ধুপকাঠি পুড়ে যায়, থেকে যায় গন্ধটা

আনন্দ মাহাতোরা কালকের ভোরেও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে রাঁচির বাড়িটার সামনে - দেখা হবে না জেনেও। আর তিরুবনন্তপুরমবাসী সেই প্রতিবন্ধী হুইলচেয়ারে বসে বসে কালকেও উপভোগ করবে জীবনটাকে, তাঁর ডান হাতটা শুঁকতে শুঁকতে, যে হাতে সে স্পর্শ করেছিল তার মনেরমানুষটিকে। কারণটা ওই যে, ধোনিদের জীবনে পিছনফিরে তাকানো নেই,আছে বিরহের বাউন্ডারি কাটিয়ে শুধুই এগিয়ে যাওয়া, শুধুই এগিয়ে যাওয়া। হার গালি মে তো ধোনি হি হ্যায়।

তাসমানিয়ার নীল আকাশের বিশালতা এখনও প্রবেশ করে সিডনিনিবাসী ৮৮ বছরের বৃদ্ধার জীবনে। বৃদ্ধার নাম এডিথ নরম্যান। জীবন সৈকতের শেষ কিনারায় দাঁড়িয়ে যখন সবাই ঈশ্বর নাম জপ করে কিংবা বিদায়ঘণ্টার প্রহর গোনে, তখন তিনি একটু ব্যতিক্রমী। অন্যদের মতো তাঁর জীবন-ক্রিকেটটা কপিবুক নয়।

তিনি এখনও নিজের ছেলের সাথে গিয়ে বসে থাকেন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। অপেক্ষা করেন একজন পরদেশীর জন্য। ঠিক সেই পরদেশীর জন্য অপেক্ষা, যে একবছর আগে তার কাঁধে মাথা রেখেছিল। গল্প করেছিল। পরদেশীর নাম মহেন্দ্র সিং ধোনি। একবছর আগে জানুয়ারি মাসে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে প্র‍্যাকটিসের পর জীবন সায়াহ্নের পথচারী এডিথকে দেখে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি।

পাশে বসেছিলেন। নিজের মায়ের মতো কাঁধে হাত রেখে ঠিক কি বলেছিলেন জানা নেই, হয়তো আধো আধো ইংরেজিতে বলেছিলেন, ‘এটাই শেষ দেখা হয়তো।’

বোকারোর প্রেমচন্দ্র মাহাতোর ছেলে আনন্দ্ আজও প্রতি সাত জুলাই ভোররাতে বোকারো থেকে রওনা দেয় রাঁচির এক বহুতল বাড়ির সামনে।বাবা ক্ষেতমজুর। কষ্টের সংসার। অনেক অভাব। অনেক অনটন। কিন্তু তবুও একটা কাল্পনিক সুখের অলীকত্বে কেটে যায় তার জীবন। প্রতি সাত জুলাই কষ্টের রোজকার থেকে কেনা ফুলের তোড়াসমেত সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে রাঁচির ওই বাড়িটার সামনে।

ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা। বাড়ির মালিকের সাথে কোনোদিনই দেখা হয়না। অবশেষে সন্ধ্যা হলে ফিরে আসে নিজের বাড়িতে। ফুলগুলো রেখে আসে রাঁচিতে।হয়তো কেউ গ্রহণ করে কিংবা পড়েই থাকে মাটিতে। আনন্দ্ মাহাতো নিজের বাড়িতে বজরংবলীর ফটোর পাশে সাজিয়ে রেখেছে রাঁচির সেই বাড়ির মালিকের ছবি। লম্বা চুল।হাতে BAS ব্যাট।রাঁচির এক হোটেলে সেই মানুষটার যাতায়াত আছে শুনে তৎক্ষণাত আনন্দ মাহাতো ছুটে গিয়েছিল সেই হোটেলে কাজের সন্ধানে।

কর্মসূত্রেও যদি আলাপ করা যায়, সেই আশায়। ফ্রন্ট অফিসের কাজটাও জুটিয়ে ফেলেছে সে।কিন্তু আজও সে অপেক্ষা করে আছে পাঁচটা মিনিটের জন্য,যে পাঁচটা মিনিট সে ছুঁতে পারবে তার স্বপ্নের নাগরিককে।এরকম পাগলামোর জন্য তার বাবা তাকে মনোবিদও দেখিয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল – আনন্দ মাহাতোর অন্তরাত্মা নাকি এক হয়ে গেছে তার স্বপ্ননাগরিকের সাথে।আর নাকি পৃথক করা সম্ভব নয়।

ক্যালিফোর্নিয়ার রাস্তায় একটা লাল গাড়ি চলে মাঝেমধ্যেই। গাড়িটার একটি বিশেষত্ব আছে। সেই গাড়ির নাম্বার প্লেটে কোনো নাম্বার লেখা নেই। আছে এম এস ধোনি লেখা নামটা। সরকার থেকে পারমিশনও নাকি দিয়েছে।

আলিপুর দুয়ারের পূর্ব শান্তিনগরবাসী শম্ভু বসুর হোটেলে আজও বিনা পয়সায় খাবার মেলে বহু বুভুক্ষুর। প্রিয় তারকার নামে সে নিজের হোটেলের নাম রেখেছে ‘ধোনির হোটেল’। সেই হোটেলের এক অবিশ্বাস্য নিয়ম আছে। ক্ষুধার্ত গরীবদের সেই হোটেল খাবার দেয় বিনামূল্যে।

আবার এক তিরুবনন্তপুরমবাসী আজও একটা হুইলচেয়ারে বসে অপেক্ষা করে থাকে গ্রীনফিল্ড স্টেডিয়ামের বাইরেটায়। সে প্যারালাইজড। পা নড়েনা। হাত নাড়াতে পারে অতিকষ্টে। সঙ্গী একটা হুইলচেয়ার।অবশ্য,আরও একটা সঙ্গী আছে তার। একটা মানুষের ছায়ামূর্তি। বছর তিনেক আগে উইন্ডিজ সিরিজে এসে সেই ছায়ামূর্তি ছুঁয়ে গিয়েছিল তার হাতদুটোকে।

তখন হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বসে বসেই সেই প্রতিবন্ধী মানুষটি চুমু খেয়েছিল তার ছায়ামানসের হাতে,যে হাতটা হয়তো একটা নীল সভ্যতা গড়বার কারিগর। সেই নীল সওদাগরের হাতে হয়তো এখনও লেগে আছে তিরুবনন্তপুরমবাসীর ঠোঁটের পরশ – কে বলে ভালোবাসার মৃত্যু আছে?

সিডনির এডিথ নরম্যান, বোকারোর আনন্দ মাহাতো অথবা আলিপুরদুয়ারের শম্ভু বসু কিংবা সেই তিরুবনন্তপুরমবাসী – এরা চেনেনা কেউ কাউকে। এরা কেউ দিনমজুর,কেউ জীবনসায়াহ্নের পথগামী বৃদ্ধা কেউবা প্রতিবন্ধী। কিন্তু এরা আজও বেঁচে আছে একটা অলীক প্রেমের পরশে।

এদের জীবনের খেলাটা বাকীদের মতো জন্ম-যৌবন-বার্ধক্য-মৃত্যুতে সীমাবদ্ধ কপিবুক ক্রিকেট নয়। এরা কপিবুক ক্রিকেট জানেওনা; খেলেওনি, ঠিক এদের মনের মানুষটার মতোই। এরা জানেনা জীবনের বলটাকে একদিন ড্রাইভ মেরে বাউন্ডারির রোপটাকে স্পর্শ করাতে হয়। ড্রাইভ কি সেটাই শেখেনি। এদের জীবনের শটগুলি সবটাই লফটেড।

\

বল বাউন্ডারি ছোঁয়না। আকাশে উড়ে বেড়ায় অসীমের স্পর্শ পেতে, ঠিক এদের মনের মানুষটা যেমন খেলে। এডিথ নরম্যান বার্ধক্য নামক বলটাকে লোফটেড পাঞ্চ মেরে পাঠিয়ে দেয় তাসমানিয়ার আকাশে। বল চলে যায় বোকারোর দিনমজুর পরিবারের আনন্দের কাছে; সে স্ট্রেটে হাঁকায় আকাশচুম্বী ছক্কা, তারপর সেই বল চলে যায় কেরালার সেই প্রতিবন্ধীর কাছে, সে তখন প্রতিবন্ধকতার বলটিকে একটা হেলিকপ্টার শটে পাঠিয়ে দেয় সীমাহীনতার গ্রাউন্ডে।

আগেই বলেছিলাম এদের জীবনের শটগুলো বাকীদের মতো বাউন্ডারিতে আবদ্ধ নয়, সেগুলো উড়ে বেড়ায় আকাশ বেয়ে। চিরাচরিত কপিবুকত্ব নয়, তাদের জীবন দর্শনের নাম বোধহয় দ্য ধোনি টাচ,যে টাচে লেগে আছে চিরাচরিত প্রথা ভেঙে নতুন দর্শন সৃষ্টির অঙ্কুর। এই এডিথ, আনন্দ, শম্ভু – এরাই তো ধোনি। ধোনি তো কোনো মানুষের নাম নয়, ধোনি একটা দর্শনের নাম, যে দর্শন তাদের বারবার শিখিয়েছে – জীবন ক্রিকেটটাকে কপিবুক করে খেলোনা।

খেলো নিজের মতো স্বাভাবিক করে। আর তোমার জীবনের বাধার বলগুলিকে এক একটা হেলিকপ্টার মেরে আছড়ে ফেলো সীমান্তে। তাই বোধহয় এদের জীবনের সংজ্ঞাটা অন্য, যেখানে ৮৮ বর্ষীয় বৃদ্ধা, ক্রিকেটের জন্য আজও বাঁচতে চায়; কেরালার প্যারালাইজড বন্ধু চুম্বনকরার মুহুর্তকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে; আর বোকারোবাসী আনন্দ্ মাহাতো দারিদ্রের পরোয়া না করে জীবনরস নিংড়ে নেয় বজরংবলীর পাশে রাখা ফোটোফ্রেমটার থেকে। জীবনদর্শনের দ্য ধোনি টাচ।

ধোনির লোফটেড পাঞ্চ কিংবা হেলিকপ্টার শটগুলো আজ আর মাঠে দেখা যায়না। এই মানুষগুলো তাকে শেষবার দেখেছিল মুখে রক্ত নিংড়াতে নিংড়াতে মাঠ ছাড়তে। ধোনিরা চলে যায়। ফেরে না। আর রেখে যায় তার অস্তিত্বটাকে। যে অস্তিত্বকে সম্বল করে শম্ভু-আনন্দ-এডিথরা আজও জীবনের ক্রিকেটটা খেলে যায় সমান পারদর্শীতায়।এরা সবাই যে জীবন ক্রিকেটের এক একজন ধোনি। হার গালি মে ধোনি হ্যায়।

আপনিও চোখ তুলে একটু চারপাশে তাকান। দেখতে পাবেন হাজার হাজার মধ্যবিত্ত ছাপোষা ধোনিরা কিভাবে এখনও শট মেরে যাচ্ছে জীবনে। তারা সবাই একদিন চ্যাম্পিয়ন হবে। ভারতবর্ষ সূর্যেরই এক নাম। ঠিক যেমন ধোনি দর্শনেরই এক নাম। যে দর্শন বারবার ধ্বংসস্তুপের মাঝে ইমারত গড়ে যায়। যে দর্শনে কোনো কপিবুকত্ব নেই। আছে ইমারত গড়বার জেদ।

আমি জানি এই লেখা পড়তে পড়তে কিছুজনের চোয়াল প্রসারিত হয়েছে হাসিতে, আবার আমি এও জানি তার চেয়েও বেশি কিছু মানুষের চোখের কণা ভিজেছে জলেতে। কিন্তু, আপনারা বুঝতেই পারেননি সেঞ্চুরি-রান-ইনিংস-ট্রফি এসব ছোটো ছোটো সীমাবদ্ধতায় আটকে না থেকে একদল মানুষ ধোনি নামের মাঝে খুঁজে নিয়েছে বিশালত্বের আকাশটিকে, যে আকাশের ছাদে আশ্রয় নেয় এডিথ নরম্যান, শম্ভু বসুসহ হাজার হাজার স্বপ্নতৃষ্ণার্তরা। স্ট্যাটেস্টিক্স বনাম খেলার লড়াইয়ে যে বারবার জিতে গেছে ধোনি নামক অস্তিত্বটা।

লম্বা সোনালী চুলগুলো আজ ছোটো হয়েছে। গালে গজিয়েছে সাদা দাড়ির ঝাঁক। ফুটওয়ার্কে দুর্বলতা স্পষ্ট। মাঠ তো নয়ই,এমনকী জনসাধারণের মাঝেও দেখা নেই তাঁর। কিন্তু তার অস্তিত্বের বয়সটা বোধহয় নীললোহিতের মতোই কোনোদিনও পাল্টায়না।সে অস্তিত্বের আকাশের নীচে বসতি গড়ে তোলে অনেকে। নীললোহিতের বয়স সাতাশ ছিল, আর এই অস্তিত্বের বয়সটা ‘সাত আশা’। এটাই পার্থক্যমাত্র।

সময় আর নদীর স্রোত নাকি খুবই শক্তিমান। তারা নাকি পাল্টে দেয় সবকিছুই।কিন্তু হাজার চেষ্টাতেও তারা তো পাল্টাতে পারেনি ধোনি অস্তিত্বের পাথরটাকে। শুধু এটুকুই তাদের ব্যর্থতা যা।

ক্যালিফোর্নিয়ার লাল গাড়িটা এখন আর হয়তো বেশি রাস্তায় বেরোয়না। হয়তো কোনো অবসাদগ্রস্থ সন্ধ্যায় এডিথরা টসটস করে দু’ফোঁটা জল ফেলে। কি জানি, হয়তো শেষ দেখাটা হয়েই গেছে এটা ভেবেই তাদের চোখে বৃষ্টি নামে টসটস করে। আসলে ধোনির যে পিছনফিরে তাকানো নেই, সবটাই এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু তবুও সেই বিরহকে মুছে ফেলে অষ্টাশি বর্ষীয় এডিথরা কালকের সন্ধ্যাতেও সিডনির গ্রাউন্ডে ভিড় করবে।

আনন্দ মাহাতোরা কালকের ভোরেও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে রাঁচির বাড়িটার সামনে – দেখা হবে না জেনেও। আর তিরুবনন্তপুরমবাসী সেই প্রতিবন্ধী হুইলচেয়ারে বসে বসে কালকেও উপভোগ করবে জীবনটাকে, তাঁর ডান হাতটা শুঁকতে শুঁকতে, যে হাতে সে স্পর্শ করেছিল তার মনেরমানুষটিকে। কারণটা ওই যে, ধোনিদের জীবনে পিছনফিরে তাকানো নেই,আছে বিরহের বাউন্ডারি কাটিয়ে শুধুই এগিয়ে যাওয়া, শুধুই এগিয়ে যাওয়া। হার গালি মে তো ধোনি হি হ্যায়।

ধুপকাঠি পুড়ে যায়, থেকে যায় গন্ধটা।

ধোনিরা চলে যায়, রেখে যায় অস্তিত্বটা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...