লেখার সাথে এই গল্পের সামঞ্জস্য খুব একটা নেই, তবুও আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগের টেস্ট ম্যাচের গল্পটা না বললেই নয়। বাংলাদেশ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট ম্যাচ চলছে মিরপুরে। প্রথম দিন ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ। রান খুব একটা বেশি না হলেও মেঘলা দিনে স্টেইন-মরকেলের বিপক্ষে বেশ ভালোই।
প্রথম দিন শেষ হওয়ার ঘন্টাখানেক আগে ব্যাটিংয়ে নামলেন নাসির হোসেন। হাতে উইকেট বেশি নেই, যত রান স্কোরবোর্ডে তোলা যায় আর কী! দিনের শেষ অংশটা ভালোভাবে কাটিয়ে ফিরলেন ড্রেসিংরুমে। মাথা ভর্তি চিন্তা, পরের দুই উইকেটে মুস্তাফিজ আর লিখনকে নিয়ে কী করবেন তিনি। এই প্ল্যান করতে করতেই হয়তো হোটেলের বালিশে মাথা রেখেছিলেন নাসির। কিন্তু সকাল বেলা উঠে দেখলেন এ কী, বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে পুরো শহর।
দ্বিতীয় দিন গেল, তৃতীয় দিন গেল এমনকি চতুর্থ দিন গেল; শ্রাবণের মেঘগুলো আকাশ থেকে সরবার বিন্দুমাত্র নাম নেই। পঞ্চম দিনে এসে যখন শেষমেশ সূর্য্যি মামার দেখা মিলল, ততক্ষণে খবর আসল এই মাঠে আর যাই হোক, খেলা সম্ভব না। সেবার বৃষ্টিস্নাত রাস্তায় পাড়ার বাচ্চাদের সাথে ফুটবল খেলে বেশ নাম কামিয়েছিলেন হাশিম আমলা, ডেল স্টেইনরা। আর এই অদ্ভুত তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন নাসির। প্রতিদিন রাতে ব্যাটিংয়ের প্ল্যান নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া তো আর কম কষ্টের কাজ নয়।
তবে আজকের গল্প এদের কাউকে নিয়েই নয়, বরং স্টুয়ার্ট ব্রডের করা রেকর্ড আর তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে। হাজার হলেও ঐতিহ্যবাহী ‘ফাইভ হান্ড্রেড ক্লাব’-এর নতুন সদস্য তিনি। ২৭ জুলাই রাতে দিনের শেষ উইকেট নিয়ে যখন মাঠ ছাড়ছিলেন তখন ব্রডেরও নাসির হোসেনের মতো অনুভূতি হয়েছিল কী-না জানা নেই। তবে নাসির হোসেন সে ম্যাচে এত কিছুর পরেও ব্যাটিং পাননি, কিন্তু স্টুয়ার্ট ব্রড ঠিকই আগের দিনের ৪৯৯ উইকেটকে ৫০০-তে পরিণত করতে পেরেছেন। সাদা জার্সিতে ৫০০ উইকেট নেওয়ার গল্পটা কম বড় নয়। নইলে এত সমৃদ্ধ ইতিহাসে কিনা এই তালিকায় নাম মাত্র ৭ জনের?
সাদা জার্সির খেলা ক্রিকেটের আভিজাত্যের লড়াই। মেলবোর্নে দেড়শ বছর আগে শুরু হয়েছিল ‘দ্যা জেন্টেলম্যানস গেম’। তখন ইংলিশ আর অস্ট্রেলিয়ানরা দাঁপিয়ে বেড়াতো ক্রিকেট মাঠ। এলিট শ্রেণির খেলা বলে, অন্যদের সুযোগই দেওয়া হতো না। এক যুগ পরে ক্রিকেটের সাদা দুনিয়ায় যোগ দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। চাইলে যেকোনো দেশ মাঠে নেমে ২০ ওভারের খেলা খেলে ফেলতে পারে। সন্ধ্যার পর শুরু হয়ে মধ্যরাতের আগেই শেষ হয়ে যায় গল্প। কিংবা ৫০ ওভারের একদিনের ম্যাচ।
সকালে শুরু হলে সন্ধ্যা, আর বিকেলে শুরু হলে মধ্যরাতের আগেই দম ফুরায় সে ক্রিকেটের। কিন্তু টেস্টে? টেস্ট এখনও সেই একই ‘টেস্ট’ সকলের জন্য। টেস্ট খেলতে শুধু ব্যাট, বল আর স্কিল থাকলেই হয় না। টেস্ট ক্রিকেটকে অনন্য করেছে এর টানা পাঁচ দিন খেলার ধৈর্য্য। যে কারণেই মাত্র ১২ দলের সম্মান হয়েছে ব্লেজারের সাথে সাদা জার্সি পরবার। যে কারণে রেকর্ডের লিস্টিটাও বড্ড ছোট।
টেস্টের কথা উঠলেই বারংবার উঠে আসে মেন্টালিটির কথা, কথা উঠে ব্যাটসম্যানদের গল্প; ধৈর্য্য ধরে টিকে থাকা, নিজের ধৈর্যচ্যুতি না হওয়া আরও কত কী? অথচ টেস্ট ক্রিকেটের সূচনাই হয়েছে ব্যাটসম্যানদের কথা মাথায় রেখে। বোলারদের ধৈর্য্য ঠিক তৈরি হয়েছে তার বিপরীত দিক থেকে। ব্যাটসম্যানদের মতন ধৈর্য্য নিয়ে পরে থাকলেই চলবে না, পাঁচ দিনে যতবার একটা জুটি তৈরি হবে, তা ভাঙ্গতে নিত্য নতুন ম্যাজিক বের করতে হবে।
সবটায় ফল আসবে না; না হলে নতুন করে শুরু করতে হবে, ধৈর্যচ্যুতি গল্প। ব্যাটসম্যানদের থেকে তাই বোলারদের লড়াইটা ভিন্ন, বড্ড কঠিন। ব্যাট হাতে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেই হয় না, বরং বল করে দৌড়ে ফিরতে হয়। বোলিংয়ের পরের সময়টা ফিল্ডিংও করতে হয় চড়া রোদের মধ্যে। যে কারণেই কী-না বোলারদের গল্পটাও খুব একটা বড় হয় না। কিন্তু এ গল্প তাঁদের লড়াইয়ে সব ভেঙে এগোনোর।
প্রথমেই বলে রাখি, ক্রিকেটের প্রথম ১২৩ বছরে এই রেকর্ডে পা রাখতে পারেনি কেউই। উনিশ শতকের শেষ থেকে ২০০০ পর্যন্ত কারো পক্ষে ৫০০ উইকেট ছোঁয়া সম্ভবই হয়নি। তবে সব অসম্ভব কোনো একদিন সম্ভব হয়। বিশাল হিমালয়ও জয় করতে লেগেছে ৯৬ বছর। রাধানাথ শিকদার মাপজোক করে বলতেই পেরেছিলেন, বিশাল এই পর্বত। জয় করতে পেরেছিলেন এডমুন্ড হিলারি আর তেনজিং নেগরে।
আর অর্ধসহস্র উইকেটের রেকর্ডে প্রথম পা রেখেছিলেন কোর্টনি ওয়ালশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়ঙ্কর পেস বোলিং লাইনআপের শেষ ধারক বাহক ছিলেন ওয়ালশ। আশির দশকে মার্শাল, হোল্ডিং, অ্যামব্রোজরা যে খুঁটি গেড়ে গিয়েছিলেন তার শেষ স্মৃতিচিহ্ন ছিলেন তিনি। চোট আর ক্যারিয়ারের বাইরে নজর দিতে গিয়ে ক্যারিয়ার বাড়াতে পারেননি তাঁর পূর্বসূরীরা। সময়ে বিশ্বের সেরা পেস বোলিং থাকলেও নিজেদীর ক্যারিয়ার করতে পারেননি বড়। কিন্তু ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি দানব ওয়ালশ পেরেছিলেন নিজের গরজে। ২০০১ সালের মার্চ মাসের ১৯ তারিখ।
পোর্ট অব স্পেনে জ্যাক ক্যালিসকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে টেস্ট ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ৫০০ উইকেটের মাইলফলকে পা দিলেন ওয়ালশ। দেখিয়ে গেলেন ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকার পথ। রেকর্ড গড়ার জন্যই যেন ক্যাক্রিয়ারটাকে এতোদূর নিয়ে এসেছিলেন। সেই সিরিজ শেষে এক মাসের মাথাতেই ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন কোর্টনে অ্যান্ড্রু ওয়ালশ। আর তার সঙ্গেই লেখা হয়ে গিয়েছিল আশির দশক থেকে শুরু হওয়া ভয়ঙ্কর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেস বোলিংয়ের অবিচ্যুয়ারি।
ওয়ানডে ক্রিকেট শুরু হওয়ার পর থেকেই বোলারদের আধিপত্য বাড়তে থাকে ক্রিকেটে। আগে যে ছিল না, তেমনটা নয়। কিন্তু ক্রিকেটার বললে ব্যাট হাতে নেওয়ার মূর্তির কথাই আসত। কিন্তু আশির দশকে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ছয় ফুটি তারকারা। আশির দশকে যেভাবে নিজেদের করে রেখেছিলেন পেসাররা, তেমনটা থাকতে দেন নি স্পিনাররা।
নব্বইয়ের দশকে এসে স্পিনাররা নিজেদের জায়গা করে নিতে শুরু করলেন। তার শুরুটা হয়েছিল নব্বই দশকের গোড়ায়। দৌড়ে এসে জোড়ে বল করেই যে ভয় দেখাতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। বরং চোখ মুখে বিভীষিকা এনে মুরলিধরণের মতন অফ ব্রেক কিংবা হাসি হাসি মুখ করা ওয়ার্নের টার্ন আর কুম্বলের বোলিং বৈচিত্র্য; একটা সুন্দর ইনিংসকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে যথেষ্ট। গ্রিনিচ থেকে পশ্চিমে পেসারদের দৌরাত্ম্য যখন টান পরেছে, পূর্বে ততই ভয়ানক হয়েছে স্পিনারদের আধিপত্য। এশিয়া থেকে কুম্বলে, মুরালি আর সাকলাইন আর অস্ট্রেলিয়া থেকে ওয়ার্ন।
সাকলাইন মুশতাক সময়ের ভয়ঙ্কর তারকা ছিলেন বটে, কিন্তু বাকি তিনজনের মতন ক্যারিয়ারটা সমৃদ্ধ করতে পারেননি। কিন্তু বাকি তিনজন ঠিকই পেরেছেন। কোর্টনি ওয়ালশ যখন ৫০০ উইকেটে ছুঁয়েছেন, তখন তাদের তিনজনের ঝুলিতেই ৩০০+ উইকেট। কোর্টনি ওয়ালশের পর দ্বিতীয় কে হবে সেই প্রতিযোগিতায় জিতলেন শেন ওয়ার্ন। তাও মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে!
২০০৪ সালে দেড় মাসের বিশাল সফর করতে শ্রীলঙ্কা এসেছিল অজিরা। অজিদের বহরকে যদি বলো রোমান সম্রাজ্য বলা যায়, তাহলে লঙ্কানরা ছিল ট্রয় নগরী। সেখানে মুরালিধরণ আর ওয়ার্ণকে তুলনা করা যায় হেক্টর আর অ্যাকিলিস হিসেবে। পুরো টেস্ট সিরিজকে সাজানোই হয়েছিল ওয়ার্ন বনাম মুরলিকে কেন্দ্র করেই। কে কাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, সে গল্প লিখবার জন্যই সকলে বসে ছিলেন যেন। ওয়ালশের ৫১৯ উইকেটের রেকর্ড কিংবা শ্রীলঙ্কা দল যে কর্পূরের মতন উড়ে যাবে, তা অনেকের কাছেই বোধগম্য ছিল। ঠিক যেমনটা ছিল ট্রয়ের পরাজয়।
লঙ্কার আশার বানী ছিল একমাত্র মুরলি আর অস্ট্রেলিয়ানদের ওয়ার্ন। সিরিজের আগে ৫০০ উইকেট ক্লাবে পৌঁছাতে ওয়ার্নের লাগে ৯ উইকেট, মুরালিধরণের ১৫। প্রথম ইনিংসে মুরলির ৬ উইকেটের জবাব দিয়েছিলেন ওয়ার্ন ৫ উইকেট নিয়ে। তার জবাব মুরলি দিয়েছিলেন আরেকবার ৫-উইকেট হল নিয়ে। কিন্তু এই লড়াইয়ে ওয়ার্ন একটু উপরের দিকেই ছিলেন, শেষদিনে এসে অধিনায়ক হাশান তিলকারত্নেকে পকেটে পুরে ৫০০ উইকেটের লড়াইয়ে জিতে গেলেন ওয়ার্ন। কিন্তু তাকে টেক্কা দিতে তিনদিনও অপেক্ষা করেননি মুরলি। বরং ক্যাসপ্রোভিচকে বোল্ড আউট করে ৫০০ উইকেটের ছোট্ট তালিকায় তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে প্রবেশ করে গেলেন মুরলি।
ওয়ার্ন ৫০০ উইকেটের ‘ব্যাটেল’ জিতলেও যুদ্ধটা জিততে পারেননি। তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ মুরলি শেষ করেছিলেন ২৮ উইকেট নিয়ে। আর ওয়ার্ন তার থেকে দুটো কম। সিরিজে ১২০ উইকেটের ৫৪ উইকেটই ছিল এই দুজনের পকেটে। ওয়ার্ন শুধু এই যুদ্ধ না, সর্বোচ্চ উইকেটের মহাযুদ্ধটাও খুইয়েছিলেন মুরলির কাছে। ওয়ার্ন যেখানে থেমেছিলেন ৭০৮-এ, মুরলি বলে কয়ে ছুঁয়েছেন ৮০০!
তালিকার পরের নামটাও এক অস্ট্রেলিয়ানের। আশির দশকে পেস বোলিং বলতে যে ভয়ঙ্কর জোড়েশোরে বল করবার প্রতিযোগিতা ছিল, তাতে কোনদিনও নাম লিক্লহতে পারতেন না তিনি। বরং অস্ট্রেলিয়ায় ওমন জোড়ে বল করার অনেকেই ছিল; লি, গিলেস্পি, টেইট কিংবা ক্যাসপ্রোভিচ। কিন্ত এদের ছাড়িয়ে তার নামটাই উপরে আসে, কারণ তিনি জানতেন কীভাবে ব্যাটসম্যানকে বিরক্ত করে উইকেট তুলে নিতে হয়।
জোরে বল করাই শেষ নয়, বরং লাইন-লেন্থ বজায় রেখে উইকেট নেওয়ার গল্পে সবসময়ই সামনের বেঞ্চের তারকা গ্লেন ম্যাকগ্রা। গ্লেন অবশ্য এমন এক সময়ে উইকেট নিয়েছেন, সেখানে তার উইকেট নিয়ে মাতামাতি করবার থেকে লোকজন মেতে ছিল সিরিজ নিয়ে। ২০০৫ অ্যাশেজ বলে কথা। অ্যাশেজের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা অ্যাশেজ বললেও ভুল হবে না। ২১ জুলাই লর্ডসে জাস্টিন ল্যাংগারের হাতে ক্যাচ দিয়ে ইতিহাসের চতুর্থ খেলোয়াড় হিসেবে তালিকায় ঢুকে যান ম্যাকগ্রা। সাথে সাথে পেসার-স্পিনার সমতাও নিয়ে আসেন রেকর্ডবুকে।
সেই সমতায় বাধ সাধেন অনিল কুম্বলে। অথচ ওয়ার্ন-মুরলি-গ্লেনের আগেই ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল তার। তবুও ক্যারিয়ারের দেড় দশক পার করে এই তালিকায় ঢুকতে হয় তাকে। সৌরভ গাঙ্গুলির আগে দেশের বাইরে ডাকই পেত না ভারত। লর্ডসে জামা খুলে যখন আনন্দ স্রোতে ভেসেছিলেন সৌরভ, তার সাথে সাথে দেশে-বিদেশে নিজেদের টেস্ট খেলার একটা পাসও নিয়ে এসেছিলেন। তাতেই উইকেটের পালে হাওয়া লেগেছে কুম্বলের।
২০০৬ সালের ১২ মার্চ, রেকর্ড করতে বেছে নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডকেই। মোহালিতে নিজের চিরচারিত ফ্লিপারে স্টিভ হার্মিসনকে লেগ বিফোর করে ক্যারিয়ারের ৫০০ তম উইকেট সেলিব্রেশন করেন কুম্বলে। এরপর থেকে উইকেটের গ্রাফ উপরের দিকেই উঠেছে। ২০০৮ সালে ক্যারিয়ার শেষ করেন ৬১৯ উইকেট নিয়ে। তবে পাঁচশতে পৌঁছুতে ওয়ার্ন-গ্লেনের থেকেও কম ম্যাচ লেগেছিল তার।
এরপর যেন এক দশকের হতাশা। যেভাবে হুট করে রেকর্ডবুকে এন্ট্রি হচ্ছিল, ঠিক সেভাবেই যেন উবে গেল সব। পাঁচ বছরে পাঁচশ ছুঁয়েছিলেন পাঁচজন। এরপরের এক দশক ছোঁয়া তো দূরে থাক, ধারে কাছেই আসতে পারেননি। পরের স্থানটা পরে ছিল ৩০ বছর পুরোনো কপিল দেবের কাছে। বড্ড আশা জাগিয়েছিলেন শন পোলক, হরভজন সিং; কিন্তু বয়সের ভারে চারশ থেকে পাঁচশতে নেওয়ার শক্তিটা ছিল না। এ যেন আভিজাত্যের অনন্যরূপে প্রকাশ। ‘এন্ট্রি ফি’ না থাকলে সেখানে ঢুকে আনন্দই বা কী? টেস্ট ক্রিকেটের এলিট ঘরে এন্ট্রি ফিটা একটু বেশিই। এ মূল্য এভাবে চুকানো সম্ভব নয়। তবে ক্রিকেটের এলিটদের ঘরে ইংলিশদের নাম থাকবে না, তা কী হয় নাকি? সেই আফসোস বেশিদিন রাখতে দিলেন না জেমস মাইকেল অ্যান্ডারসন।
এক দশকে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। ক্রিকেট নেমে এসেছে ২০ ওভারে। মানুষের আর পাঁচদিন বসে থাকার ধৈর্য্য নেই, চার-ছক্কা দেখেই আনন্দ। ক্রিকেটের বাজারজাতকরণ কিংবা ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেট নিয়ে অনেক কথা বলা যাবে, তবে বলা দরকার জেমস অ্যান্ডারসন মানুষটাকে নিয়ে। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি জেমস হয়ে উঠেছিলেন ক্রিকেটের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মাঠে নামার ৫ মিনিটের মধ্যে দুটো আউট বা ইন সুইংগার দেখার সৌভাগ্য হবে শুধু জেমসের কাছ থেকেই।
এত বছর কষ্টের পর এই জায়গায় আসাটা যেন তারই মানায়। ২০০৩ সালে অভিষেকের পর কত কিছু বদলেছে, ইংলিশ ব্যাটম্যানরা কেউ ভবিষ্যতের জন্য নিজের জায়গা ছেড়েছেন, কেউ বা অবসাদগ্রস্থতায় খেলা ছেড়েছেন, কেউ আবার দলের নামে উল্টোপাল্টা কথা বলে জায়গা হারিয়েছেন; অ্যান্ডারসন একা দেখে গিয়েছেন, আর হাতে হাত রেখে ব্রডের সাথে সামলেছেন বোলিং ডিপার্টমেন্ট।
৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭। রেকর্ড গড়তে দরকার ছিল মাত্র ৩ উইকেট। তাতেই দুই ইনিংস খরচা করতে হল জেমসকে। ক্রেইগ ব্রেথওয়েটের মিডলস্ট্যাম্প উড়িয়ে ৫০০ উইকেটের হলমার্ক পূরণ করলেন। ষষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে পূরণ করলে কী হবে, ইংলিশ নিন্দুকদের জন্য এ ছিল মনের শান্তি। সারা বিশ্বের খেলোয়াড়দের তুলোধুনো করে বেড়ানো নিন্দুকদের দেশের কেউ এখানে নেই, ভাবতেই কেমন জানো লাগতো। সে থেকে বের হওয়ার নতুন সুযোগ দিলেন জেমস। ক্রিকেটের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী মাঠেই নিজের নামটা বরণীয় করে রাখলেন অ্যান্ডারসন।
অ্যান্ডারসনের পর এই তালিকায় যাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সকলে আগ্রহে নিয়ে বসে ছিল, সেই যেন হঠাৎ মিইয়ে গেলেন। টেস্ট ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের পরই দক্ষিণ আফ্রিকার আগমণ। বড় একটা সময় নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ক্রিকেটের ছোটখাটো রেকর্ডে বেশ প্রোটিয়াদের উপস্থিতি ছিলই। সে আক্ষেপ পূরণ করতে স্টেইন যখন আগাচ্ছেন, তখনই বেরসিক চোটের হানা।
একবার নয়, থেমে থেমে বার বার। অ্যান্ডারসন যখন ৫০০ পূরণ করেন ততদিনে ৪০০ ছাড়িয়েছে ‘স্টেইনগান’-এর। অথচ সেখানেই যেন অ্যামো ফুরিয়ে গেল তার। ক্যারিয়ারের শেষ পাঁচ বছরে চোট সামলে খেলেছেন মাত্র ১১ টেস্ট। তবে এই তালিকায় কচ্ছপের মতন ধীর স্থির গতিতে যে তারকার আবির্ভাব, তিনিই এই তালিকার সর্বশেষ সংস্করণ, স্টুয়ার্ট জন ব্রড।
ব্রডের রক্তে ক্রিকেট। বাবা ক্রিস ব্রড ছিলেন ইংলিশ দলের ওপেনার। আশির দশকে ছিলেন আসা-যাওয়ার মধ্যে। ক্যারিয়ার শেষে হয়েছেন আম্পায়ার। বাবার দেখানো পথে হেঁটেছিলেন ব্রড। তবে ক্যারিয়ারের শুরুই যে ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন, সে ঝড় নিশ্চয় অজানা নয়। বাবা ক্রিস জানতেন, ইংলিশ দলে সুযোগ পাওয়া যতটা না কষ্ট, বাদ পরে ফেরত আসাটা তার থেকে হাজার গুণ বেশি কষ্টের। ছেলে স্টুয়ার্টও জানতেন। যে কারণে ২০০৭-এ ইংলিশ টেস্ট দলে প্রবেশ যে করেছেন, একেবারে খুঁটি গেড়ে এখনও বসে আছেন। ১৬১ টেস্টের মধ্যে ১৪০ টেস্টেই জায়গা করে নিয়েছেন ব্রড।
তার গল্পটা খরগোশ আর কচ্ছপের মতন। অন্যরা যেখানে ১২০-৩০ ম্যাচেই পাঁচশ ছুঁয়েছেন, সেখানে তার পার হয়েছে ১৪০। তার বোলিং দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতন বিষয় খুব একটা নেই। না আছে বিশাল বিশাল সুইং, না আছে গতি, তবুও টিকে আছেন। কারণ এ যুদ্ধে ঢাল তলোয়ার থাকলেই হয় না, এই যুদ্ধে টিকে থাকতে হলে মনোবল থাকা লাগে। সেটাই ছিল ব্রডের। যেমনটা এবার; ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ৫০০ উইকেটের দ্বারপ্রান্তে থাকার পরেও প্রথম টেস্টের দলে জায়গা হয়নি তার। তাতে যে মনো:ক্ষুণ্ণ হয়নি, তা নয়। তবে সেটাকেই শক্তিতে পরিণত করেছেন।
জেমসের সুইং আছে, আর্চারের স্পিড; কী আছে ব্রডের? ব্রডের কী আছে আর্চারের সামান্য বোকামিতেই প্রমাণ করে দিলেন। দ্বিতীয় টেস্টে ৬ উইকেট, আর পরের টেস্টে রেকর্ড। ম্যান অফ দ্যা সিরিজের ট্রফিটাও তার। ২৭ জুলাই ম্যানচেস্টারে যখন ব্রড মাঠ ছাড়লেন ৪৯৯ উইকেট নিয়ে, তখন দরকার মাত্র এক উইকেট ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে।
অথচ পুরো ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়ই তার নাম হয়েছে অন্যের নামে। এবার যেন সেই বাধা ভেঙ্গে বেরুনোর সময়। নিজের ‘টেস্ট ব্রাদার’ জেমস অ্যান্ডারসন যাকে দিয়ে পাঁচশত পূরণ করেছিলেন সেই ক্রেইগ ব্রেথওয়েটকেই লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে নিজের পাঁচশ পূরণ করলেন ব্রড। সেই সাথে ক্রিকেটের ‘ফাইভ হান্ড্রেড ক্লাব’-এ সেভেনথ লাকি ম্যান হলেন ব্রড।
আভিজাত্যের অনন্য এক নিদর্শন হলো টেস্ট ক্রিকেট। বহু কষ্টে কোনো এক চূড়া আরোহণ করে হঠাৎ দেখবেন, অনেক আগেই কেউ না কেউ ঐ চূড়ায় বসে আছেন। ক্রিকেটের ‘ফাইভ হান্ড্রেড ক্লাব’-এ প্রথম এন্ট্রি হতে লেগেছে ১২৪ বছর। এরপরে ৫ জন, আবার ১১ বছরের অপেক্ষা। পরবর্তী অপেক্ষা সম্ভবত আরও বড় হবে কিংবা লাকি সেভেন দিয়েই টানা হবে এই গল্পের সমাপ্তি। সে প্রশ্নের উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে হয়তো আরও এক যুগ কিংবা আরও বেশি। এখানেই টেস্টের সৌন্দর্য্য, এখানে উত্তর দেয় সময়। অন্য সব এখানে তুচ্ছ।