ক্রিকেট: মনের খেলা না ব্যাট-বলের!

বিষয়টা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এই বিষয় নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন, খুব শক্ত (গৌতম ভট্টাচার্যের ভাষা ধার করে বলি পাথরে কোঁদা) মন না হলে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সাফল্য পাওয়া মুশকিল। আবার আরেক দল বলছেন ক্রিকেট খেলাটা মাঠেই হয়। পুরোটাই মাসল মেমোরি, ক্রিকেটিং প্রতিভা এবং ফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে।

চারিত্রিক কাঠিন্য বা মনের খুব একটা ভূমিকা ক্রিকেট খেলায় নেই। এবার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। অত্যন্ত তৃণমূল স্তরেই ক্রিকেট টা খেলেছি। তা সেখানেই উপলব্ধি করেছি, যেদিন মন ভালো থাকতো সেদিন খেলাটাও ভালো হতো। আবার যেদিন মন খারাপ বা অস্থির হয়ে থাকতো, তখন খেলাটা ঠিক সেই পর্যায়ে পৌঁছতো না যা আমি চাই।

এখানে মনে রাখার বিষয়, আমার প্রতিভা ও একটা ফার্স্ট ডিভিশন খেলোয়াড়ের প্রতিভা নিশ্চয় এক না। তাই জানতে ইচ্ছা করে, পর্যাপ্ত পরিমান ক্রিকেটিং স্কিল বা প্রতিভা থাকলে (এবং প্রতিপক্ষও যখন মোটামুটি একই রকম প্রতিভার অধিকারী) এই মানসিক ওঠা-পরা গুলো কি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব?

ক্রিকেট যদি শুধু ব্যাট বলেরই খেলা হয়ে থাকে, তবে তো কেনিয়া বা জিম্বাবুয়ে কখনো ভারত বা পাকিস্তানকে হারাতেই পারবে না। পরিসংখ্যানই শেষ কথা বলা মানুষরা হয়তো এখানে অঘটন বা ‘ল অব অ্যাভারেজ’-এর কথা বলবেন। এখানে একটা সাম্প্রতিককালের টেস্ট ম্যাচের কথা বলি। ভারত যে লর্ডসে জিতলো, তার পিছনে কারণ কি? দুদিকেই যুক্তি দেওয়া যেতে পারে।

প্র্যাকটিকাল ক্রিকেট পণ্ডিতরা বলবেন, দুই দলের ক্রিকেটিং দক্ষতার এতটাই আকাশ পাতাল ফারাক যে ভারত জিততই। এই ম্যাচে সময়ের অভাবে না জিতলেও, সিরিজ জিতবেই। আবার আরেকদল বলবেন, ইংল্যান্ড ম্যাচটা মানসিক কাঠিন্যের অভাবেই হেরে গেলো। অথবা ভারতের মানসিক কাঠিন্যের জোরে। নাহলে যে পিচে বুমরা ও শামি প্রায় শ’খানেক রান করে ফেলেন, সেখানে ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা মাত্র ঘন্টা তিনেকের ব্যবধানে কিভাবে ধরাশায়ী হয়?

আর যাই হোক, বার্নস-সিবলিরা নিশ্চয় শামি বুমরার চেয়ে ভালো ব্যাটসম্যান। আর একটা টেস্ট ম্যাচের কথা বলি। অস্ট্রেলিয়া বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ২০১১। ম্যাচের মাঝামাঝি সময়ে অস্ট্রেলিয়া কত এগিয়ে। কিন্তু হঠাৎ করে ৪৭ এ অল-আউট। আর সেই একই পিচে একদিনের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা চতুর্থ ইনিংসে ২৩৬ রানে ২ উইকেট। যেখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ইনিংসের স্কোর যথাক্রমে ৯৬ ও ৪৭। ৪৭ এ অলআউট হবার পর অস্ট্রেলিয়ার আত্মবিশ্বাস তলানিতে।

দক্ষিণ আফ্রিকার ঠিক উল্টো। সেই আত্মবিশ্বাসে ভর করেই কিনা কে জানে দক্ষিণ আফ্রিকা জিতে গেলো। এই আত্মবিশ্বাসের একটা পোশাকি ইংরেজি নাম আছে – ‘মোমেন্টাম’। এই মোমেন্টামের তত্ত্ব মানলে পরের টেস্ট ও সিরিজ, দুটোই দক্ষিণ আফ্রিকার জেতা উচিত। অথচ অস্ট্রেলিয়া জোবার্গে পরের টেস্টেই চমকপ্রদ জিতলো। একই দলের বিরুদ্ধে একই দল নিয়ে। এই জয় কি শুধুই অস্ট্রেলিয়ার সেই ম্যাচের ক্রিকেটীয় ফর্মের জয়, নাকি চরম মানসিক ‘অস্ট্রেলিয়’ কাঠিন্যের? নাকি দক্ষিণ আফ্রিকার আত্মতুষ্টির হার?

এতক্ষণ যা বললাম তা তো দলগত পরিসরে। এবার ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত পরিসরে মানসিক কাঠিন্য, চরিত্র বা তার অভাব নিয়ে একটু কথা বলি। ড্যামিয়েন মার্টিনের সাথে সকলেই পরিচিত। মার্টিন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রথম খেলতে আসেন ১৯৯২ নাগাদ। এরপর ১৯৯৩-৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিডনি টেস্টে ম্যাচ সমান-সমান অবস্থায় মার্টিনের একটি অতি আক্রমণাত্মক স্ট্রোক অস্ট্রেলিয়ার হারের কারণ হয়ে দেখা দেয়।

অন্তত নির্বাচকরা তাই ভেবেছিলেন। এবং মার্টিন টেস্ট খেলার জন্যে যথেষ্ট শৃঙ্খলাপরায়ণ নন এই মর্মে বাদ দেন। প্রায় সাত বছর মার্টিন বাইরে ছিলেন। যখন ফিরলেন তখন একেবারে আলাদা মার্টিন। সত্যি বলতে অমন শালীন ও শৃঙ্খলাপরায়ণ অথচ সুদৃশ্য ব্যাটসম্যান আমি কমই দেখেছি। ২০০০ পরবর্তী মার্টিন মানসিক ভাবে ১৯৯৩-৯৪ এর মার্টিনের চেয়ে মানসিক ভাবে কঠিন কিনা সেটা আমি জানিনা। কারণ, ওনার কোনো জীবনী এখনো বেরোয়নি। বেরোলে নিশ্চয় জানবো।

ইংল্যান্ডের জোনাথন ট্রট অবশ্য মনকেই সবচেয়ে জরুরি মনে করেছেন। অতিরিক্ত ক্রিকেট খেলতে খেলতে ক্লান্ত, এবং সেই অবস্থায় জনসনকে খেলতে গিয়ে ক্রিকেট জীবনই শেষ হয়ে যায় ওনার। জনসনকে খেলার আগে যদি কিছুদিন বিশ্রাম পেতেন, তাহলে নাকি আরো তরতাজা হয়ে নামতে পারতেন। ক্রিকেটীয় দক্ষতা সেখানে গৌণ।

মানসিক সুস্থতা বা স্টেবিলিটি নিয়ে ট্রেসকোথিক তাঁর জীবনীতে লিখেছেন। পিটারসেন বলেছেন। বেন স্টোকস, সাইমন বাইলস নিজের নিজের খেলা থেকে বিশ্রাম নিচ্ছেন। ইমরান খান নিয়েছেন। ২১ বছরের ক্রিকেট জীবনে মাত্র ৮৮ টেস্ট খেলেছেন। এগুলো কি শুধু শারীরিক ক্লান্তির কারণে? মনকে তরতাজা রাখার কোনো প্রয়াস কি এই বিশ্রাম গুলোর পিছনে নেই? আমি জানিনা। তাই প্রশ্নবোধক চিহ্ন। চায়ের কাপে (থুড়ি মন্তব্য বাক্সে) তুফান উঠুক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link