বিসিবি, তুমিও পারবে!

বিসিবি নাকি বিশ্বের চতুর্ধ ধনী ক্রিকেট বোর্ড। অন্যদিকে এক আর্টিকেলে পড়লাম বিশ্বকাপের টানা দু’বারের রানার আপ নিউজিল্যান্ড বোর্ডের বার্ষিক রেভিনিউ কাউন্টির অনেক দলের চাইতেই কম।।

বাংলাদেশ টেস্টে হতশ্রী ধরনের দল, টি-টোয়েন্টিতে এখনো কোয়ালিফাইং রাউন্ড খেলতে হয়, একমাত্র এশিয়ান কন্ডিশনে ওয়ানডেতে মোটামুটি সমীহ জাগানিয়া; সেই দেশের ক্রিকেট বোর্ড এতোটা ধনী হওয়ার রহস্য কী? ১৫ বছর আগেও তো এতোটা ধনশালী ছিল না।

খুব সহজ উত্তর। বাংলাদেশের প্রচুরসংখ্যক মানুষ ক্রিকেট দেখে, ক্রিকেটারদের সবচাইতে বড়ো সেলিব্রিটি মনে করে। ভারতের মার্কেটের সাথে তুলনীয় নয় অবশ্যই, তবে ভারতের আয়তনকেও বিবেচনায় নিতে হবে। যদি জনপ্রিয়তার ঘনত্ব পরিমাপ করি, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার কত পারসেন্ট ক্রিকেটে আগ্রহী, সেই মানদণ্ডে ভারতের চাইতে খুব পিছিয়ে থাকবে না ধারণা করি।

তার মানে পারফরম্যান্সের চাইতেও মানুষের আগ্রহই বিসিবিকে সম্পদশালী করতে ভূমিকা রেখেছে।

আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশের ক্রিকেট হাইপের মূল ভিত্তি ২০১২ সালের এশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠা, এবং ২০১৫ তে দেশের মাটিতে পাকিস্তান, ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকাকে সিরিজ হারানো। ২০১৬-১৭ মৌসুমে টেস্টে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর মধ্য দিয়ে দল হিসেবে তারা ক্রিকেট দুনিয়ায় কিছুটা প্রতিশ্রুতিশীল আখ্যা পায়। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিতে খেলে যদিওবা, তাতে যোগ্যতার চাইতে বৃষ্টিভাগ্যে অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে পয়েন্ট পাওয়াটাকেই বড়ো করে দেখা হয়েছে।

তবু সবাই স্বীকার করবে, এশিয়ান কন্ডিশনে বাংলাদেশ ভয়ানক দল।

মুখে বলছি বাংলাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার ঘনত্ব ভারতের প্রায় কাছাকাছি, ফ্যাক্ট চেকিংয়ের ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন চলেও আসতে পারে। ক্রিকেট আমাদের নিজেদের ব্রান্ড হয়েছে অনেক পরে, কিন্তু এদেশে ক্রিকেট অনেক আগে থেকেই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের আগেও ঢাকায় আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

দর্শক হিসেবে আমরা ছিলাম থার্ড পার্টির মতো, বিদেশি দুই দল খেলছে, আমরা কোনো এক পক্ষকে সাপোর্ট দিতাম; আমাদের কৈশোরেও ফেভারিট ক্রিকেটারের তালিকায় ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দের আধিপত্য থাকতো; ক্রিকেট নিজেদের ব্র্যান্ড হওয়ার পর এখনকার তরুণদের ফেবারিট তালিকায় বাংলাদেশি ক্রিকেটারেরই জয়জয়কার।

যে প্রসঙ্গে বলছিলাম; থার্ড পার্টি পরিচয়ে দীর্ঘদিন ক্রিকেট দেখার দরুণ, দর্শক হিসেবে আমরা এখনো একাগ্র হতে পারিনি। আমি আমার স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে বহু মানুষের সাথে ক্রিকেট বিষয়ে কথা বলেছি, তারা ক্রিকেট দেখে, কিন্তু যখনই জিজ্ঞেস করি, পুরো ম্যাচ দেখো কিনা, হাতে গোনা কয়েকজন পেয়েছি যারা হ্যাঁ বলেছে। বিগত ১০ বছরে ১৫০০+ মানুষের চাকরির ইন্টারভিউ নিয়েছি, ক্রিকেট প্রসঙ্গক্রমে এসেছে, ক্রিকেটপাগল পেয়েছি অনেক, তবু পুরো খেলা দেখা প্রশ্নে বেশিরভাগই নীরব।

ক্রিকেট যারা পছন্দ করেন তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও এর কাছাকাছিই হবে হয়তোবা।

কিন্তু, ফেসবুকে ঢুকলে ধাক্কা খেতে হবে। বাংলাদেশের খেলার আগে এবং পরে আসা স্ট্যাটাসের বন্যা আপনাকে ভুল ইনসাইট দিবে। ক্রিকেট দেখা খুব কম মানুষের প্রায়োরিটি লিস্টেই উপরের দিকে আছে, দেখে অনেকটাই ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে, তর্ক আর গালাগালি করার সময় মনে হবে পৃথিবীতে ক্রিকেটের চাইতে বড়ো কোনো সত্যি নেই।

বিসিবি আমাদের কাছে ক্রিকেট বিক্রি করে। কাস্টমার তিন ধরনের- লয়্যাল কাস্টমার, এভারেজ কাস্টমার, এংরি কাস্টমার। গ্রেট বিজনেস প্রতিষ্ঠান লয়্যাল কাস্টমারের সংখ্যা যতটা সম্ভব বাড়ানোর চেষ্টা করে, তাদের ঘিরেই বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে; এতে এভারেজ কাস্টমারও ক্রমাণ্বয়ে লয়্যালের দিকে স্থানান্তরিত হতে থাকে, এবং অ্যাঙরি কাস্টমারের সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকে।

মিডিওকর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কাস্টমার বিহেভিয়ার নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করে না, নিজেদের কর্তব্যটুকু পালনের চেষ্টা চালায়; যে কারণে তাদের অ্যাভারেজ এবং অ্যাঙরি – দুই ধরনের কাস্টমারই বেশি থাকে, তারা কখনো দৃষ্টান্ত হতে পারে না, তেলাপোকার মতো টিকে থাকে।

বাজে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লয়্যাল বা এভারেজ নিয়ে চিন্তা করে না, তারা কেবল এংরি কাস্টমারকে নানা ছুতোয় ভুলিয়ে রাখতে চায়; অনেকটা গোঁজামিল দেয়ার মতো করে। তাতে সাময়িক প্রাপ্তিযোগ ঘটলেও এংরি কাস্টমারের হাতেই তাদের পতন ঘটে।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিসিবিকে বাজে ক্যাটেগরিতে রাখা যায় নিশ্চিন্তে। এমনিতেই থার্ড পার্টি ইতিহাসের কারণে আমরা কাস্টমার হিসেবে অ্যাভারেজ শ্রেণির, সেখান থেকে উত্তরণের বদলে বিসিবি ক্রমাগত এংরি কাস্টমারকে খুশি রাখার উদ্যোগ নিতে থাকে।

এবং আদতে কী ঘটে? প্রচুর সংখ্যক অ্যাঙরি কাস্টমার বিসিবির অবৈতনিক মার্কেটিং কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করে। কী করলে বিসিবির লাভ হবে এরকম প্রচুর পরামর্শ। বিসিবি জানে এসব পরামর্শ তাদের বিজনেস এক্সপানশন এবং নতুন কাস্টমার একুইজিশনে সহায়ক হবে, যে কারণে মার্কেটিং কনসালটেন্ট যাতে আরো বৃদ্ধি পায়, তাদের কর্ম্পন্থাও সেই নীতিতে আগায়।

সুপারস্টার ছাড়া বিজনেস হয় না। বাংলাদেশ কাদের বিপক্ষে খেলছে বড়ো কথা নয়, বাংলাদেশের কোনো প্লেয়ার সেঞ্চুরি পেল কিনা বা ৫ উইকেট নিলো কিনা এটাই বিজনেসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আগে বাংলাদেশ জিততো না, কাছাকাছি গিয়ে হারলেও বিজনেস করা যেত। কিন্তু ২০১৫ তে পাশার দান উল্টে গেছে, বাংলাদেশ জিততে শুরু করেছে। এখন যে কোনো মূল্যে জয় চাই, নইলে এংরি কাস্টমারকে বুঝ দেয়া যাবে না।

আরো একটা গোলযোগ ঘটে গেছে। সুপারস্টারের সংখ্যা হয়ে গেছে বেশি, নতুন সুপারস্টার তৈরির যে প্রক্রিয়া সেটা সম্পন্ন হতে কয়েক বছর লেগে যাবে, ততদিনে এখনকার সুপারস্টাররা বুড়িয়ে যাবে। উপায় কী তাহলে?

বাংলাদেশ ‘এ’ দল আফগানিস্তান ‘এ’ দলের বিপক্ষে সিরিজ খেলছে, আয়ারল্যান্ড যাচ্ছে, শ্রীলঙ্গা যাচ্ছে। বিসিবি একাদশ ভারতে খেলছে, এইচপি ইউনিট নিয়ে কাজ হচ্ছে, সবমিলিয়ে ট্যালেন্ট পুলে ৪০+ ক্রিকেটার আছে, তবু আপনার কানে বারবার আসতে থাকবে – ‘আমাদের মানসম্মত ক্রিকেটার নেই।’

দলে সুপারস্টার কম থাকলে বা না থাকলে স্পন্সররা আগ্রহ দেখাবে না সেরকম, ম্যাচের টি আরপি ও কমে যাবে। নতুন প্লেয়ার এলেই তাক লাগানো পারফরম্যান্স দেখাবে, সবার ভাগ্য মুস্তাফিজ- সৌম্যের মতো না-ই হতে পারে। বরং ২-১টা সিরিজ মানিয়ে নিতে সমস্যা হওয়াই সঙ্গত। বিসিবি ভয় পাচ্ছে, এংরি কাস্টমার সেই সুযোগ তাদের দিবে না, যে কোনো মূল্যে ‘জয় চাই’, অথবা ক্লোজ ম্যাচ লাগবে, যেখানে কোনো সুপারস্টার ভালো পারফর্ম করবে।

২০১৫ সাল আদতে বিসিবিকে বিপাকে ফেলে দিয়েছে। জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ডের সাথে খেললে রেটিং পয়েন্ট বাড়বে না, এতে আইসিসির ইভেন্টগুলোতে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হবে, আফগানিস্তানের সাথে খেললেই যে জিতবে তার নিশ্চয়তা নেই, একই কথা প্রযোজ্য শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্ষেত্রেও; করবে টা কী তারা?

বিসিবি প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ভয় পায়, তারা এমনিতেই বিসিবিকে কাস্টমারের সামনে নেতিবাচক চেহারায় উপস্থাপন করে; মিডিয়াকে চটালে অ্যাঙরি কাস্টমার আরো রাগান্বিত হবে।

মাত্র ৭-৮ বছর আগেও তো ক্রিকেট মানে দেশপ্রেম ছিল না, ক্রিকেটাররা নিছক এন্টারটেইনার হিসেবেই পরিচিত ছিল; সেখান থেকে এমন ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটলো কীভাবে!

বাস্তব জীবনে এখনো ক্রিকেট নিয়ে কতক্ষণ কথা বলে মানুষ; এর চাইতে সিনেমা বা নাটক নিয়ে বেশি কথা হয়। তবু অনলাইন ক্রিকেটময় কেন?

এ ব্যাপারে একটা ইন্টারেস্টিং পর্যবেক্ষণ আছে আমার। মাত্র ৩০-৪০ বছর আগেও বাংলাদেশের জীবনযাপনে বৈশ্বিকতা ব্যাপক মাত্রায় কম ছিল। মূলত গ্রাম আর মফস্বল কেন্দ্রিক জীবন যাপনের বড়ো স্বপ্ন ছিল ঢাকায় এসে বসবাস। সেখান থেকে বিগত ২০ বছরে অভিবাসনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে অতিমাত্রায়। উচ্চশিক্ষা আর চাকরিসূত্রে বিদেশ যাওয়া মানুষগুলোর পূর্ব প্রজন্ম এখনো দেশেই থাকে।

তারা দেশ-বিদেশ মিলিয়েই থাকে। তাদের উত্তরপ্রজন্মের দেশানুভূতি একটি রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠবে, কিন্তু মধ্যবর্তী প্রজন্মটি দুই দেশের নাগরিক হওয়ায় তাদের অনেকেরই দেশের সাথে সংযুক্ত থাকার একটি মাধ্যম প্রয়োজন হয়। কেউ লেখালিখি করে, কেউ বিদেশে বসে এখানে কোম্পানী খুলে, কেউ ইউটিউবিং করে, এদেরই একটা অংশ ক্রিকেটকেও ধারণ করে। কারণ বৈশ্বিকতা ব্যাপারটা বাংলাদেশে ক্রিকেটের বাইরে খুব কম এন্টারটেনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতেই আছে।

যারা ক্রিকেট নিয়ে লিখেন অনেকেই দেশের বাইরে থাকেন, কিংবা পড়াশোনা বা চাকরিসূত্রে ভবিষ্যতে বাইরে যাবেন; ১-২ লাইনে স্ট্যাটাস দিওনেয়ালারা মূলত অ্যাঙরি বা অ্যাভারেজ কাস্টমার অথবা সেইসব লেখকের অনুসারী।

বিসিবির প্রসঙ্গে আসি। তাদের পেইড সিইও আছে, বিভিন্ন ফাংশনাল ডিপার্টমেন্ট আছে, এর বাইরে আছে বোর্ড অব ডিরেক্টর, যারা প্রত্যকেই কোনো না কোনোভাবে ক্রিকেটের সাথে সংশ্লিষ্ট। কেউ সংগঠক, কেউ বা প্রাক্তন ক্রিকেটার।।

বাংলাদেশের কান্ট্রি কালচারে ‘বিশেষজ্ঞ’ ধারণাটি অত্যন্ত বুকিশ। কেউ কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হলে তাকে সেই বিষয়ে দীর্ঘ একাডেমিক অভিজ্ঞতা এবং ডিগ্রি থাকতেই হবে। এটা অন্যতম ক্রাইটেরিয়া হতে পারে, কিন্তু ‘একমাত্র’ বানিয়ে ফেললে সেখান থেকে বৈপ্লবিক কিছু আসে না। আপনি দীর্ঘদিনের একাডেমিক অভিজ্ঞতা নিয়েছেন, কিন্তু তাতে আপনার মৌলিক উপলব্ধি এবং পর্যবেক্ষণ কী তা জানেন না, এরকম বিশেষজ্ঞ দিয়ে কোন স্বার্থ উদ্ধার হবে?

বিসিবির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আপনি নির্বাচক হিসেবে তাদেরই রেখেছেন যারা একসময় ক্রিকেট খেলতো। ভালো ক্রিকেটার হলেই সে ভালো ক্রিকেট বিশ্লেষক এবং ট্যালেন্ট চিনতে পারবে সেটা তো অবান্তর চিন্তা। ক্রিকেটের শারীরিক কসরত বা টেকনিকাল অংশটুকু হয়তোবা সে বুঝতে পারবে, কিন্তু ওই ক্রিকেটার মেন্টালি কতটা স্ট্রং, সে কতটা ক্ষিপ্র এবং ক্ষুধার্ত এটা তো পুরোপুরি সফটস্কিল এর অংশ।

নির্বাচক প্যানেলে বিহেভিয়ার বা সাইকিক অ্যানালিস্ট কই? একজন ক্রিকেটার রান করতে পারে বা উইকেট পেতেই পারে, কিন্তু তার মধ্য গ্রোথ মাইন্ডসেট কতটুকু সেই পরীক্ষা না করেই তাকে দলে নিয়ে নিচ্ছেন? এবং কিছুদিন পর বাদও দিয়ে দিলেন!

বাংলাদেশের কতজন সাবেক আর বর্তমান ক্রিকেটার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে সক্ষম বলে ধারণা করেন?

আমাদের শৈশব-কৈশোরে কারা ক্রিকেটার হতো? সাশারণত ডানপিটে বা দুরন্ত প্রকৃতির তরুণেরা যারা একাডেমিক পড়াশোনায় খুব বেশি আগ্রহ বোধ করতো না, ক্রিকেট খেলাটা ছিল নেশার মতো, ব্যক্তিগত জীবনেও ছিল উশৃঙখল প্রকৃতির। ব্যতিক্রম ছিল অবশ্যই, তবে সেই পারসেন্টেজটা কত বড়ো আদতে?

এখন হয়তোবা দৃশ্যপট বদলাচ্ছে, তবু এবারের বিশ্বকাপে অংশ নেয়া ১৫ জন আর বাংলাদেশ ‘এ’, বিসিবি একাদশ এর ২৮ জন সহ মোট ৪৩ জনের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড এবং এলাকায় তাদের ইমপ্রেসন পরীক্ষা করুন, দেখবেন খুব চমকপ্রদ ডেটা পাচ্ছেন না তেমন। বরং সাবেক ক্রিকেটারদের সময়ে ক্রিকেট দিয়ে জীবিকা অর্জনের নিশ্চয়তা কম ছিলো সার্টিফিকেটের দরকার তাদের বেশি ছিল।

তো, এদের পক্ষে কি বিহেভিয়েরাল প্রবণতাগুলো বোঝা সম্ভব? তবু নির্বাচক কমিটিতে এরকম কাউকে রাখার চিন্তা মাথায়ই আসে না।

অন্যদিকে, উপরের টায়ারের দলগুলো আমাদের সাথে কেন খেলবে এটা পুরোপুরি মার্কেটিং গ্রাউন্ডের জিজ্ঞাসা। পাকিস্তান বা ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ পায়, আমরা পাই না কেন?

কারণ, বিসিবি মনে করছে ক্রিকেটের সাথে জড়িত মানুষ মার্কেটিংয়েও এক্সপার্ট হবে।

তবে, এক্ষেত্রে আমার ভিন্ন এন্টারপ্রেটেশন রয়েছে। বিসিবি মার্কেটিংয়ে জোর দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না, কারণ বড়ো দলের সাথে খেললে তাদের বিজনেস উলটো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভারত বা অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৩-০ তে হারলে এংরি কাস্টমারের যে প্রতিক্রিয়া, সে তুলনায় শ্রীলংকা বা উইন্ডিজের বিপক্ষে ২-১ এ সিরিজ জেতা বেশি আনন্দের। ২০১৫ বিসিবিকে আরো বেশি নার্ভাস বানিয়ে দিয়েছে।

ভারত সেমিফাইনালে উঠা সত্ত্বেও কোহলিকে সীমিত ওভারের অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার চিন্তা করছে পত্রিকা মারফত জানলাম। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা সফরেও বিশ্বকাপের দলটিই খেলতে যাচ্ছে।

পরিকল্পনার পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়নি, তাই দলে বড়ো রদবদল হয়নি, এই ভাবনা থেকে বিসিবিকে বেনিফিট অব ডাউট দিতে চাই। কিন্তু ২ মাস পরে মাশরাফির বিদায়ী সিরজের দলেও প্রায়ই একই সদস্যেরা থেকে যাবে; আপত্তিটা এখানেই।

প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণে ইংল্যান্ডের পরিকল্পনার ভূয়সী প্রশংসা করলো, তারা ২০১৫ বিশ্বকাপের দল থেকে ৯ জনকে বাদ দিয়েছে, আরো কত কি! এটাকে আমি বলবো, ঝি কে মেরে বৌ কে শেখানো। ঠারেঠুরে বুঝানো, বিসিবিরও উচিত সেই পথে হাঁটা।

কিংবা আমার ফ্রেন্ডলিস্টে বহু টিভি চ্যানেল আর সংবাদপত্রের সাংবাদিক রয়েছেন, যারা স্পোর্টস বিভাগে কাজ করেন; তাদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে বিসিবির নীতির সমালোচনা করেন।

কিন্তু প্রথম আলো বা কালের কণ্ঠ দায়িত্ব নিয়ে লিখলো না, বা এনটিভি-চ্যানেল আই- একাত্তরে কেউ বললো না তামিমদের প্রজন্মের সামর্থ্য এটুকুই ছিল, পরের লেভেলে যাওয়ার জন্য যে সাহস-উদ্দীপনার প্রয়োজন সেই বয়স-ফিটনেস এবং সামর্থ্য তাদের নেই, এখন সময় হয়েছে তাদের টেস্টে সুযোগ করে দেয়ার।

কিন্তু, ২০১৬ সালে মাশরাফির অবসর বিষয়ে কলাম লিখে উৎপল শুভ্র যেরকম নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন সোস্যাল মিডিয়ায় বা সাকিবের ফটোশুটে না থাকার সমালোচনা করায় নোমান মোহাম্মদ যেরকম বুলিংয়ের শিকার হয়েছিলেন, সেই সামাজিক নিরাপত্তার কারণেও হয়তোবা ক্রিকেটারদের সমালোচনা লেখার সাহস করছেন না। তার চাইতে ক্রিকেটারদের সাথে খাওয়া-দাওয়ার ছবি তুললে ভাইরাল হওয়া সহজ সাংবাদিকদের জন্য; সেটাই বরং ভালো।

কোনো সাংবাদিক যদি লিখে ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক সাকিবের পরিবর্তে মোসাদ্দেক বা সৌম্য-লিটনের কাউকে করা হোক, মানুষ বলবে ওরা তো দলেই নিয়মিত না, পারফরম্যান্সই বা কী এমন! তারুণ্যনির্ভর দল নিয়ে বিপদে পড়বেন নাকি!

অথচ আফিফ, ইয়াসির, ইবাদত, নাঈম বাদে কাউকেই তরুণ বলার সুযোগ নেই, প্রত্যেকের ক্যারিয়ার ৩ বছর বা তার বেশি; তবুও তরুণ?

বিসিবি বরং অতীতে আরো সাহসী ছিল। দুর্জয় যদি আকরাম, বুলবুলের অধিনায়ক হতে পারে, সাকিব যদি হতে পারে আশরাফুল-মাশরাফি-রাজ্জাকের, তবে সৌম্য-লিটন বা মোসাদ্দেক কেন সাকিব, মুশফিকের অধিনায়ক হতে পারবে না?

সাকিব যখন প্রথম মেয়াদে অধিনায়ক হয়েছিল (সহ অধিনায়ক থেকে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক) তখন তাঁর বয়স কত ছিল? তখনো সে নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডার হয়নি, স্মরণীয় পারফরম্যান্সও তুলনামূলক কম। সৌম্য-লিটন বা মোসাদ্দেকের বর্তমান বয়স তো তার চাইতে বেশি। কিংবা মুশফিক যখন অধিনায়কত্ব পায়, খুব কি ডাকাবুকো পারফরমার ছিল সে?

৩৫+ অধিনায়ক নিয়ে খেলতে গেলে পরিণতি কী হতে পারে হাতে-কলমে প্রমাণ পেয়েও কি শিক্ষা হবে না?

মোসাদ্দেকের খেলার স্টাইল যেমনই হোক, ফার্স্ট ক্লাসের গড় দিয়েই বোঝা যায় তার ক্যালিবার কেমন। সে মূলত ৪-৫ এর ব্যাটসম্যান, ক্রমাগত খেলিয়ে যাচ্ছেন ৭এ, অন্যদিকে মিঠুন একজন পিওর স্লগার তাকে খেলাচ্ছেন ৫ এ; এই নীতির ব্যাখ্যা কী?

আচমকাই বিসিবি এমন রক্ষণাত্মক হলো কেন? ২০১৫ এর রূপকথা কি আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে?

গোপন ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে অনেক বখাটে যেমন দিনের পর দিন প্রতারণা চালায়, বাংলাদেশের ক্রিকেটে ২০১৫ এখন সেই জায়গায় চলে গেছে; এংরি কাস্টমারের ভয়ে জনপ্রিয়তাই হয়েছে মূল চাওয়া।

কিন্তু অ্যাঙরি কাস্টমারের বাইরে লয়্যাল কাস্টমারও তো আছে সংখ্যায় নগণ্য হলেও। তারাই লিখে বেশি, তাদের প্রভাবে অ্যাংরি কাস্টমারদের কোনঠাসা করে রাখা কঠিন হবে না। জিতলেও বাংলাদেশ, হারলেও বাংলাদেশ গোষ্ঠীটি সবচাইত্ব ক্ষতিকর, এরা এভারেজ কাস্টমার যারা মোসাহেবি আর তাবেদারির বাইরে গ্রোথে কোনো অবদানই রাখতে পারে না।

বিসিবির তাই মোটিভেশন প্রয়োজন। শিব খেরা, ডেল কার্নেগি, স্টিভেন কোভি, নিক ভুইসিক থেকে শুরু করে সোলায়মান সুখন, আয়মান সাদিক, সুশান্ত পাল সহ যেখানে যত মোটিভেশনাল স্পিকার আর লেখকদের নিয়ে বিসিবিতে সেশন আয়োজন করা হোক। তাদের বিশ্বাস করাতেই হবে, ‘এই হার হার নয় আরো হার আছে, এই হারেরে নিবো আমরা বিশ্বজয়ের কাছে!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link