ফেরেঙ্ক পুসকাস, দ্য গ্যালোপিং মেজর

১৯৮৬ সালে যখন ফুটবল বিশ্বকাপ হয়েছিল তখনই শেষবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ালিফাই করেছিল হাঙ্গেরি। তাই এ যুগের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে হাঙেরির ফুটবল কিংবা এর খেলোয়াড়রা পরিচিত নাই হতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি বেশ ভালো রকমের ফুটবল ভক্ত হয়ে থাকেন তবে একজন হাঙ্গেরিয়ান ফুটবলারের নাম অবশ্যই শুনে থাকবেন। তিনি হলেন ফেরেঙ্ক পুসকাস।

যিনি ফুটবলের ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন। পুসকাসের জন্ম ১৯২৭ সালে। এপ্রিলের দুই তারিখ। হাঙেরির বুদাপেস্ট শহরে।

ছোট বেলা থেকেই চামড়ায় তৈরি গোল বলের খেলাটার প্রতি দারুণ আকৃষ্ট ছিলেন তিনি। হাঙ্গেরিতে কিসপেস্ট নামে একটা দল ছিল। অনেক ছোট বয়স থেকেই তিনি সেই দলের জুনিয়র সাইডে খেলতে থাকেন। বয়স যখন তার মাত্র ১৬, তখনই তিনি সিনিয়র দলে সুযোগ পান।

মাত্র ১৮ বছর বয়সেই জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয় পুসকাসের। ১৯৪৮ সালে হঠাৎ করে হাঙ্গেরির সেনাবাহিনী কিসপেস্ট দলটাকে দখল করে নেয়। সেনাবাহিনীর দল হওয়ায় দলের সবাইকে সৈনিকসুলভ উপাধি দেওয়া হলো। কেউ লেফট্যানেন্ট, কেউ সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট। পুসকাস পেলেন মেজর উপাধি।

তাঁকে ডাকা হত ‘গ্যালোপিং মেজর’ নামে। আর্মিতে থাকার সময় আর্মির ফুটবল দলে খেলতেন। গ্যালোপিং মেজর নাম পান সেখান থেকেই। ইংরেজিতে গ্যালোপ (gallop) শব্দের অর্থ দ্রত ছোটা। বল পায়ে খুব দ্রুত ছুটতে পারতেন তাঁর সতীর্থরা তাঁকে এই নাম দেন।

১৯৫৩ সালে হাঙ্গেরি জাতীয় দল ইংল্যান্ডে গেলো একটি প্রীতি ম্যাচ খেলতে। সেই ম্যাচ শুরুর আগে ইংল্যান্ড দলের একজন খেলোয়াড় হাঙ্গেরি জাতীয় দলের ক্যাপ্টেনকে দেখিয়ে মন্তব্য করলেন, ‘আমরা ওদেরকে খুন করবো। বুঝেছো? আমরা ওদেরকে খুন করে ফেলবো মাঠে।’

ইংলিশদের দুর্ভাগ্য যে হাঙ্গেরির ক্যাপ্টেন ছিলেন গ্যালোপিং মেজর ওরফে ফেরেঙ্ক পুসকাস নিজেই। এর পরের ৯০ মিনিটে যা হল তার জন্য হয়তো সেই ইংলিশ খেলোয়াড় বহুবার আফসোস করেছেন, বহুবার দু:স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছেন। নাক উঁচু ব্রিটিশদের অহংকার চূর্ণ করে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডকে ৬-৩ গোলে হারালো ‘ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স’ নামক এক অর্কেস্ট্রা যার কন্ডাক্টর ছিলেন ফেরেঙ্ক পুসকাস।

আহ! কি একটা দল ছিল তাঁদের। গ্রসিকস, জোসেফ বজসিক, জোসেফ জাকারিয়াস, ন্যান্দর হিদেকুটি, জোলটান জিবর, স্যান্ডর ককসিস আর ফেরেঙ্ক পুসকাস। কিসপেস্ট (যা কিনা পরবর্তীতে Honved নামে পরিচিত হয়েছিল) এর হয়ে তিনি পাঁচটি লিগ জেতেন। তবে পুসকাস স্মরণীয় হয়ে আছেন হাঙ্গেরি জাতীয় দলের হয়ে পারফর্মেন্সের জন্য। হাঙ্গেরির সেই দলটিকে ‘Mighty Magyars’ বলা হতো।

এই দলের উত্থান হয় ১৯৫০ সালে, আধিপত্য চলতে থাকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত। এর মাঝে তারা প্রবল প্রতাপে জিতে নেন ১৯৫২ সালের অলিম্পিক। ৫ ম্যাচে হাঙ্গেরি গোল করে ২০টি, বিপরীতে হজম করে মাত্র ২টি গোল। কোয়ার্টার, সেমি এবং ফাইনালে পুসকাস গোল করেন। তবে এসব কিছুর জন্যও পুসকাসকে ইতিহাস স্মরণ রাখবে না। তার দু’পায়ের কারুকাজে মুগ্ধ হতে হলে আপনাকে জানতে হবে ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপের ঘটনা।

হাঙ্গেরি যখন বিশ্বকাপে আসে তখন তারা ছিল টানা ২৭ ম্যাচে অপরাজিত (২৩ জয় আর ৪ ড্র)। তবে জয়ের জন্য না, হাঙ্গেরি চমক দেখানোটা শুরু করে ১৯৫৩ সালের ২৫শে নভেম্বর। ম্যাচটি হয়েছিল ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে। এই স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ড এর আগে কখনো ব্রিটিশ দ্বীপের বাইরের কোনো দলের কাছে কখনো হারেনি। ম্যাচটি হাঙ্গেরি জেতে ৬-৩ গোলে, পুসকাস ২টি গোল করেন। পুসকাস এবং তার দল শর্ট এবং লং পাসের একটি চোখ ধাঁধানো প্রদর্শনী দেখান সে ম্যাচে।

এই হাঙ্গেরি ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপ শুরুও করে ফেভারিটের মতো করেই। গ্রুপ পর্বে তারা দক্ষিণ কোরিয়াকে হারায় ৯-০ গোলে আর পশ্চিম জার্মানিকে হারায় ৮-৩ গোলে। কিন্তু তারা বিপদে পড়ে যায় পুসকাসকে ইনজুরিতে হারিয়ে। আগের ম্যাচ দুটোতে পুসকাস যথাক্রমে দুটি এবং একটি করে গোল করেন।

পুসকাসবিহীন হাঙ্গেরি ব্রাজিলকে হারায় কোয়ার্টার ফাইনালে। এই ম্যাচটি ইতিহাসে Battle of Berne নামে পরিচিত হয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভেজা ম্যাচটিতে মাঠে এবং মাঠের বাইরে খেলোয়াড়েরা মারামারি করে। ম্যাচে ৪২টি ফ্রি কিক, ২টি পেনাল্টির পাশাপাশি ৪ জনকে হুঁশিয়ারি প্রদান ও ৩ জনকে বহিস্কার করা হয়েছিল। ম্যাচ শেষেও ড্রেসিং রুমে তারা আবার মারামারিতে লিপ্ত হয়। তবে ম্যাচটি হাঙ্গেরি জিতে নেয় ৪-২ গোলে।

সেমিতে উরুগুয়েকেও ৪-২ গোলে হারিয়ে অনায়াসেই ফাইনালে উঠে যায় হাঙ্গেরি। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির মুখোমুখি ম্যাচে হাঙ্গেরি ছিল নিশ্চিত ফেভারিট। এমনিতেই গ্রুপ পর্বে হাঙ্গেরির বিপক্ষে পশ্চিম জার্মানি ৩-৮ গোলে হেরেছিল, তার উপর কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে তাদেরকে খেলতে হয়েছিল প্লে অফ। অঘোষিত চ্যম্পিয়ন যেন হয়েই ছিল হাঙ্গেরি, ফাইনালটি যেন ছিল শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা।

পুরোপুরি ফিট না হওয়া সত্ত্বেও মাঠে নেমেছিলেন পুসকাস। ৮ মিনিটের মাথাতেই হাঙ্গেরি ২-০ গোলে এগিয়ে প্রমাণ দেয় যে, তাদেরকে যে ফেভারিট ভাবা হচ্ছিল সেটি অমূলক ছিল না। পুসকাস ১ গোল করেন আর ১টি অ্যাসিস্ট করেন। কিন্তু জার্মানরা যে অন্য ধাতুতে গড়া। পরের ১০ মিনিটের মাঝেই তারা ২ গোল করে আবার ম্যাচে ফিরে আসে।

এর মাঝে বিরতির পর হাঙ্গেরির আরো দুটো বল গোলপোস্টে লেগে ফিরে আসে এবং পুসকাসের একটি গোল অফসাইডের জন্য বাতিল হয়ে যায়! খেলা শেষ হবার ৬ মিনিট আগে জার্মানি গোল করে এবং ম্যাচটি জিতে নেয়। দুর্ভাগা পুসকাস হয়ে যান এক অবিসংবাদিত ট্র্যাজিক হিরো। স্বদেশী ককসিস ৬ ম্যাচে ১১ গোল করলেও, মাত্র ৩ ম্যাচে ৪ গোল করেই গোল্ডেন বল জিতে নেন পুসকাস।

তবে সেই ম্যাচ হারলেও ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত হাঙ্গেরি আধিপত্য দেখিয়ে যায় ফুটবল মাঠে। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ৪২টি ম্যাচে জয় আর ৭টি ড্র এর বিপরীতে মাত্র ১টি ম্যাচে পরাজিত হয়েছিল তারা, সেটিই হলো পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে।

হাঙ্গেরিতে রাজনৈতিক সমস্যার কারণে পুসকাস এবং আরো কয়েকজন খেলোয়াড় দেশে না ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। এই সময়ে এসি মিলান এবং জুভেন্টাস তাকে দলে নেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু বুদাপেস্টে ফিরতে না চাওয়ার কারণে উয়েফা তাকে দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা দেয়।

এ কারণে তিনি ইউরোপে খেলতে পারেননি। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর তিনি ইতালিতে খেলতে চান কিন্তু তার বয়স এবং ওজনের কারণে কোনো বড় দল তাকে নিতে আগ্রহী ছিল না। এই সময়ে তিনি ইংলিশ লিগেও খেলার চিন্তা করেন, কিন্তু ভাষা না জানার কারণে সেখানেও খুব বেশী অগ্রগতি হয়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি যখন রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন, তখন তার বয়স ৩১ বছর।

রিয়াল মাদ্রিদে তার ক্যারিয়ারের যেন পুনর্জন্ম হয়। এখানেই তিনি আবার নিজেকে ফিরে পান। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ১০টি শিরোপা জেতেন, যার মাঝে ছিল ৫টি লিগ আর ৩টি চ্যম্পিয়ন্স লিগের (তৎকালীন ইউরোপিয়ান কাপ) শিরোপা। আরেক গ্রেট আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর সাথে জুটি গড়ে রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসকে নতুনভাবে লিখেন পুসকাস। এটি ছাড়াও ১৯৬২ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে হ্যাটট্রিক করার পরেও ইউসেবিওর বেনফিকার কাছে দল হারে ৫-৩ গোলে। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলেন।

খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার ছাড়ার পর তিনি কোচ হিসেবেও কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন, তবে আগের মতো এখানে তেমন সফলতা পাননি। সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল Panathinaikos-কে নিয়ে ১৯৭১ সালে ইউরোপিয়ান কাপ আর ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের রানার্স আপ হওয়া।

ফিফা থেকে পুসকাসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ২০০৯ সাল থেকে একটি পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। বছরের সবচেয়ে সুন্দর গোলদাতা এই পুরস্কারটি পাবেন। এই পুরস্কার প্রবর্তন সম্পর্কে তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার বলেন, ‘It is important to preserve the memory of those footballing greats who have left their mark on our history. Ferenc Puskás was not only a player with immense talent who won many honours, but also a remarkable man. FIFA is therefore delighted to pay tribute to him by dedicating this award to his memory,’

পুসকাস খেলোয়াড় হিসেবে খাটো এবং এবং কিছুটা মোটা ধাঁচের ছিলেন, বাতাসে খুব কার্যকর ছিলেন না। এছাড়া হাঙ্গেরির রাজনৈতিক অস্থিরতাও তার ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৫৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল হারলেও তার পারফর্মেন্স ছিল অসাধারণ। এই কারণেই হয়তো ভাগ্যের কিছুটা সহযোগিতা না পাওয়া সত্ত্বেও তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত হন। সত্যিকারের ফুটবলপ্রেমীরা পুসকাসকে কখনো এড়িয়ে যেতে পারবেন না। পুসকাসেরা ইতিহাসের নায়ক, হোক না কোনো ট্র্যাজিক কাহিনীর!

ম্যাচ প্রতি গড়ে ০.৯৯ টি করে ৭২৯গোলে সর্বকালের পঞ্চম সর্বোচ্চ গোলদাতা পুসকাস ২০০৬ সালের ১৭ নভেম্বর এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান।
কিন্তু ফুটবলপ্রেমীদের মনে আজীবন অমর হয়ে রয়ে যাবেন এই কিংবদন্তি।

লেখক পরিচিতি

Alien.............

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link