হেডিংটা দেখে ভ্র কুঁচকে ফেলেছেন?
কোচকানোরই কথা। মিস্টি বোলার হয়, মিস্ট্রি স্পিনার হয়; একজন সাদামাটা ব্যাটসম্যান, তার আবার রহস্যটা কী!
না, ভাই। সৌম্য সরকারের ব্যাটিং, এমনকি বোলিংয়েও এমন কোনো রহস্য নেই। রহস্য যা কিছু আছে, তা বাংলাদেশের ক্রিকেটে সৌম্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে। এই পাচ-ছয় বছর আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে দেখেও আমি অন্তত বুঝতে পারিনি, সৌম্য সরকারের প্লেয়িং রোল আসলে কী? দলে তার আসল ভূমিকাটা কী?
সব ক্রিকেটারের একটা পরিচয় থাকে। বড় বড় করে তার প্রোফাইলে ‘প্লেয়িং রোল’ লেখা থাকে। আপনি কী বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন, সৌম্যর এই পরিচয়টা কী? সৌম্য কী ওপেনার? নাকি সৌম্য মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান? নাকি তিনি বোলিং অলরাউন্ডার? নাকি স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান?
না, সৌম্যকে আমি দায় দিচ্ছি না। এই দায়টা পুরোপুরিই টিম ম্যানেজমেন্টের।
এই টেস্টের ঘটনাটা দেখেন। সৌম্য সরকার স্কোয়াডেও ছিলেন না। তিনি ধরে নিয়েছিলেন, তিনি লিমিটেড ওভার স্পেশালিস্ট। তাই সেভাবেই জীবন কাটাচ্ছিলেন। সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে মিরপুর অ্যাকাডেমিতে যাচ্ছিলেন। সেখান কয়েক জন নেট বোলার নিয়ে সাদা বলে ব্যাটিং করছিলেন। তার মানে সৌম্য নিজেকে নিউজিল্যান্ড সফরের জন্য প্রস্তুত করছিলেন। যেখানে শুধু লিমিটেড ওভার ক্রিকেট খেলবেন তিনি।
এর মধ্যে এক আকষ্মিক প্রভাতে উঠে নির্বাচকরা বললেন, ‘ওহে সৌম্য, তুমি একজন টেস্ট ওপেনার। দ্রুত মাঠে এসো।’
সৌম্যও এই ‘ওঠ ছেড়ি তোর বিয়ে’ প্রস্তাবে দলে এলেন এবং আমরা জানলাম, সৌম্য কেবল টেস্ট ওপেনারই নন, একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার; যিনি ওপেনও করবেন! হ্যাডলি, বোথামেরও এতো বড় দায়িত্ব পালন করতে হয়নি।
আজব বটে!
সৌম্য সরকার তার সর্বশেষ টেস্ট খেলেছেন আফগানিস্তানের বিপক্ষে। সেখানে প্রথম ইনিংসে ওপেন করেছিলেন, দ্বিতীয় ইনিংসে ৮ নম্বরে ব্যাট করেছিলেন। আর এটাই তার ক্যারিয়ারের হাইলাইটস। এই ছয় বছর তাকে নিয়ে এই রসিকতাই চলছে।
সৌম্য ঘরোয়া ক্রিকেটে দিব্যি টপ অর্ডারে খেলে, বিশেষ করে ওপেনিং করেই ক্যারিয়ার কাটাচ্ছিলেন। এমন কোনো বড় বোলার ছিলেন না।
তখন বাংলাদেশ জাতীয় দল ‘খোজ দ্য সার্চ’ চালাচ্ছে একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডারের জন্য। অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপ খেলতে একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার লাগবে। নেটে সৌম্যকে দেখে হাতুরুসিংহে তার মধ্যে ইয়ান বোথাম, কপিল দেব দেখে ফেললেন।
২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক হলো তার। ৩ নম্বরে ব্যাট করে ২০ রানের ইনিংস করলেন। লক্ষ্যনীয় এই যে, সে ম্যাচে বোলিং করার সুযোগ পাননি তিনি। তারপরও অলরাউন্ডার হিসেবেই বিশ্বকাপে গেলেন। সেখানে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ওপেন করেছিলেন এনামুল হক বিজয় ইনজুরিতে পড়ায়। এ ছাড়া বিশ্বকাপ জুড়েই ওপেন করেছেন। নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চোখ ঝলসে দেওয়া দুটো ছোট ছোট ইনিংস খেলেছিলেন।
দেশে ফেরার পর পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে প্রমোশন পেয়ে ওপেনার হলেন। ২০১৭ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর পর্যন্ত সেই ভূমিকাতে দূরন্ত পারফরম করছিলেন। এই পারফরম্যান্সের পরও তাকে কেনো ওপেনিং থেকে সরানো হলো, সেটাই ছিলো রহস্যের প্রথম প্রশ্ন।
এই সময়ে ৭টা ফিফটি ছিলো তার। ১২৭ অপরাজিত, ৯০, ৮৮ অপরাজিত, ৮৭ অপরাজিত; এরকম সব ভয়াবহ ইনিংস ছিলো তার পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।
২০১৮ এশিয়া কাপ থেকে শুরু হলো সৌম্যর ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে গভীর পরীক্ষা নীরিক্ষা। তিনি নামতে নামতে ৭ নম্বরেও নেমে গেলেন! দেশে ফেরার পর ৩ নম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরির করার পরের দুটো ম্যাচে ৬ ও ৭ নম্বরে ব্যাট করলেন ক্যারিবিয়দের বিপক্ষে। আবার ৩ নম্বরে ফিরে ৮০ রান করলেন।
কিছুদিন আবার ৩ নম্বরে থিতু হলেন। আবার ফিরলেন ওপেনিংয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টানা তিন ম্যাচে ৭৩, ৫৪ ও ৬৬ রান করলেন। বিশ্বকাপেও ওপেন করলেন; তেমন কিছু করতে পারলেন না।
বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে দলে নেওয়া সৌম্য সরকার এখন পর্যন্ত ৫৮টি ওয়ানডে ম্যাচে ৫৭.১ ওভার বল করার সুযোগ পেয়েছেন। তাতে শিকার করেছেন ১০ উইকেট।
এই গেলো ওয়ানডে ক্যারিয়ার। এবার আসেন লিমিটেড ওভারের আরেক ভার্শন টি-টোয়েন্টিতে।
টি-টোয়েন্টিতেও শুরু করেছিলেন ওপেনিংয়ে। সেখানে গোটা কয়েক ৩০-৪০ রানের ইনিংসও ছিলো। তারপরও এই ফরম্যাটে তাকে ৩, ৪, ৫, ৬, এমনকি ৭ নম্বরেও ব্যাটিং করানো হয়েছে। এই রকম টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানকে ২০ ওভারের খেলায় ৬-৭ নম্বরে খেলানোর জন্য একাদশে রাখার দরকার কী, সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি কখনো।
টেস্টে আবার শুরু হয়েছিলো ৭ নম্বরে। সেখান থেকে ৬ নম্বর হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই ওপেনিং করেছেন। ওপেন করে ক্রাইস্টচার্চে ৮৬, গলে ৭১ রানের ইনিংস খেলার রেকর্ড আছে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে টানা তিন ইনিংসে ৭১, ৫৩ ও ৬১ করেছিলেন ইনিংস শুরু করে।
সর্বশেষ নিউজিল্যান্ড সফরে আবার ৫ নম্বরে নেমেছিলেন। সেখানে ১৪৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন।
আচ্ছা, এই যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট দলে সৌম্য ছিলেন না, এটার ব্যাখ্যা কী? একটা সিরিজ আগেই কঠিনতম কন্ডিশনে সেঞ্চুরি করে এসেছেন। তারপর আফগানিস্তানের বিপক্ষে একটা ম্যাচে ব্যর্থ হয়েছেন; ওই ম্যাচে সবাই ব্যর্থ ছিলেন। তারপর দুটো সিরিজ বিয়ের ছুটিতে ছিলেন। পরের সিরিজে বিশাল টেস্ট স্কোয়ডে তিনি থাকবেনই না; এটার ব্যাখ্যা কী হতে পারে!
সে ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। তা যদি থাকে, তাহলে তাকে বায়ো বাবলের বাইরে থেকে ডেকে একাদশে নেওয়ার মতো কী ঘটলো? এর মধ্যে কোথায় কোন খেলায় সৌম্য সরকার নিজেকে ‘ভালো’ প্রমাণ করেছেন যে, তাকে সরাসরি একাদশে নিয়ে নিতে হলো!
এই হলো অবস্থা! এই হলো রহস্যময়তা!
এই পুরো চিত্রটা আপনাকে একটা বার্তাই দেবে যে, এই তরুন ক্রিকেটারকে ৬ বছরে থিতু হওয়ার জন্য এতোটুকু সময় দিতে পারেনি ম্যানেজমেন্ট। আর সে কারণেই এখন পর্যন্ত একটা পরিচয় গড়ে ওঠেনি তার।
এই কারণেই কেবল একজন রহস্য-মানব হয়ে আছেন সৌম্য সরকার।