একজন বিদ্রোহী কিংবা কবি

বিদ্রোহী, কবি কিংবা অর্কেস্ট্রেটর; যেকোনো নামেই আপনি তাঁকে ডাকতে পারেন।

বিপ্লবী খেলোয়াড়-ম্যানেজার কিংবা দার্শনিক। যিনি নিজের মতামত আর যেটাকে ঠিক ভেবেছেন তার পক্ষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন আজীবন! কিংবা তিনি আমাদের মতই সাধারণ একজন যাকে বোঝার থেকে উপভোগ করাই শ্রেয়।

হ্যাঁ, তিনি ইয়োহান ক্রুইফ। ডাচ কিংবদন্তি, বার্সেলোনার বিপ্লবী ক্রুইফ।

কাতালুনিয়া তখন দাসত্বে বন্দী। ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত শক্তি তৈরি হয়নি তখনও কাতালুনিয়ার মানুষদের কাছে। বরং তারা তীর্থের কাকের মত চেয়েছিল একজন নায়কের জন্য। যিনি তাদের হতাশা থেকে মুক্তি দেবেন, নতুন জীবন কিংবা যৌবনের ছায়া হয়ে দাঁড়াবেন, শক্তি হবেন এতদিন শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করার।

কাতালুনিয়া এবং স্প্যানিশ প্রজাতন্ত্রের লোকেরা সেই নায়কের অপেক্ষাতেই বসে ছিলেন। কিন্তু তাঁদের সামনে নায়কের আবির্ভাব ঘটেনি; আবির্ভাব ঘটেছিল এক কবির, যে কবি কবিতা লিখতে নাম লিখিয়েছিলেন কাতালুনিয়ায়। সত্তরের দশকে কাতালুনিয়া কাঁপানো সে কবি এসেছিলেন কাতালানরূপে নয়, বরং ডাচ নায়কের বেশে। সর্বজয় করতে।

সালটা ১৯৭৫, কাতালুনিয়ায় তখন মুখোমুখি বার্সেলোনা আর মালাগা। ম্যাচের মাঝেই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল সেই কবি আর রেফারির মধ্যে। বিদ্রোহী কবি তার দলের জন্য এক পা পিছু হটবেন না, ক্লাবের আর্মব্যান্ড যার হাতে, তিনি অন্তত লড়াই থেকে পিছু হটতে পারেন না। ফলাফল, পকেট থেকে তুলে লাল কার্ড দেখিয়ে দিলেন বেরসিক রেফারি।

মাঠে পুলিশ ঢুকল, লাঠির বাড়িও পড়ল দু-চার ঘা। অফিসাররা ঘিরে নিয়ে যখন ক্রুইফকে মাঠের বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন তখনই নিজের হাত থেকে আর্মব্যান্ড খুলে ফেললেন তিনি। সোনালি-লাল আর্মব্যান্ডে চুমু খেয়ে ভিড়ের দিকে আঙ্গুল তুলে বুঝিয়ে দিলেন, আমি তোমাদেরই একজন। আমি কাতালুনিয়ার ক্রুইফ। ইয়োহান ক্রুইফ!

ক্রুইফের জন্ম হয়েছিল যুদ্ধ-পরবর্তী আমস্টারডামে। ফলে ইয়োহানের জন্য মুক্ত চিন্তা করা বেশ সোজাই ছিল। নেদারল্যান্ড তখন স্বাধীন, লোকজনও নিজের মতামত দিতে পেরে খুশি; ইয়োহানও বড় হচ্ছিলেন নিজের মুক্ত চিন্তার সাথে সাথেই।

যে কারণে আয়াক্স থেকে যখন কাতালুনিয়ার মত একটা জায়গাতে এসে পরলেন ইয়োহান, তখন আর নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি। আজীবন অত্যাচারিত, নিষ্পেষিত হওয়া জনগনের সামনে আশার মুক্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ক্তুইফ। কাতালানরাও আশা ভরসা ফিরে পেতেছিল তার দুই পায়ের জাদুতে। আজীবন মুক্ত চিন্তা করে আসা মানুষটি যখন খুঁজে পেলেন নিজেকে মুক্ত চিন্তা করা অত্যাচারিতদের মধ্যে, তখন আর নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি।

হয়ে গিয়েছিলেন নিজেই কাতালুনিয়ার একটা অংশ। তাই যখন ফ্রাঙ্কোর পুলিশের কাছে শুনলেন কাতালুনিয়ার স্বাধীনতার জন্য কথা বলা ১৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করার কথা, তখনই কারাগারে চিঠি লিখলেন হাভিয়ের ফলচ বরাবর, ‘হাভিয়ের, বার্সায় তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায়।’

বার্সায় ক্রুইফের সময়ে নিষিদ্ধ ছিল কাতালান কোনো নাম রাখা, ক্রুইফও ফাঁকি দিতে জানতেন। বড় ছেলের জন্মের সময় স্ত্রীকে নিয়ে পাড়ি দেন আর্মস্টাডার্ম। ছেলে জন্ম নিলে নাম রাখেন ‘জর্দি’। ইংরেজিতে যা ‘জর্জ’ নিজের ছেলে যাতে আজীবন অংশ হয়ে থাকতে পারে কাতালান ইতিহাসের, তার জন্য এটুকু তো করাই যায়।

১৯৭৮ বিশ্বকাপের আগে বুক চিতিয়ে বলেছিলেন তিনি যাবেন না আর্জেন্টিনা। সবার সামনে তুলে ধরেছিলেন আর্জেন্টিনায় চলা গনহত্যা আর টর্চার সেলের কথা। টর্চার সেল থেকে মাত্র হাজার মিটার দূরে আপনি কীভাবে ফুটবল খেলতে পারেন?

স্বস্ত্রীক বার্সেলোনার রাস্তায় ইয়োহান ক্রুইফ!

ক্রুইফ ছিলেন গানস্লিংগার, ১৪ নম্বর শার্ট আজীবন নিজের করে রেখেছিলেন। প্রথম যেদিন নেমেছিলেন ফুটবল জার্সি গায়ে, সেই থেকে ১৪ নম্বর জার্সি তার সাথী। তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারে বলার মত গল্পের অভাব নেই, আয়াক্স-বার্সার জার্সিতে কী না জিতেছেন? তার অভিষেক হয়েছিল আয়াক্সের সর্বকালের সবচেয়ে বাজে ফলাফলের মৌসুমে, নিজেদের লিগে ১৩তম হতে হয়েছিল তাকে।

আর সেখান থেকেই তিনি আর রিনাস মিশেলস মিলে আয়াক্সকে জিতিয়েছিলেন টানা তিন ইউতোপিয়ান কাপ, জিতেছিলেন তিন ব্যালন ডি’অর। মাঠে তৈরি করেছিলেন টোটাল ফুটবল নামে অদ্ভুত এক ফুটবলের। যে ফুটবলের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো সকলে, গল্পের শুরু থেকে শেষ সবটা লেখা হত কবিতার খাতার মত করে। নিজের ড্রিবলিং স্বত্বা দিয়ে তৈরি করেছেন বিখ্যাত ‘ক্রুইফ টার্ন’।

বার্সেলোনায় এসে বার্সেলোনাকে আবারও তুলে ধরেছিলেন স্পেনের মঞ্চে। ফুটবলে যখন একের পর এক ম্যাচে বাজে খেলে হারিয়ে যাওয়ার পথে বার্সা, তখনই তখনই বার্সাকে জেতাতে শিখিয়েছিলেন ক্রুইফ। অবসর নিয়েছিলেন, এরপর তা ভেঙ্গে ফেরতও এসেছেন, আয়াক্সের জার্সিতে সর্বজয়ী হয়েও তার গল্প ফুরোয়নি। নিজের ক্লাবের কাছ থেকে যথাযথ সম্মান না পেয়ে ভিড়েছিলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফেয়েনুর্দে।

তাদের হয়ে প্রতিশোধ নিয়েছেন আয়াক্সের সামনে দিয়ে লিগ শিরোপা জিতে। ক্রুইফের গল্পটা এমনই, যেখানে পা ফেলেছেন, সব জিতেই পরে ক্ষান্ত হয়েছেন। শুধু জাতীয় দলের জার্সি বাদে। নেদারল্যান্ডের মত দলের সর্বেসর্বা ছিলেন তিনি। শুধু শিরোপাটাই জেতা হয়নি তার, তা বাদে বাকি সব চমক দেখানো হয়েই গিয়েছিল তার।

ডাগ আউটে এসেও ক্ষান্ত হননি ক্রুইফ, আয়াক্সের পর নাম লিখিয়েছিলেন বার্সেলোনায়। গড়ে তুলেছিলেন বার্সেলোনার ড্রিমটিম। ১৯৯২ এর বার্সেলোনা দল নিয়ে কী করেননি, প্রথম বারের মত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের স্বাদ এনে দিয়েছেন কাতালানদের। এত বছর কাতালুনিয়ায় খেলে তাদের হ্রদ মাঝারেই ছিলেন তিনি। শুধু গল্পের পরিসর আরো বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর আগে, বার্সেলোনা ছিল ইউরোপের আন্ডারডগ, বার্সেলোনা নামটা বুকে কাঁপন ধরানো দুরে থাক, পারলে দ্বিতীয় সারির দল নিয়েই নেমে পরতো অনেকে। কিন্তু তিনি বদলে দিয়েছেন সবটা, বার্সেলোনার নাম শুনলেই এখন অনেক দলের হাঁটু কাঁপে। মাস ধরে পরিকল্পনা চালায় তাদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। যার কারিগর একান্তই ইয়োহান জোসেফ ক্রুইফ।

ক্যাম্প ন্যূর বাইরে ক্রুইফের ভাস্কর্যের নিচে বড় বড় করে লেখা, ‘Salid y Disfrutad’ যার অর্থ, ‘Go out and enjoy’। ৯২ ফাইনালের আগ মুহূর্তে নিজের দলের খেলোয়াড়দের স্পষ্টত করে বলেছিলেন কথাগুলো। এক লাইনেই সবটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যেন। ফুটবলটা ক্রুইফের কাছে কোনো সামান্য খেলা নয়, বরং এল্পটা আর্ট, সৌন্দর্যের শেষ কথা। এই খেলায় বল নিয়ে বসে থাকলে চলে না, বল চলতে হয়, সব সময় আর্টকে সম্মান করতে হয়।

বাণিজ্যিকীকরণের এই যুগে ফুটবল আর উপভোগের জায়গায় নেই, বদলে যাওয়া ফুটবলের সাথে কতটা মানাতে পারতেন ক্রুইফ, সেটা নিয়েও প্রশ্ন থাকে। দিনশেষে ফুটবল তো আর মালিকদের হাতে বন্দি কোনো খেলা নয়, বরং ফুটবল আনন্দের মাধ্যম। যাতে যারা খেলে, আর দেখে; দুজনেই সমান। ক্রুইফ সেটাই বলে গিয়েছেন আজীবন, মাথা উঁচু করে, কবিতা কিংবা বিপ্লবের গল্প লিখে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link