই!

ইংল্যান্ড দিনের খেলা শেষ করে ২৫৩ রানে ১ উইকেট হারিয়ে! জেতার জন্যে তখনও দরকার ৪৪৩ রান!

  • নবম দিন

নবম দিনের শুরু থেকেই বৃষ্টি বাগড়া দিতে থাকে । টানা বর্ষণের পর দুপুর আড়াইটা নাগাদ দিনের খেলা পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়।

  • দশম দিন

দশম দিন ছিল ম্যাচের  দ্বিতীয় বিশ্রামের দিন। তবে এদিন নিয়ে একটা বেশ মজার গল্প আছে। দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক মেলভিলের মনে ছিল না যে দিনটা ছিল বিশ্রামের দিন। তিনি দিনের সকালে ম্যাচের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলেন আর তখন হোটেলের ওয়েটার তাকে মনে করিয়ে দেয় যে সেদিন খেলা মাঠে গড়াবেনা।

  • একাদশ দিন

যেহেতু আগে বৃষ্টি হয়েছে, একাদশ দিনের খেলা শুরুর আগে তাই ইংল্যান্ড অধিনায়ক হ্যামন্ড পিচে রোলার চালানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু হ্যামন্ডের প্রস্তাবকে নাকচ করে দেওয়া হয়। তাতে অবশ্য ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের কোন সমস্যা হয়নি। লাঞ্চের আগেই গিব তাঁর কাঙ্খিত সেঞ্চুরিটি পেয়ে যান আর লাঞ্চে যাওয়ার আগে ইংল্যান্ডের রান দাঁড়ায় ৩৩১ , মাত্র এক উইকেট হারিয়ে!

তবে লাঞ্চের পরপরই ডাল্টনের বলে গিব আউট হয়ে গেলে দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বিতীয় ব্রেক থ্রু টা পেয়ে যায়। ৪৫১ মিনিট ক্রিজে থেকে ১২০ রান করে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান গিব। ৩৫৮-২ এ এবার পেইন্টারের আগে ব্যাটে আসেন অধিনায়ক ওয়ালি হ্যামন্ড। হ্যামন্ডকে ব্যাট করতে নামতে দেখে দক্ষিণ আফ্রিকানরা অবশ্য একটু অবাকই হয়।

হ্যামন্ড আর এডরিচ মিলে এরপর বিপর্যয় সামলে নিয়ে আবারও ইংলিশ ইনিংসকে উপরে তুলতে থাকেন। এর মধ্যে শটের ফুলঝুরি ছুটিয়ে টি ব্রেকের আগেই এডরিচ তাঁর ডাবল সেঞ্চুরিটি পেয়ে যান। তবে এরপর আর পিচে খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারেননি তিনি। ডাল্টনের বলে এডরিচের মিডল স্ট্যাম্প ভেঙে গেলে ৪৬০ মিনিট ক্রিজে থেকে ২৫ বাউন্ডারিতে সাজানো ২১৯ রানের সমাপ্তি ঘটে।

এডরিচ প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলে ক্রিজে আসেন পেইন্টার আর হ্যামন্ডকে সাথে নিয়ে বাকি দিনটা কাটিয়ে দেন তিনি। একাদশ দিনের শেষে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৩ উইকেট হারিয়ে ৪৯৬। হ্যামন্ড ৫৮ আর পেইন্টার অপরাজিত ছিলেন ২৪ রানে!

  • দ্বাদশ দিন

অসম্ভবকে সম্ভব করতে ইংল্যান্ডের আর দরকার ছিল ২০০ রান, হাতে ছিল সাত উইকেট। কিন্তু এতেও আবার বাগড়া দেয় দিনের মাঝের বৃষ্টি। তবে বৃষ্টি ছাড়াও আরেকটা সমস্যা ছিল ইংল্যান্ডের। এই টেস্টটাতে কোন সময়ের বাধা ছিল না সেটা তো আগেই বলা হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ইংল্যান্ডকে যা করার এই দিনেই করতে হত। কারণ এ দিনেই রাত আটটায় ইংল্যান্ডের ট্রেন শিডিউল ছিল!

 

দিনের শুরু থেকেই তাই হ্যামন্ড আর এডরিচ দ্রুত তালে রান তুলতে শুরু করেন, প্রথম ঘন্টাতেই স্কোরবোর্ডে জমা করেন ৩৯ রান। হ্যামন্ড ছিলেন রানিং বিটুইন দা উইকেটে দারুণ কার্যকরী এক ব্যাটসম্যান। সিঙ্গেল ডাবলস নেওয়ার সব কয়টা সুযোগই তাই কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন পেইন্টার আর হ্যামন্ড জুটি। এতে খুব দ্রুতই পেইন্টার তাঁর ১৬ তম হাফ-সেঞ্চুরি আর হ্যামন্ড তাঁর ২১ তম সেঞ্চুরি পেয়ে যান।

পেইন্টার-হ্যামন্ড জুটি খুব দ্রুতই ইংল্যান্ডকে ৬০০ পার করিয়ে ফেলে, কিন্তু আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হতে থাকলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে নিজের ৭৫ রানের মাথায় প্যাভিলিয়নে ফিরে যান পেইন্টার। ইংল্যান্ডের রান তখন ৬১১!

আকাশ আস্তে আস্তে কালো হতে থাকে, বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখে হ্যামন্ড আর নতুন যোগ দেওয়া এমিস তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের ওপর আক্রমণাত্মক হবার সিদ্ধান্ত নেন। তবে সেই আক্রমণ থামানোর দায়িত্বও নিয়ে নেন ডাল্টন। নিজের রান ১৪০, তখন ডাল্টনকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে স্ট্যাম্পিংয়ের স্বীকার হন হ্যামন্ড, চা বিরতির ঠিক আগে আগে ফিরে যান প্যাভিলিয়নে। চা বিরতির সময় ইংল্যান্ডের রান ছিল ৫ উইকেট হারিয়ে ৬৫৪! তবে গ্রিভসন নতুন আসা ভ্যালেন্টাইনের স্ট্যাম্পিং মিস না করলে উইকেটটা ছয়ও হতে পারত!

চা বিরতির সময়ই শুরু হয় বৃষ্টির বাগড়া। খেলা আবার মাঠে গড়াবে কিনা এরকম একটা আশঙ্কা যখন করা হচ্ছিল, তখন কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি থেমে যায়। কিন্তু খেলোয়াড়েরা আবার যখন মাঠে নামে , তক্ষুণি আবারও দুয়ার খুলে নেমে পড়ে বৃষ্টি। অগত্যা, সেদিনের খেলা সেখানেই থামিয়ে দিতে হয়!

ইংল্যান্ডের ট্রেইন শিডিউল ছিল সেদিন রাত ৮:০৫ মিনিটে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ড ইংল্যান্ডকে ত্রয়োদশ দিনের খেলা মাঠে গড়ানোর প্রস্তাব দেয়। দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট বোর্ড এরকমও প্রস্তাব দেয় যে এমিস, ভ্যালেন্টাইন, ভেরিটি, রাইট, ফার্নেস আর পার্কস বাদে বাকিরা ফিরে যাক আর দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ড এমিসদের জন্যে নাহয় একটা স্পেশাল চার্টার্ড ফ্লাইটের ব্যাবস্থা করবে। কিন্তু ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড কিছুতেই রাজি না হলে খেলা এদিনেই থামিয়ে দিয়ে ম্যাচটিকে ড্র ঘোষণা করা হয়।

তবে এতে খেলোয়াড়েরা যে সন্তুষ্ট ছিল এমন বলা যাবেনা। এডরিচ যেমন বলেছেন, ‘আর আধা ঘন্টা পেলেই আমরা ম্যাচটা জিতে যেতাম।’

এমিসের মতে, ‘আবহাওয়াই শেষ সিদ্ধান্তটা নিল। অথচ আমাদের সম্ভাবনা ছিল সবচাইতে বেশি।’

নার্স অবশ্য এমিসের কথা মানতে পারেননি। তিনি নিজেদের সম্ভাবনাও দেখেছেন ভালভাবেই, ‘আমাদের বোলাররা পিচকে কাজে লাগাতে পারত। ম্যাচে যেকোন কিছু হতে পারত।’

 

রোয়ানও নার্সকেই সমর্থন জানিয়েছেন, ‘আনকাভারড উইকেটে আবারও ব্যাট করা ব্যাটসম্যানদের জন্যে নিঃসন্দেহে কঠিন হত।’

  • প্রতিক্রিয়া

এ ম্যাচ নিয়ে বিশ্ববাসীর প্রতিক্রিয়া ছিল একেবারেই নজরকাড়া। গার্ডিয়ান যেমন পরদিন লিখেছিল, ‘এমনকি দাবারও তো শেষ আছে।’

উইজডেন এ ম্যাচের উইকেটকে বলেছিল, ‘ওভার প্রিপেয়ার্ড উইকেট।’ টাইমস বলেছিল এটাই নাকি সত্যিকারের ক্রিকেট!

  • স্কোরকার্ড

দক্ষিণ আফ্রিকা: ৫৩০ (পিটার ভ্যান ডার বিজল ১২৫, ডাডলি নার্স ১০৩, অ্যালান মেলভিল ৭৮, রনি গ্রিভসন ৭৫ , এরিক ডাল্টন ৫৭; পার্কস ৫-১০০) এবং ৪৮১ (অ্যালান মেলভিল ১০৩, পিটার ভ্যান ডার বিজল ৯৭, ব্রুস মিচেল ৮৯, কেন ভিলজুন ৭৪; কেন ফার্নেস ৪-৭৪)

ইংল্যান্ড: ৩১৬ (লেস এমিস ৮৪, এডি পেইন্টার ৬২; এরিক ডাল্টন ৪-৫৯) এবং ৬৫৪-৫ (বিল এডরিচ ২১৯, ওয়ালি হ্যামন্ড ১৪০, পল গিব ১২০, এডি পেইন্টার ৭৫, লেন হাটন ৫৫).

ফলাফল: ড্র

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link