কেন এই জঘন্য পেস বোলিং?

বাংলাদেশের পেসাররা যে ২৪ উইকেট নিয়েছেন, সে জন্যও আবার খালেদ, এবাদত, রাহিদের কৃতিত্ব দিতে যাবেন না। এই ২৪ উইকেটের মধ্যে এ বছর তাসকিন একাই নিয়েছেন ১৩ উইকেট। বাকী ১১টা উইকেট বাকী সব পেসাররা ভাগ করে নিতে পেরেছেন।

মাথার ওপর আকাশ ভরা কালো মেঘ। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে। মৃদু মন্দ বাতাস আছে। এই একটু আগে কাভার সরেছে। উইকেট আগেরকালের মত ভেজা না হলেও স্যাতসেতে তো বটেই।

দুনিয়ার যে কোনো ফাস্ট বোলারের জন্য নিশ্চয়ই স্বপ্নের মত একটা সময়। এই সময়ে বল করার জন্য মুখিয়ে থাকার কথা তাদের। কিন্তু হায়!

বাংলাদেশের দুই ফাস্ট বোলার খালেদ আহমেদ আর এবাদত হোসেনকে দেখে মনে হলো, বল করার জন্য এর চেয়ে খারাপ দিন আর হয় না। দু’জনই একটানা শর্ট বল, হাফভলি, স্ট্যাম্পের বাইরে নির্বিষ ডেলিভারি করে গেলেন। আজাহার আলী আর বাবর আজম আরামের সাথে একটার পর একটা বাউন্ডারি মারলেন।

মাত্র ৬ ওভার ২ বলের একটা চিত্র। এই সামান্য সময় দিয়ে একটা দেশের খেলোয়াড়দের সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসা তো সম্ভব না। কিন্তু এই ৩৮টি বল আসলে বাংলাদেশি ফাস্ট বোলারদের একটা বিজ্ঞাপন। অন্তত গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের পেস বোলিং মানেই এরকম নির্বিষ, নখ-দন্তহীন এক প্রদর্শনী। একমাত্র তাসকিনকে বাদ দিলে সাদা পোশাকে বাংলাদেশী পেসার মানেই প্রতিপক্ষের রান মেশিন।

এই পাকিস্তানের শাহীন শাহ আফ্রিদি বা হাসান আলী যখন গুণে ৫ উইকেট করে নিচ্ছেন, তখনই আমাদের পেসাররা মাথা কুটে মরছেন উইকেট পাওয়ার জন্য। এতোটাই বিরক্তিকর ছিলো পেস বোলারদের এই প্রদর্শনী যে, দলের ফিল্ডিং কোচ ও সাবেক পেসার মিজানুর রহমান বাবুল প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে এদের সমালোচনা করতে বাধ্য হলেন। তিনি বললেন, ‘ওইভাবে যদি মূল‍্যায়ন করি, (ওদের বোলিং)  ভালো নয়। প্রথম বলটা চার হয়েছে। যেখানে পয়েন্ট পিছনে ছিল, অফ স্টাম্পেই বেশি ফিল্ডার ছিল। বলব যে, ভালো বোলিং করা হয়নি। আবহাওয়া আমাদের অনুকূলে ছিল। ওই অনুযায়ী আমরা পারফর্ম করতে পারিনি। এটাই বাস্তবতা। অন্যান্য দেশের সাথে যদি আমাদের পেসারদের তুলনা করেন, তাহলে ১০ এর মধ্যে হয়ত ৫-৬ দেব।’

বাবুল সম্ভবত শিষ্যদের প্রতি মায়া করেই ৫-৬ দিতে চাইলেন। নিরপেক্ষ কেউ পাশ মার্কও দেওয়ার কথা নয়।

বাংলাদেশের পেস বোলিং ইদানিং কতটা খারাপ?

পরিসংখ্যানের দ্বারস্ত হওয়া যাক। আজ পর্যন্ত চলতি বছরে বাংলাদেশের পেসাররা ৭টি টেস্টে ২৪টি মাত্র উইকেট নিতে পেরেছেন। এতো কতটা খারাপ, বুঝবেন যে, এই চলতি বছরে তিনটি দলের পেসাররা শতাধিক করে উইকেট নিয়েছেন। এই যে পাকিস্তানের বিপক্ষে আমরা খেলছি, তারাও এ বছরে এ পর্যন্ত ঠিক ৭টি টেস্ট খেলেছে। তাদের পেসাররা এই বছরে ১০২টি উইকেট নিয়েছে। ১০২ আর ২৪! পার্থক্যটা বুঝতে পারছেন?

বাংলাদেশের পেসাররা যে ২৪ উইকেট নিয়েছেন, সে জন্যও আবার খালেদ, এবাদত, রাহিদের কৃতিত্ব দিতে যাবেন না। এই ২৪ উইকেটের মধ্যে এ বছর তাসকিন একাই নিয়েছেন ১৩ উইকেট। বাকী ১১টা উইকেট বাকী সব পেসাররা ভাগ করে নিতে পেরেছেন।

এই চলমান মিরপুর টেস্টের দুই পেসারের হালটা একবার দেখুন। এবাদত এখন পর্যন্ত ৯ টেস্টে ১০ উইকেট নিতে পেরেছেন। তার গড় ৮০.৯০; কিছুদিন আগে ব্রাডম্যানের কাছেই ছিলেন গড়ের দিক থেকে। আর খালেদ তো বিশ্বরেকর্ড করে ফেলতে যাচ্ছেন। চলমান টেস্টটি তার ক্যারিয়ারের তিন নম্বর টেস্ট। এখন পর্যন্ত কোনো উইকেট পাননি। সবচেয়ে বেশি বল করে উইকেট না পাওয়াদের তালিকায় দুই নম্বরে আছেন তিনি; এক নম্বরে চলে গেলে খালেদ মনে হয় অবাক হবেন না।

কিন্তু কেনো এই অবস্থা? কেন বাংলাদেশের পেসাররা অনুকূল পরিবেশেও বল করতে পারেন না?

‘বাংলাদেশের পেসাররা বল করে কোথায়? অনুকূল-প্রতিকূল বাদ দিন; ওদের বল করার সুযোগ মেলে কোথায়? ওরা কোনোদিন এরকম উইকেটে, ভালো উইকেটে আগে পরে বল করেছে?’ – প্রশ্ন করতে না করতেই এই প্রশ্নগুলো করলেন সারোয়ার ইমরান।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক কোচ, সাবেক ফাস্ট বোলার এবং বাংলাদেশের ফাস্ট বোলার তৈরির অন্যতম প্রধাণ কারিগর সারোয়ার ইমরান। তিনিও দারুণ হতাশ পেস বোলিংয়ে এই অবস্থা দেখে। তিনি বলছিলেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে দিনের পর দিন বল করতে না পারা এবং বাজে উইকেটে বল করার ফল আজকের এই খালেদ-এবাদতরা।

ইমরান আরেকটু পরিষ্কার করে বললেন, ‘আমরা ঘরোয়া ক্রিকেট যে ধরণের উইকেটে খেলি, তাতে একজন ফাস্ট বোলার ৪-৫ ওভার বল করলেই টায়ার্ড হয়ে যায়। আর এই ধরণের উইকেটে এদের কিছু করারও থাকে না। ফলে সারা বছর এদের পানি টেনে আর ফিল্ডিং করে সময় কাটে। প্রথম বিভাগ থেকে প্রিমিয়ারে বেশিরভাগ ম্যাচে দু জন, কখনো একজন ফাস্ট বোলার নেওয়া হয়। ফার্স্টক্লাস ম্যাচেও তাঁদের অনুকূলে কিছু থাকে না। বোলিং পায় না। ফলে এরা এই পর্যায়ে এসে আর কিছু করতে পারে না।’

ইমরান নিজেই বললেন যে, চট্টগ্রাম বা মিরপুরে পাকিস্তানের পেসাররা যখন দাপট দেখাচ্ছে, তখন নিজেদের বোলারদের এভাবে বসে বসে মার খাওয়া দেখাটা লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু পেছনের কারণ তিনি জানেন বলে এই পেসারদের দোষ দিতে চান না।

ইমরান বলছিলেন, কিছুকাল আগেও পরিস্থিতি এতোটা খারাপ ছিল না, ‘ম্যাচ উইকেটের আমলেও পেস বোলারদের কিছু করার ছিল। তখন বাদশাহ ভাইরা উঠে এসেছেন। গত কয়েক বছর আগেও পেসারদের জন্য পরিস্থিতি এতোটা খারাপ ছিলো না। এখন আসলে ওদের কিছু করারই নেই।’

তবে এরপরও একটা কথা থাকে।

উইকেট ভালো নেই, ম্যাচ পান না; পেসারদের পক্ষে অনেক যুক্তি আছে। কিন্তু এই পেসারদের নিজেদের কী উন্নতির চেষ্টাটা আছে? এর মধ্যে থেকেই তো আগে একজন তাসকিন উঠে এসেছেন। এই অবস্থা থেকেও তো মাশরাফি-শাহাদাতরা উঠে এসেছিলেন। তাহলে এরা কেনো পারছেন না।

ইমরানের কণ্ঠে এবার আরেকটু হতাশা ঝরে পড়লো, ‘আমি অস্বীকার করবো না যে, এদেরও চেষ্টার অভাব আছে। আসলে কিছু ভালো না করেই তো তারা সর্বোচ্চ স্তরে সুযোগ পাচ্ছে। ফলে ভালো করার যে তাগিদ, সেটা তারা বোধ করে কি না, আমার জানা নেই। একটা ন্যুনতম প্রতিযোগিতা এদের মধ্যে থাকলে হয়তো নিজেকে নিয়ে চেষ্টাটা করতো।’

এটাই লাখ কথার এক কথা। কারো মধ্যে লড়াই করার চেষ্টাটাই নেই। জয়-পরাজয় অনেক দূরের কথা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...