অভিজ্ঞতায় বিপত্তি/আপত্তি

টেলর - মুনরো বাদ পড়ায় এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কাগজে কলমে সবচেয়ে অভিজ্ঞ দল বাংলাদেশ হবে। ১০ বছর অভিজ্ঞতায় নিয়ে গতবার দুইবার লজ্জার মুখে পড়া দল, এবার ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে আশা করি লজ্জার সংখ্যাটা কমাবে।

নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপের জন্য স্কোয়াড ঘোষণা করছে। সেই স্কোয়াডে অভিজ্ঞ কলিন মুনরোর সাথে আরেক অভিজ্ঞ রস টেলরও নেই৷ এদের বাদ পরাটা অপ্রত্যাশিত কিছু না হলেও। রস টেইলরেরকে নিয়ে মনে হলো সে বাংলাদেশের হয়ে খেললে সবার আগে সে বিশ্বকাপে যেতেন অভিজ্ঞতার ট্যাগটা নিয়ে।

ক্রিকেট অভিষেকের পর রস টেলর এই প্রথম কোনও আইসিসি টুর্নামেন্ট খেলবেন না। রস টেইলর সর্বশেষ সিরিজ খেলেন উইন্ডিজের সাথে টি-টোয়েন্টিতে। এরপর ইনজুরিতে পাকিস্তান এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে সিরিজ মিস করেন৷ এই বছর হওয়া বাংলাদেশ সিরিজেও তিনি ছিলেন না।

১০২ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে ২৫ গড়ে ১২২.৩৭ স্ট্রাইকরেটে ১৫৬০ রান৷ একেবারেই সাদা মাটা আমাদের অনেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের মতোই। ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর, ১৭ সালে তার স্ট্রাইকরেট ছিল ১৫৩.৪৫, ১৮ সালে ৩৮ গড়ে ১২৬.৪৯, ১৯ সালে ২৮ গড়ে ১২৫ স্ট্রাইকরেট। ২০ সালে সেটা ছিল ৩৩ গড়ে ১২৭.৬৯ স্ট্রাইকরেট। এটাও আমাদের সিংহভাগ অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের মতোই৷ তাঁর খেলা সর্বশেষ সিরিজে ভারতের সাথে তাঁর দুই ফিফটিও ছিল ২৭ বলে ৫৪ রান করেন, আরেকটা ম্যাচে ৫৩ করেন।

খুব খারাপ না পরিসংখ্যান কিন্তু আমারা যাদের অভিজ্ঞ বলে বিশ্বকাপে নিতে নিচ্ছি তাদের চেয়ে। বিশ্বকাপেও তার পূর্বের পারফরম্যান্স ভালো। ২৮ গড় এবং ১২৮ স্ট্রাইকরেট নিয়ে ৫৬২ রান তার আছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। স্পিনে পারদর্শী হওয়ার অনন্য যোগ্যতা  তো তাঁর রয়েছেই। তারপরও তিনি বাদ গেলেন অনভিজ্ঞ চ্যাপম্যানের কাছে হার মেনে।

টেইলরের জায়গায় দলে আছেন মার্ক চ্যাপম্যান। টেইলর কাছাকাছি কন্ট্রিবিউট তিনি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে করতে পারেন নি।৷ ২৮ ইনিংসে ২২ গড়ে ৫৩৫ রান স্ট্রাইকরেট ১১৭ মাত্র। টেইলরের চেয়ে তো তিনি ভালো না? তাও তিনি বিশ্বকাপে যাবেন।

অভিজ্ঞতা, পরিসংখ্যান এগুলোর বাইরে আরেকটা ব্যাপার আছে। সেটা হচ্ছে সম্ভবনা৷ চ্যাপম্যান এখনো টেইলরের চেয়ে ভাল খেলোয়াড় না – এটা সবাই স্বীকার করে নেবে৷ তবে ২০০৬ সালে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ক্যারিয়ারে শুরু করে ১৫ বছর পরও টেইলর খুব ভালো খেলোয়াড় হতে পারেন নি এটা ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের ব্যর্থতা৷ এই ব্যার্থতা টানার চেয়ে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট সম্ভবনা পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত বেছে নিয়েছে। সেটাও বিশ্বকাপের মতো আসর তাদের এই সিদ্ধান্তের বাড়তি কোনও ভাজ ফেলায় নি। এই সিধান্ত নেয়ার সাহস এই দেশের ক্রিকেট বোর্ডের নাই। এই সিধান্ত সমর্থন করার মানসকিতাও এই দেশের সিংহভাগ দর্শকের নাই।

চ্যাপমান তাঁর ৩০ ম্যাচের ক্যারিয়ারে টেলরের চেয়ে ভালো হতে পারেন নি। তাতে টেলরের ক্যারিয়ার জাস্টিফাইড হয় না৷ এই সিম্পল জিনিস অনেকে বোঝেন না। বাংলাদেশের ১৩-১৪ বছর খেলা ক্রিকেটারদের সাথে এখন যারা খেলেন তাদের মধ্যে তুলনা দিয়ে হয়তো টেইলর ১২২ স্ট্রাইকরেট এবং চ্যাপম্যানের ১১৭ স্ট্রাইক রেটের তুলনা করে টেইলরকে বেটার বলতে পারেন। কিন্তু তাই বলে টেইলর ক্যারিয়ার জাস্টিফাইড যেমন হয় না, তেমনি ভাবে আমার তমুক ক্রিকেটারও ভালো সম্পদ হয়ে যাবেন না৷

কলিন মুনরো অভিজ্ঞ একটা নাম। দুর্দান্ত পারফর্মার। এক সময়ে টি-টোয়েন্টি র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষেও ছিলেন। তিনিও ইনজুরিতে বাদ গিয়েছিলেন৷ তার জায়গায় কনওয়ে এসেই ভালো করেন৷ তবে বাদ যাওয়ার আগের পাচঁ ইনিংসে তার রান ছিল ২১ বলে ৪৬, ৪২ বলে ৫৯, ১৫ বলে ২৬, ৪৭ বলে ৬৪ এবং ছয় বলে ১৫। শেষ পাচঁ ইনিংসে ১৩১ বলে ২১০ করেছেন৷ তারপরও তার জায়গায় যিনি এসেছেন দুর্দান্ত করেছেন। মুনরো বাদ গিয়েছেন৷

এই যে কনওয়ে তার এশিয়াতে খেলার অভিজ্ঞতা নাই। বিশ্বকাপেরও নাই। তারপরও তিনি আছেন৷ কারন তিনি ভালো করেছেন। মুনরোর কিন্তু দুইটারই অভিজ্ঞতা ছিলো৷ উল্লেখ করা ভালো এই পাকিস্তান সুপার লিগে (পিএসএল) ১৫৯ স্ট্রাইকরেটে ২৮৫ করছেন মাত্র ৭ ইনিংসে।

তারা ৩৪ বছর বয়সী মুনরো অভিজ্ঞতার চেয়ে নতুন কনওয়েকে ভরসা করেছেন তাঁর পারফরমেন্সর জন্যই।

এই যে নুরুল হাসান সোহান সুযোগ পেয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করলো শুধু উইকেটরক্ষক হিসাবে তাকে কি সুযোগ দিবে বাংলাদেশ? নাকি নিয়মিত উইকেটরক্ষক মুশফিক ফিরে আসলে সব ফরম্যাট থেকে সোহন বাদ যাবেন? সোহান কে ভরসা করা হবে এইটা তে বলতে পারবেন না৷ সোহানের ব্যাটিংটা এই সিরিজে ভালো হয় নি। তবে ভালো পিচে ভালো পারফরম্যান্স করার রেকর্ড তাঁর আছে। শট খেলার ধরণ, ব্যাটিং টেকনিক থেকে বলা যায় তিনি যে কোনও ফর্মেটে খেলতে পারেন।

এটাই হচ্ছে নিউজিল্যান্ডে আর বাংলাদেশের মধ্যে তফাৎ। আমরা কেউ ব্যাক করলেই তাকে তার জায়গাটা ফিরিয়ে দেই। এই যে অভিজ্ঞতা নামক একটা ট্যাগ দিয়ে কাউকে কাউকে অতিমানবীয় করে তোলার সংস্কৃতি শুধু এই দেশের ক্রিকেটে বিদ্যমান।

এই যে ২০১৬ সালে ১০ বছর টি-টোয়েন্টি খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে একাদশের অর্ধেক ক্রিকেটার ( পাঁচ জন) টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেললো তাতে দলের অর্জনটা কি ছিল? কোনও রকমে নেদারল্যান্ডসের সাথে ৮ রানে জিতে বাছাই পর্ব পেরিয়ে, মূল পর্বে গিয়ে সবগুলো ম্যাচ হারা।

অভিজ্ঞতার দাম বাংলাদেশ পায় নি। ৩ বলে ২ রান অভিজ্ঞরাই নিতে ব্যর্থ হয়। ইডেন গার্ডেনের মতো পিচে টি২০ তে একটা দল ৭০ রানে অলআউট হয়। ১১ জনের একদাশের পাচঁ অভিজ্ঞ মিলে সেদিন রান করছিল ১৩! এই ১০ বছরের অভিজ্ঞতা কাজে যখন লাগে না। আরও পাচঁ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০২১ কেউ হাতি ঘোড়া হয়ে যান নি৷ আগের মতোই আন্ডার পারফর্মার।

২০১৬ তে আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। অস্ট্রেলিয়ার সাথে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচ। কিছু দিন আগে হঠ্যাৎ স্টারে এটার হাইলাইটস দেখতেছিলাম। তো তাতে শেষের দিকে সুনীল গাভাস্কার মাশরাফিকে নিয়ে প্রশ্ন করেন। বলে রাখা ভালো ঐ ম্যাচে শুরুর ওভারে ৯ রান কনসিড করার পর মাশরাফি বলেই আসেন নি৷ ছোট্ট টার্গেট ডিফেন্ড দলের মেইন বোলারের না আসাটা গাভাস্কারের পছন্দ হয় নি।

তিনি ম্যাচের শেষের আগে বলে বসলেন, ‘Very disappointing. Is Mortaza playing only as a captain or as a bowler? In this small run chase, he only bowled one over. As one of the main bowlers you should take the responsibility.’

ঐসময় সমালোচনা স্বীকার হতেন না দেখে এগুলো নিয়ে খুব আলাপ হয় নি। এর আগের ম্যাচে তিন ওভারে ৪১ রান কনসিড করেন। গাভাস্কার যেই প্রশ্নটা ২০১৬ তে করেন। সেটা বাংলাদেশের সাধারন দর্শক থেকে বাইরের বিশ্লেষকরা ২০১৯ সালে করেন। সময় চক্রের খেলা আর কি।

এই যে অভিজ্ঞতা কিংবা ক্যাপ্টেন ফ্যান্ট্যাস্টিক হিসাবে রিয়াদ ২১ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলবেন। সেখানে তিনি কোনও টিপ্পানীর শিকার হবেন না এটা কামনা থাকবে। তবে ঐখানে শামীম আশরাফ কিংবা আতাহার আলীরা থাকবেন না। এই নাসির হুসেইন, হার্শা ভোগলে তারা আবার ছোট্ট বিষয় গুলো বিশ্লেষণ করেন ম্যাচ চলাকালীনই।

সৌম্য সরকার এবং মোহাম্মদ মিঠুন নিয়ে দর্শকদের মতামত বোর্ড পাত্তা দিয়ে না দিলেও, সিনিয়রদের অভিজ্ঞতা নিয়ে, তাদের ১৪ বছের জং ধরা স্ট্যাট সামান্য এগিয়ে থাকা নিয়ে এই দেশের সিংহভাগ ক্রিকেট সমার্থক যে বেজায় খুশি এইটুক ক্রিকেট বোর্ড ভালোই পাত্তা পায়।

এই স্ট্যাটরে জং ধরা বলছি দেখে রাগ করবেন না।

বিশ্বকাপের আগে ৩-৪ সিরিজ মিস করা খেলোয়াড়কে বিশ্বকাপে নামায় দেয়া হবে৷ শুনলাম তামিম ইকবাল নিউজিল্যান্ডে সিরিজও মিস করবেন। বিশ্বকাপের আগে কোনও টি-টোয়েন্টি সিরিজ না খেলে ৬ মাসে। সরাসরি বিশ্বকাপে গিয়ে জং ধরা স্ট্যাট নিয়ে তিনি করবেন টা কি?

টেলর – মুনরো বাদ পড়ায় এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কাগজে কলমে সবচেয়ে অভিজ্ঞ দল বাংলাদেশ হবে। ১০ বছর অভিজ্ঞতায় নিয়ে গতবার দুইবার লজ্জার মুখে পড়া দল, এবার ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে আশা করি লজ্জার সংখ্যাটা কমাবে।

দুইটা কমন কমেন্ট প্রায়শ দেখি। প্রথমটা হচ্ছে অমুক দেশের পাইপলাইনের সাথে আমাদের তুলনা করে লাভ নাই৷ কথাটা সঠিক। তবে চ্যাপম্যানের মতো ক্রিকেটারও এই দেশে আছে৷ রস টেলরের মতো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার আছে অনেকগুলোই এই দেশে৷

আরেকটা খুবই হাস্যকর সেন্টিমেন্টাল কমেন্ট! প্রথমত তাদের অবদান এতটা কম না, না খেললেই সেটা ভুলে যেতে হবে। ভালো কিছু চাওয়া মানে তাদের অবদান ভুলে যাওয়া না। তাদের কারণে যদি ভালো কিছু হওয়াটা আটকায় থাকে৷ তখন তাদের অবদান চাইলেই মনে করা সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক শুধুমাত্র অধিনায়ক বলে যেই ফর্ম নিয়ে যাবেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেটা কোনও ভালো লক্ষ্মণ না। আরেক ওয়ানডে অধিনায়ক ৫-৬ মাস টি-টোয়েন্টি না খেলে যে নেমে পড়বেন এটাও ভালো লক্ষন না৷

তামিমের অনুপস্থিতিতে কেউ কনওয়ে হন নাই এটা একটা সত্য কথা৷ তবে তামিম ইকবাল মুনরোর মতো কোনও পটেনশিয়াল প্রুভেন অ্যাসেট না টি-টোয়েন্টিতে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...