রেসলিং, জন সিনা এবং রঙিন সেই শৈশব

ডব্লিউডব্লিউই!

শৈশবে আমার আবেগের একটা বিশাল জায়গাজুড়ে ছিল এই ডব্লিউডব্লিউই যাকে সাধারণত আমরা রেসলিং বলে থাকি। তখনও একদমই জানতাম না যে এটা স্রেফ বিনোদন, পুরোটাই বানানো, এর মধ্যে কোনো প্রতিযোগীতা নেই। আমার রেসলিং দেখার শুরুটা ২০০৫ সাল থেকে।

তখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। বয়স কেবল ছয় (ভাববেন না আহাম্মক। বয়স নিয়ে লুকোছাপা ভালো লাগে না বিধায় বলেই দিলাম)। এই অল্প বয়সে আমার ভালোমতো কোনো বন্ধুই হয়নি। শত্রু তো অস্বাভাবিক ব্যাপার৷ কিন্তু শুনতে অবাক লাগলেও বলতে দ্বিধা নেই, মাত্র ছয় বছর বয়সে আমার শত্রু তো ছিলই এবং সেটা অসংখ্য। তাঁরা সবাই ছিলেন আমার চেয়ে বয়সে পাঁচগুণ, ছয়গুণ এমনকি সাতগুণ বড়ো। ওয়েট, ওয়েট, ওয়েট! চোখ কপালে তোলার কিছু নেই। সব খোলাসা করে বলছি।

ব্যাপারটা হলো আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন আমার নেশা ছিল দুটো। এক ক্রিকেট, দুই রেসলিং। আর যে অসংখ্য শত্রুর কথা বললাম তাঁরা সবাই গড়ে ওঠতেন আমার রেসলিং দেখাকে কেন্দ্র করে। আমার অস্বাভাবিক হারে রেসলিং দেখার ব্যাপারটায় বাড়ির লোকজন থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক, পাড়ার বড়ো ভাই ও পরিচিতরা খুবই বিরক্ত ছিলেন এবং প্রতিবার তাঁরা শুধু একটা মন্তব্যই করতেন, ‘আরে রেসলিং হলো সাজানো নাটক। এসব ভুয়া। এগুলো কেউ দেখে না কি! বলদ কোথাকার!’

আগেই বলেছি রেসলিং ছিল আমার আবেগের একটা বড়ো অংশ। তাই কোনোভাবেই তাঁদের এমন বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য মেনে নিতে পারতাম না আমি। এজন্য তাঁদের সাথে রীতিমতো ঝগড়াঝাঁটি করতাম। সেইসাথে এসব মন্তব্য করা সবাইকে শত্রুর চোখে দেখতাম।

এমনকি শত্রুদের সেই বিশাল তালিকায় অপরিচিত একজনও ছিলেন। ঘটনাটা বলি তাহলে। আমার গৃহশিক্ষকের পিসতুতো দাদা তখন আমেরিকাপ্রবাসী। তিনি একবার আগ্রহ নিয়ে সরাসরি রেসলিং দেখতে যান। ফিরে এসে সে অভিজ্ঞতা আবার আমার শিক্ষকের সাথে ভাগাভাগি করেন। রেসলিং কোর্টের সাদা আস্তরণের নিচে নরম ফোম দেওয়া থাকে, মারামারিতে মিশে থাকে সম্পূর্ণ সিনেমার মতো অভিনয়- এমন অনেক অপ্রিয় তথ্য জানান তিনি। পড়াতে এসে সেই গপ্প আবার আমাকে শোনান শিক্ষক মশাই। শোনালেই বা কি! আমি বিশ্বাস করলে তো! বিশ্বাস তো করিইনি বরং নামধাম না জানা ওই ভদ্রলোককেও শত্রুদের তালিকায় ফেলে দিই।

রেসলিংয়ে আমার সবচেয়ে পছন্দের ‘খেলোয়াড়’ জন সিনা। জন সিনা বলতে আমি পাগল। এখানে একটু বলে রাখা ভালো, জন সিনার নামের সাথে আমার নাম ‘সিনা’ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। প্রাতিষ্ঠানিক কাগজপত্রে ‘সিনা’ না থাকায় অনেকেই ভাবেন নামটা বুঝি আমার নিজের দেওয়া৷ যদিও এটা আমার বাবার রাখা নাম। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অবশ্য ‘উদয়’ নামটিরও অস্তিত্ব নেই। তবে সেটা নিয়ে কেন জানি কেউ প্রশ্ন তোলেন না। অদ্ভুত!

যাই হোক। মূল কথায় ফিরি। জন সিনা ছিলেন আমার শৈশবের নায়ক। নায়ক ইন জেনারেল  যাঁকে আমি সর্বদা অনুসরণ করতাম। তাঁর হাঁটা-চলা, পরিধেয় থেকে শুরু করে ট্রেডমার্ক মার পর্যন্ত। হাঁটা-চলা, পোশাক-পরিচ্ছদ পর্যন্ত ঠিক আছে। তাই বলে মার! ব্যাপারটা একটু সাংঘাতিক হয়ে গেল না?

মারের কথায় পরে আসছি। আসলে আমার কাছে জন সিনা ছিলেন এক কথায় মোহ। তাঁর ‘ইউ ক্যান্ট সি মি’ বাড়ির লোকেদের দেখিয়ে কত যে চড়-থাপ্পড় খেয়েছি সে হিসাব নেই। বুঝার সুবিধার্থে বলে রাখি ‘ইউ ক্যান্ট সি মি’ হচ্ছে জন সিনার নিজস্ব উদযাপনের নাম। মুখের সামনে ডানহাতটা এনে এপাশ-ওপাশ ঘোরানোটাই ছিল সে উদযাপন (না বুঝলে ইউটিউব প্লিজ)। ভালো কথা, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোরি কলিমোর ও ফিদেল এডওয়ার্ডসকেও দেখতাম উইকেট পেলে নিয়মিত ‘ইউ ক্যান্ট সি মি’ উদযাপনটা করতে। তবে কি তাঁরাও জন সিনার ভক্ত? জানলে জানাবেন অবশ্যই।

শৈশবে জন সিনা ছিলেন বাসায় আমার নিত্য মার খাওয়ার এক কারণ। ‘ইউ ক্যান্ট সি মি’র পর তাঁর যে জিনিসটা নকল করতে খুব চেষ্টা করতাম সেটা ছিল তাঁর টি-শার্ট খোলার ভঙ্গিমা। সে ভঙ্গিমাটা কেমন ছিল লিখব? এমনিতেই লেখাটা খুব বড়ো হয়ে যাচ্ছে৷ না! লিখেই ফেলি।

গা থেকে টি-শার্ট খুলে ফেলার এক অদ্ভুত স্টাইল ছিল জন সিনার। ডানহাত দিয়ে টি-শার্টের বাঁহাতাটা একটু টেনে বাঁহাত তার ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে পুরো টি-শার্টটা মাথার উপর দিয়ে খোলার সে স্টাইল। আমার বর্ণনা পড়ে সেটা উপলব্ধি করা কঠিন হতে পারে৷ সমস্যা নেই। যাঁরা দেখেননি তাঁরা ইউটিউবে সন্ধান করলে খুব সহজেই তা পেয়ে যাবেন।

জন সিনার টি-শার্ট খোলার এ অভিনব পদ্ধতিটা আমাকে বরাবরই আকর্ষণ করত। দুঃখের বিষয় এ পদ্ধতি হাজারবার চেষ্টা করেও কোনোবারই সফল হইনি আমি। সফল তো হইনিই বরং এর জন্য বেশ কয়েকটা টি-শার্টও ছেঁড়া হয়েছে আমার। সেইসাথে পিঠে পড়েছে আম্মার উত্তম-মধ্যম। এভাবে শৈশবে আমার মার খাওয়ারও বিশাল একটা অংশজুড়ে ছিলেন জন সিনা।

এবার সাংঘাতিক ব্যাপারটায় আসি। ‘ইউ ক্যান্ট সি মি’ বা টি-শার্ট খোলার ধরন নকল করাটা মানা যায়। কিন্তু তাই বলে তাঁর ট্রেডমার্ক মার নকল করা! খুবই সাংঘাতিক। কিন্তু কী আর করার! ওই বয়সে বুঝিই-বা কতটুকু! ইংরেজি ভাষাটাও তো বুঝতাম না ঠিকমতো। তাই টিভিতে যতই ‘ডোন্ট ট্রাই দিস অ্যাট হোম’ এর মহান খুদেবার্তা দেওয়া হোক, তাতে কোনো কাজ হতো না (মনে হয় আমার মতো ঘাড়ত্যাড়া ওটা বুঝলেও খুব বেশি তোয়াক্কা করত!)।

জন সিনার ট্রেডমার্ক মারের নাম ‘অ্যাটিটিউড অ্যাডজাস্টমেন্ট’। আর সবমিশনে ব্যবহার করা মারটার নাম ‘এসটিএফ’। ট্রেডমার্ক মারের ধরনটা ছিল ঘাড় নুইয়ে প্রতিপক্ষের দুপায়ের ফাঁকায় বামহাত ঢুকিয়ে ডানহাত কাঁধে বসিয়ে তাঁকে নিজের কাঁধে তুলে ডানদিকে আছাড় মারা। আর এসটিএফটা ছিল একজনকে উপুড় করে শুইয়ে দুই হাত এক করে তাঁর থুতনির নিচে প্রচণ্ড জোরে চেপে ধরা (না বুঝলে আবারও ইউটিউব প্লিজ)।

এই দুটো মারই আমি নিত্য অনুশীলন করতাম। মামাতো ভাই বা এলাকার সমবয়সীদের ওপর এগুলো প্রয়োগ করতাম। ভয় পাবেন না। আছাড়-টাছাড় দিতাম ঠিকই কিন্তু তা হয় খাটে নয়তো খড়ের গাদায়। তাই ব্যথা পাওয়ার তেমন কোনো ঝুঁকিই ছিল না।

খেলার বাইরে জন সিনার আরেকটা ব্যাপার আমাকে খুব টানত। সেটা তাঁর পরিধেয়৷ কখনো কালো, কখনো গাঢ় জলপাই রঙের, কখনো আর্মিদের পোশাকের মতো আবার কখনোবা হালকা আকাশি রঙের থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্টের সাথে রঙিন সব টি-শার্ট। সাধারণত একই রং বা ধরনের টি-শার্ট খুব বেশিদিন পড়তেন না তিনি। প্রতিটা ডব্লিউডব্লিউই স্পেশালেই তিনি আবির্ভূত হতেন নতুন  টি-শার্ট গায়ে চড়িয়ে। তাই ওইসব স্পেশালে শুধু তাঁর খেলা দেখার জন্য নয়, নয়া টি-শার্টটা দেখার জন্যেও অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম আমি।

এবার একটু জন সিনার খেলায় প্রবেশ করি। তাঁর গলায় শেকল ও তালা ঝুলানোর দিনগুলো স্মরণ করি। হলফ করে বলতে পারি, প্রায় এক দশক ধরে রেসলিং দেখার সময়টাতে জন সিনার একটি ম্যাচও মিস হয়নি আমার। তন্মধ্যে আমার দেখা তাঁর অন্যতম সেরা ম্যাচটি ছিল জেবিএলের বিপক্ষে আই কুইট ম্যাচটি। আসলে জন সিনা আর আই কুইট ম্যাচ হচ্ছে অবিচ্ছেদ্য অংশ৷ তাঁর নাম নিলে আই কুইট ম্যাচের কথাই সবার আগে সামনে চলে আসে। কারণ তিনি হলেন আই কুইট ম্যাচের অবিসংবাদী চ্যাম্পিয়ন।

২০০৫ সালে জেবিএলের বিপক্ষে রক্তমাখা মুখ নিয়ে সিনা যেভাবে ম্যাচটি জিতেছিলেন তার কোনো তুলনা হয় না। তবে তাঁর খেলা আই কুইট ম্যাচগুলোর মধ্যে রেন্ডি অরটনের বিপক্ষে খেলাটা দেখে সবচেয়ে বেশি তৃপ্ত হয়েছিলাম আমি। ওই ম্যাচটার আবেদন কখনোই ফুরোবার নয়। মনে পড়ে, ২০০৯ সালের কোনো এক চাঁদরাতে ‘ব্রেকিং পয়েন্ট’ স্পেশালের সে ম্যাচটি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। রিঙের বাইরে সিনাকে শেকলবন্দী করে একাধিক লাঠি দিয়ে রেন্ডির ক্রমাগত অমানুষিক প্রহারের পরেও কুইট করার বদলে লড়াই করে জেতা সে ম্যাচটিই আমার দেখা জন সিনার ক্যারিয়ারের সেরা ম্যাচ।

তৃপ্তির কথা বলতে মনে পড়ে যায় আরেকটি ম্যাচের কথা। ২০১২ সালের ‘এক্সট্রিম রুলস’ এ ব্রক লেসনারের বিপক্ষে জয়টা আমাকে কম তৃপ্ত করেনি। তাছাড়া রেসলম্যানিয়া ২১, ২২,২৩ ও ২৯ এ যথাক্রমে জেবিএল, ট্রিপল এইচ, শন মাইকেল ও কিংবদন্তি রককে হারানো, ২০০৮ ও ২০১৩ তে রয়্যাল রাম্বল জয়, ২০১২ সালে মানি ইন দ্য ব্যাংক জয়, ২০১০ সালের ‘ওভার দ্য লিমিট’ এ আই কুইট ম্যাচে বাতিস্তার বিপক্ষে জয় এবং একই বছর ‘টিএলসি’তে চেয়ার ম্যাচে ওয়েড ব্যারেটকে হারানোর ম্যাচগুলোও আমাকে কম তুষ্ট করেনি।

এই জয়গুলোর বিপরীতে জন সিনার কয়েকটি হার ছিল যেগুলো আমি আজ পর্যন্ত হজম করতে পারিনি। আপাতত তিনটি পরাজয়ের কথা মাথায় ঘুরছে। একটা ছিল ২০০৯ সালের ‘টিএলসি’তে আনকোরা শেইমাসের বিপক্ষে টেবিল ম্যাচে হেরে ডব্লিউডব্লিউই চ্যাম্পিয়নশিপ খোয়ানোটা। আরেকটা এর পরের বছর ‘সামারস্ল্যাম’ এ আনডিসপিউটেড ডব্লিউডব্লিউই চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচে সিএম পাঙ্কের বিপক্ষে হার।

ওই ম্যাচে পাঙ্ক অতিরিক্ত ভালো খেলেছিলেন। সেদিন একটা অভাবনীয় ঘটনাও ঘটেছিল। সে ম্যাচটা অনুষ্ঠিত হয় শিকাগোতে। আর শিকাগো হলো পাঙ্কের জন্মস্থান। তাই গ্যালারিতে উপস্থিত সিংহভাগই ছিলেন সিএম পাঙ্কের সমর্থক। এমনকি ম্যাচের পুরোটা সময়জুড়ে জন সিনাকে দুয়োধ্বনি পর্যন্ত শুনতে হয়েছিল। এর আগে এরকম পরিস্থিতি কখনোই চোখে পড়েনি আমার।

সবশেষে মনে পড়ছে রেসলম্যানিয়া ২৮ এর মেইন ইভেন্টে রকের বিপক্ষে সিনার হারের কথা। প্রচুর আশা নিয়ে ম্যাচটা দেখেছিলাম। ৩০ মিনিটের সে ম্যাচে উত্তেজনা, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই সবই ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা হারতে হয় সিনাকে। আর সেদিন রক আবারো প্রমাণ করেছিলেন কেন তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা রেসলার হিসেবে বিবেচিত ও সমাদৃত।

যথেষ্ট হয়েছে। এবার লেখাটা শেষ করি৷

অনেকেই বলেন রেসলিং সাজানো নাটক। এখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার মতো কিছুই নেই। কিন্তু আমি বলি রেসলিং থেকেও আপনি শিক্ষা নিতে পারেন৷ অন্তত জন সিনার কাছ থেকে। কেননা ‘নেভার গিভ আপ’ খুদেবার্তাটা শুধু তাঁর টি-শার্টেই বিদ্যমান নয়। কখনোই হার না মানার মানসিকতাটা যে তাঁর খেলার মাঝেও প্রতিনিয়ত প্রস্ফুটিত হয়।

একটা সময় রেসলিং গোগ্রাসে গিলতাম আমি। এখন তা না দেখার সাত বছর পূর্ণ হতে চলেছে। হয়তো বয়সের সাথে আমার সেই শত্রুদের মতো আমিও বুঝে গিয়েছি যে রেসলিংয়ের পুরোটা না হলেও অধিকাংশই অভিনয় আর সাজানো নাটক। তবুও রেসলিংকে তাচ্ছিল্যের নাটক সম্বোধন করতে ব্যক্তিগতভাবে আমার মুখে আটকায়। আসলে এটাকে এন্টারটেইনমেন্ট বা বিনোদন বলাই শ্রেয়। আর এই বিনোদন থেকে বর্তমানে মুখ ফিরিয়ে আমি।

তবে রেসলিং দেখা আমি ছেড়ে দিলেও রেসলিং আমাকে ছাড়েনি। যে কারণে বিগত ছয় বছরের বেশি সময় ধরে একটি ম্যাচও না দেখা আমি রেসলিং নিয়ে এত বড়ো একটা ছাইপাঁশ লিখে ফেললাম। সেইসাথে এ কথা নিশ্চিত যে রেসলিং আমাকে কখনোই ছাড়বে না। ছেলেবেলার গল্পে, স্মৃতি রোমন্থনে কিংবা আড্ডায় বার বার ফিরে আসবে এটি। এখন যতই রেসলিং থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই না কেন, এই রেসলিংই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকবে আমার শৈশবের গল্পে, স্মৃতিতে৷ সবসময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link