সেই দিন লঙ্কার দিন

জীবনের যা কিছুই প্রথম তা সবসময়ই বেশ একটা দাগ ফেলে যায় স্মৃতির পাতায়। সে প্রথম স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে প্রথম প্রেম, প্রথম চাকরি কিংবা প্রথম জয়। আলাদা এক মাহাত্ম থাকে এই সব প্রথমের। আর ক্রিকেটের বিরুপ কন্ডিশনে টেস্ট জেতাটার মাহাত্ম তো আরও অনেক বেশি। সে সাথে যদি তা হয় বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয় তাহলে তা নিয়ে বারংবার স্মৃতি রোমন্থন করা যায়।

এমন একটা দিন ১৫ মার্চ ১৯৯৫ সাল। দিনটা অবশ্য শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের। সেদিন তো প্রথমবারের মত ঘরের বাইরে টেস্ট জেতার স্বাদটা পেয়েছিল লংকানরা। তাও আবার তাঁদের সেরা তারকা চামিন্দা ভাসের হাত ধরে। সে কি এক অভূতপূর্ব এক দিনটাই না কেঁটেছিলো তাঁদের। পাঁচ দিনের লড়াইয়ের পর এক প্রশান্তি।

প্রথমবারের মত ঘরের বাইরে টেস্ট জেতার আরও প্রায় এক যুগ আগে টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিল লংকানরা। ক্রিকেটের এই বনেদী ফরম্যাটে ৩২টি ম্যাচ খেলেও যেন তখনও শিশু শ্রীলঙ্কা। নিউজিল্যান্ডের মত কন্ডিশনে টেস্ট খেলতে গিয়েছিলো সে দেশের নেপিয়ারে। ঘাসের বাউন্সি উইকেটে শ্রীলঙ্কা বিন্দুমাত্র পাত্তা পাবে না এটাই হয়ত ভেবেছিল সবাই। কিন্তু গোল এই পৃথিবীর যে পুরোটাই এক মস্ত বড় গোলক ধাঁধাঁ।

ম্যাচ শুরু হয়ে ১১ মার্চ। অতিথিয়দের সিরিজের প্রথম টেস্টেই টস জিতে ব্যাট করতে পাঠায় ব্ল্যাকক্যাপসরা। যেমনটা সবাই ভেবেছিল তাই হল প্রথম ইনিংসে। বাইশ গজে টিকে থাকা দায় হয়ে যায় লংকানদের। সর্বোচ্চ রান করেন অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা। তাও আবার ৫৫। তাঁর সেই অর্ধশতকের সঙ্গ দিতে পারেনি কোন ব্যাটার। মোটে ১৮৩ রান জড়ো করে শ্রীলঙ্কা।

প্রথম ইনিংসেই এত স্বল্প রান যেন নিউজিল্যান্ডের ব্যাটারদের খানিক স্বস্তি দিচ্ছিলো। তবে তাদেরকে আর স্বস্তিতে রাখতে চাইছিলেন না চামিন্দা ভাস। তিনি একেবারে গোটা ক্রিকেট দুনিয়াকে হতভম্ব করে দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালান নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপে। ২১ বছর বয়সী এক তরুণ। তবে অভিজ্ঞতা মোটে চার ম্যাচের। সেই তরুণেই সেদিন বধ হয়েছিলো নিউজিল্যান্ড।

ব্ল্যাকক্যাপস ব্যাটারদের পাঁচটি উইকেট নিজের ঝুলিতে পুরে নেন চামিন্দা ভাস। তাঁর সাথে সঙ্গ দেন প্রমধ্য উইক্রামাসিংহ ও রবীন্দ্র পুষ্পাকুমারা। দুইজনে উইকেট নেন যথাক্রমে তিন ও দুইটি করে। যার ফলে মাত্র ১০৯ রানেই গুটিয়ে যায় নিউজিল্যান্ডের ইনিংস। কেউ কি এমনটা হবে ভেবেছিল? নিশ্চয়ই ভাবেনি। কি ভেলকি দেখিয়ে দিলেন লংকান বোলাররা!

ভেলকির তখনও বেশ খানিকটা বাকি। যেহেতু অল্প রানেই দু’দল আটকে গিয়েছিল প্রথম ইনিংসে সেহেতু টেস্ট দ্রুতই শেষ হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা জেগেছিল। তা আর হল না। লংকান ব্যাটাররা তা আর এবার হতে দিলেন না। নিজেদের ভুল শুধরে নিয়ে রান করে গেলেন। আগে থেকেই ৭৪ রানের একটা লিড নিয়ে খেলতে শুরু করেন দ্বিতীয় ইনিংস।

তবে শুরুতেই ধাক্কা। ২২ রান যোগ করতেই নেই তিন উইকেট। খানিকটা ব্যাকফুটে চলে যায় লংকানরা। তবে বিপর্যয় সামলে নেন অরবিন্দ ডি সিলভা ও হাসান তিলাকারত্নে। দুজনে মিলে ৯৯ রানের জুঁটি গড়ে তোলেন। ৬২ রানে অরবিন্দের বিদায়ের পর অর্জুনাও ফিরে যান মাত্র ২৮ রান করে। দলীয় রান যখন ২০৫ তখন ৭৪ রান করা হাসান হাঁটা শুরু করেন প্যাভিলনের দিকে।

স্বীকৃত ব্যাটার হিসেবে তখন কেবল বাকি সে ম্যাচেই অভিষেক হওয়া উইকেট-রক্ষক ব্যাটার চামারা দুনুসিংহে। তাঁকে দলের ইনিংসটা টেনে নিয়ে যেতে হতো বাকি থাকা চার বোলারকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি তাঁর কাজটা বেশ ভালভাবেই করলেন। তাঁকে সাহস জুগিয়ে পাশে রইলেন প্রথম ইনিংসে ফাইফার পাওয়া চামিন্দা ভাস। দু’জনে মিলে জড়ো করলেন ৮৯ রান। তরুণ ভাসের ব্যাট থেকে এলো গুরুত্বপূর্ণ ৩৩ রান।

ভাস আউট হয়ে গেলেও রানের চাকা সচল রাখেন চামারা। ৯১ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে চামারা আউট হলে শ্রীলঙ্কার লেজ গুটিয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তবে স্বস্তির বিষয় ততক্ষণে বোর্ডে রান উঠেছে ৩৫২। যার সুবাদে নিউজিল্যান্ডকে ৪২৭ রানের পাহাড়সম এক টার্গেট ছুঁড়ে দেয় অর্জুনার সতীর্থরা। বিশাল রান পাহাড় ডিঙিয়ে জয় নিয়ে ফেরাটা কঠিন।

সে কঠিন কাজটাকে আরও কঠিন করে তোলেন চামিন্দা ভাস আর মুত্তিয়া মুরালিধরনের মত বোলাররা। নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে দশটি উইকেট সমানভাবে ভাগ করে নেন ভাস ও মুরালিধরন। পাঁচটি করে উইকেট নিজেদের নামের পাশে যুক্ত করে নেন। তবে এর আগে বেশ শক্তপোক্ত এক অবস্থানে ছিল নিউজিল্যান্ড।

১০৮ রানে কেবল একটি উইকেটের পতন হয়েছিল তাঁদের। কিন্তু তখনও ভাস-মুরালিদের ‘ম্যাজিক শো’ বাকি। দুইজনের বোলিং তোপে মাত্র ১৮৫ রানেই থেমে যায় ব্ল্যাকক্যাপসরা। বিদেশের মাটিতে প্রথম জয়ের স্বাদটা যেন আরও বেড়ে যায় ২৪১ রানের বিশাল এক জয়ে। যেখানে মাঠে নামার আগে অবধি আন্ডারডগ ছিল শ্রীলঙ্কা।

তবে তরুণ চামিন্দা ভাসের দশ উইকেটের বদৌলতে অ্যাওয়ে কন্ডিশনে প্রথম জয়। নিজের পঞ্চম ম্যাচেই ম্যাচ সেরা পুরষ্কারটা জিতে নিয়েছিলেন চামিন্দা ভাস। এরপর থেকে তো রীতিমত তিনি লংকান ক্রিকেটের রেকর্ড বইয়ে নিয়মিত অভিযাত্রী। নেপিয়ারে জেতানো চামিন্দা আজীবন কিংবদন্তি হয়ে রইলেন লংকান ক্রিকেটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link