সাফল্যের সংজ্ঞাটা খুব অদ্ভুত। কেউ কেউ সারাজীবন দুর্দান্ত পারফরমেন্স দিয়েও তা থেকে বঞ্চিত থাকে। কেউ পায় খুব দেরিতে, শেষ পর্যায়ে এসে তার হাতে লেখা থাকে সোনালী স্বপ্নের মুহূর্ত। কিন্তু কেউ পায় অভাবনীয়ভাবে, অত্যাশ্চর্য সাফল্যের মুখ দেখে ফেলে কোনও রকম প্রত্যাশা ছাড়াই। তাঁদের লড়াইটা বাকি সবার থেকে আলাদা।
তাঁরা কখনও জিততে আসে না, আর হারলেও তাদের কিছু এসে যায় না। অর্থাৎ জেতা-হারার এই বড় প্যারাডাইমের মধ্যে তারা কার্যত ঢুকতেই চায় না। শুধু দর্শকের জন্য, নিজের ভাল লাগা থেকে পারফর্ম করে বেরিয়ে যায়। কোনওরকম প্রত্যাশা, প্রেসার ছাড়াই। প্রকৃতিদেবী বোধহয় তাদের গলাতেই জয়ের মেডেল পরিয়ে দেন, যারা শুধুই পারফর্ম করতে আসে।
১৯৮৩-র বিশ্বকাপে যে কাজে রত ছিল ভারত। না ছিল তাদের জেতার দৃঢ় সংকল্প, না ছিল হারের ভয়। কাজেই তারা নির্দ্বিধায় খেলে গেছে। সেরকমই ছিল ১৯৯২-র ডেনমার্ক। তাবড় দলগুলির কাছে তারা ছিল স্বভাবতই আন্ডারডগ। শুধু ফুটবল খেলতে এসেছিল তারা। আর শেষে হয়েছিল ইউরোপের সেরা!
খুব অদ্ভুতভাবে ডেনমার্ক সে বছর চান্স পেয়েছিল। প্রথমত, তাদের সে ইউরো কাপটা খেলারই কথা নয়। যোগ্যতা অর্জন পর্বে গ্রুপ ৪-এ তারা হয়েছিল দ্বিতীয়। প্রথা অনুযায়ী গ্রুপের সেরা দলটাই ইউরোর আসরে ঠাঁই পেত। আর সে দেশ ছিল যুগোস্লাভিয়া। কিন্তু বিধি বাম!
বসনিয়ার সাথে গৃহযুদ্ধের জন্য যুগোস্লাভিয়ার খেলা হয়নি। উপরন্তু একজন বসনিয়ান গোলকিপারও লুকিয়ে সুইডেন উড়ে গেছিল, ফলে সরকার যুগোস্লাভিয়ার উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ইউরো খেলার ছাড়পত্র দিল না। যোগ্যতা অর্জন পর্বে গ্রুপে সেরা হয়েও যুগোস্লাভিয়ার ইউরো কাপ খেলা হল না।
দ্বিতীয় হিসেবে ইউরো খেলার ছাড়পত্র পেল ডেনমার্ক, আর এই সুযোগকেই সোনায় সোহাগা ক’রে সুইডেনে পাড়ি দিল রিচার্ড মলার-নিয়েলসনের দল। আটটা টিমে খেলা, তাদের সঙ্গে ইংল্যান্ড, সুইডেন এবং ফ্রান্স। প্রত্যেকেই নিজের শক্তি অনুযায়ী সে ইউরোতে ফেভারিট। তবু, যার জেতা-হারার ভয় নেই, কিছু পাওয়ার জন্য যারা খেলতে আসেনি, সে হারকিউলিসদের রোখে কার সাধ্যি।
গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ডেনমার্ক ইংল্যান্ডের সাথে ড্র করে দ্বিতীয় ম্যাচেই হারের মুখ দেখল। সুইডেনের কাছে পরাজিত হল। আর এর পরের ম্যাচেই ঘটাল অঘটন! প্লাতিনির প্রশিক্ষণাধীন ফ্রান্সকে ২-১ গোলে হারিয়ে দিল। সুইডেনের মালমো স্টেডিয়ামে জেগে উঠল আন্ডারডগরা।
গোটা ইউরোতে ডেনমার্কের খেলা ছিল মূলত মাঝমাঠ নির্ভর। যেখানে প্রধান কাজ ছিল একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এবং দু’পাশে দুই উইঙ্গারের। হেনরিক লারসেন, কিম ভিলফোর্ট ছিলেন সে কাজে। উপরে ব্রায়ান লাওড্রুপকে ক্রমাগত বল সাপ্লাই ক’রে যাওয়া যাদের প্রধান কাজ ছিল। গোটা টুর্নামেন্টে কখনও একটু নিচ থেকে, কখনও সাইডে, কখনও আপলাইনে অপারেট করে যান এই লাওড্রুপ।
মাঝেমধ্যেই, ভিলফোর্ট বল ধরে মাঝমাঠে অপারেট করতে শুরু করলে চকিতে উপর থেকে নিচে একজন অপনেন্ট ডিফেন্ডারকে টেনে নিয়ে আসেন লাওড্রুপ, ফলে আপফ্রন্টে অনেকটা স্পেস খুলে যায়। এবার মাঝখান থেকে সোজা ডি বক্সে পৌঁছে গোল করে আসেন হেনরিক লারসন। সারা টুর্নামেন্টে ৩টে গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার নিয়ে যান লারসন।
এইভাবে তাঁরা হারিয়েছিল নেদারল্যান্ডসকেও। যদিও তাঁদের দলে ডেনিস বার্গক্যাম্প বলে এক বিশ্বত্রাস স্ট্রাইকার ছিল, ছিল মার্ক ভান বাস্তেন, ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড, রোনাল্ড ক্যোমানের মত খেলোয়াড়। নেদারল্যান্ডস তার আগের ইউরো কাপও জিতেছিল।
ফলে ধারেভারে অনেকটাই এগিয়ে থাকা হল্যাণ্ডের কাছে তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকা ডেনমার্কের শুরুটা হয়েছিল স্বপ্নের মত। দু’বারই লারসনের গোলে এগিয়ে যায় ডেনমার্ক। শেষে পেনাল্টিতে সবাই গোল করলেও, মিস করেন বাস্তেন। ডেনমার্কের সাথে ফাইনালে দেখা হয় জার্মানির!
অতি বড় ড্যানিশও স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি, দু’বছর আগের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে হারিয়ে ইউরো কাপে চুম্বন করবে ডেনমার্ক! লোথার ম্যাথাউস না থাকায় মাঝ মাঠ হয়ত একটু ধারেভারে কম হয়েছিল জার্মানির, তবু আন্দ্রেয়াস ব্রেহমে, যুরগেন ক্লিন্সম্যান তো ছিলেন! একটা সময় ক্লিন্সম্যানের একটা অনবদ্য প্রচেষ্টা থামিয়ে দিলেন স্কিমিচেল।
এই পিটার স্কিমিচেলের কথা না বললে ডেনমার্কের ইউরো জয়ের গল্প অসমাপ্ত থেকে যায়। গোটা টুর্নামেন্টে গোলের নিচে অতন্দ্র প্রহরীর মত ঠায় গোলরক্ষা করে গেছেন পিটার স্কিমিচেল। যিনি তার পরবর্তী জীবনে ম্যান ইউ লেজেন্ডের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন।
ডেনমার্ক ফাইনালে কাপ তুলল। গোল করার তালিকায় সেই কিম ভিলফোর্ট। যাদের কোনও স্বপ্ন ছিল না, কোনও প্রত্যাশা ছিল না। চোখে ছিল শুধু ফুটবল খেলার স্বপ্ন। কেন্ট নিয়েলসন এবং জেনসন টিকিট কেটে রেখেছিলেন, গ্রুপ লিগ সেরে বাড়ি ফিরবেন বলে। ভারতের বিশ্বজয়ের গল্পের সঙ্গে কী অদ্ভুত মিল, না! গোটা ইউরোপকে কার্যত হতবাক করে ভিকট্রি ল্যাপে সামিল হয়েছিল ঐ লাল-সাদা জার্সি পরা এগারোটা যোদ্ধা।
সূর্যাস্তের আগেই যারা সূর্যোদয় দেখিয়ে দিয়ে গেছিল ইউরোপকে। দেখিয়েছিল, প্রত্যাশার পারদ ঘাড় থেকে নামালে পৃথিবীতে কোনওকিছুই অসম্ভব নয়। কিম ভিলফোর্টের কথাটাই যার প্রমাণ – ‘we played without nerves, because thought were going home!’
১৯৯২-র ইউরো কাপ, ইউরোপে নতুন সূর্যোদয়ের নামান্তর।