‘আরেকটি’ বিশ্ব জয়ের দিন

বেশিরভাগ ভারতীয় ক্রিকেট দর্শকের কাছে ২৫ জুন বা ২ এপ্রিলের গুরুত্বই আলাদা। বিষয়টা খুব স্বাভাবিক। এই দুই দিনকে কোনোভাবে ছোট করার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এই দুই অবিস্মরণীয় দিনের পাশে কোথাও যেন একটু হলেও মলিন হয়ে পড়ে থাকে ‘১০ মার্চ, ১৯৮৫’।

না, এটা কোন বিশ্বকাপ জয়ের দিন নয়, তবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার দিন তো অবশ্যই। বেনসন অ্যান্ড হেইজেস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়শিপ অব ক্রিকেট জিতেছিল সেদিন ভারত। বিশ্বের সমস্ত টেস্ট খেলুড়ে দেশ যেখানে অংশগ্রহণ করেছিল এবং অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতের প্রথম বড় মাপের সাফল্য।

ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় হাতে এসে পড়েছিল সুনীল গাভাস্কারের ‘one day wonders’। পুরো বইটা জুড়ে যেন নিখুঁত হাতে প্রতিটা ম্যাচের ছবি আঁকা ছিল, যা পশ্চিম বাংলার গ্রামে বসে থাকা এক কিশোরকে মুহূর্তে পৌঁছে দিয়েছিল ১৯৮৫ সালের মেলবোর্নে।

মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় দিন-রাতের ম্যাচ। রাতটা রাঙিয়ে দিলো ওই লিকলিকে রোগা হায়দ্রাবাদি ব্যাটসম্যানটি, যিনি কিনা কয়েকদিন আগে জীবনের প্রথম তিন টেস্টে তিনটি সেঞ্চুরি করে এসেছেন। এবার তিনি মেলবোর্নের মায়াবী আলোর নিচে ইমরান, মুদাসসার নজর, ওয়াসিম আকরামকে পিটিয়ে ঝঁকঝকে ৯৩ রানের ইনিংস খেলে বুঝিয়ে দিলেন যে সত্যি তিনি রাজ করতে এসেছেন।

তার আগে বিনির দাপটে পাকিস্তান ১৮৩ রানে অল আউট। এরপর ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়াকে হেলায় হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে সানির টিম। সেমিফাইনালেও নিউজিল্যান্ডকে হারাতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি ভারতীয় দলকে।

একটা অসাধারণ দলগত পারফরমেন্সের নমুনা তুলে ধরেছিল ভারতীয় দল পুরো প্রতিযোগিতা জুড়ে। বোলিংয়ে কপিল, বিনিকে যথাযথ সহযোগিতা করে গেছে শাস্ত্রী আর লক্ষণ শিবরামকৃষ্ণান, শেষ দু’জনের তো ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সিরিজ এটা। বোলিং ইউনিটটা কতটা সফল ছিল তা দুটো বিষয় থেকে বোঝা যায়।

প্রথমত পুরো প্রতিযোগিতায় খেলা পাঁচটা ম্যাচে বিপক্ষের ৫০ টা উইকেটের মধ্যে ভারতীয় দল ৪৯ টা উইকেট তুলে নেয়। একমাত্র ফাইনালে পাকিস্তানকে অল আউট করতে পারেনি। আর দ্বিতীয়ত পুরো প্রতিযোগিতায় একমাত্র সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ড ভারতীয় বোলিংয়ের বিরুদ্ধে ২০০’র বেশি রান তুলতে সক্ষম হয়। বাকি সব ম্যাচেই বিপক্ষের ইনিংস ২০০’র নিচে শেষ হয়।

ব্যাটিংয়ে তেমন শ্রীকান্ত, শাস্ত্রীর সঙ্গে আজহার-ভেঙসরকারের ধারাবাহিক রান পাওয়া আর প্রয়োজনে গাভাস্কার, কপিলের বিশ্বস্ত সহযোগিতা কাজটা সহজ করে দেয়। তবে বর্তমান ভারতীয় দলের কোচ তাঁর জীবনের সেরা ফর্মে ছিলেন যা তাঁকে চ্যাম্পিয়ন অফ চ্যাম্পিয়ন্স করে তোলে। আর একজনের কথা না বললেই নয়, উইকেটের পেছনে সদানন্দ বিশ্বনাথ। তাঁর ও স্বল্প দৈর্ঘ্যের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এটাই সবচেয়ে ছিল সবচেয়ে উল্ল্যেখযোগ্য পারফরম্যান্স।

ভারত ১৯৮৩-তে বিশ্বকাপ জিতলেও, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে উপমহাদেশের আধিপত্যের শুরু হয় এখান থেকেই। প্রথমবারের জন্য বহুদলীয় প্রতিযোগিতার ফাইনালে খেলতে নামে ভারত এবং পাকিস্তান। যে কারণে ফাইনালের আগের সন্ধ্যাতে কোনো এক ব্রিটিশ বা অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্টভাষী গাভাস্কার জানিয়ে দেন যে ফাইনালের বিষয় তাঁদের না ভাবলেও চলবে, উপমহাদেশের দুই দল যখন ফাইনালে উঠেছে তখন ফাইনাল নিয়ে তাদের বেশি উৎসাহ না দেখানোই ভালো।

দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ফাইনালটাও ছিল অসাধারণ। প্রথমে বাট করতে নামা পাকিস্তান শুরুতেই ৩০ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বেকায়দায় পড়ে যায় কপিলের দাপটে। তারপর সেই জায়গা থেকে কি করে লড়াইয়ে ফিরতে হয়, সেটা করে দেখান পাকিস্তান ক্রিকেটের দুই প্রকৃত যোদ্ধা, জাভেদ মিয়াদাদ এবং ইমরান খান।

হয়তো দুজনে মিলে ম্যাচটা বের করেই নিয়ে যেতেন যদি না ওই মোক্ষম সময়ে পয়েন্ট থেকে গাভাস্করের থ্রো টা উড়ে আসতো আর শিবা-বিশ্বনাথের অনবদ্য কম্বিনেশন জাভেদকে প্যাভিলিয়নে পাঠাতো। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের ইনিংস ১৭৬ রানে শেষ হয়।

২০০৩ সালে সেঞ্চুরিয়নের লাঞ্চ টেবিলে কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটলেও ৮৫’র মেলবোর্নের ডিনার টেবিলে এমন কিছু ঘটেনি। বরং সেখানে বল করতে নামার আগে ইমরানের খাওয়ার পরিমান দেখে হতবাক হয়ে গেছিলেন সানি। যাই হোক শাস্ত্রী, শ্রীকান্তের ডিনার কিন্তু ডিনার টেবিলে শেষ হয়নি, মাঠে নেমেও তাঁরা রান পিকনিকে মেতে ওঠেন।

দলের ১০৩ রানের মাথায় শ্রীকান্ত যখন আউট হন তখন ভারতের জয় অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গেছে। বাকি কাজটা শাস্ত্রী মহাশয় আজহার আর ভেঙ্গসরকারকে সঙ্গে নিয়ে করে নেন। সম্পূর্ন হয় ভারতীয় ক্রিকেটের দ্বিতীয় বিশ্বজয়।

মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে দুই ভিন্ন পরিবেশে দু’বার এভাবে বিশ্বজয় আজকের ভারতীয় ক্রিকেটের ভিতকে শুধু মজবুতই করেনি পরবর্তী প্রজন্মকে ক্রিকেটমুখি করেছে। ৮৩-তে কপিলের হাত ধরে ভারতীয় ক্রিকেটে যে জোয়ার আসে লর্ডসের মাটিতে, ৮৫’র এই সাফল্য সেই জোয়ারের স্রোতটাকে ধরে রাখতে সাহায্য করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link