ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট। আধুনিক ক্রিকেটের চারপাশে ঘোরাফেরা করা এক বহুল ব্যবহৃত শব্দ। এই বিশেষ ম্যানেজমেন্ট ছাড়া নাকি এখন দীর্ঘকালীন ভাবে চোট আঘাত বাঁচিয়ে ক্রিকেট খেলা খুব মুশকিল। বিষয়টা সত্যি কি তাই? খেলতে গেলে তো চোট আঘাত লাগবেই। এটা খেলারই অঙ্গ। কিন্তু এই হারে! মুষ্টিমেয় দুই-তিনজন খেলোয়াড় ছাড়া কেউ বলতে পারবে না যে আমি গত দু’বছরে একটাও আন্তর্জাতিক ম্যাচ মিস করিনি চোট বা বিশ্রামের জন্য।
একজন খেলোয়াড় যদি নূন্যতম দুই বা তিন বছর চোটবিহীন অবস্থায় নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে না খেলতে পারেন তা হলে কিসের প্রয়োজন এই বিজ্ঞানসম্মত ট্রেনিং পদ্ধতি, ঘন্টার পর ঘন্টা জিম সেশন, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে ফিজিক্যাল ট্রেনার, ম্যাসীওর, ডায়েটিশিয়ান ভর্তি টিম নিয়ে বিশ্ব ভ্রমন করার। এর থেকে অনেক ভালো ছিল আলী ইরানির ব্যবস্থা। সঙ্গে শুধু প্যারাসিটামল আর আইস ব্যাগ, কিন্তু খেলোয়াড়রা চোটের জন্য ম্যাচ মিস করতেন কম!
মনে করে বলতে পারবেন যে চোট আঘাত সমস্যায় জাভাগাল শ্রীনাথ বা অনিল কুম্বলেরা ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ ছয় বছরে কোন বড় সফর মিস করেছেন? শচীন তেন্ডুলকর সেই মাত্র ষোল বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা শুরু করেছেন কিন্তু চোট এর জন্য প্রথম যখন টেস্ট মিস করলেন তখন তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেরিয়ার বয়স প্রায় দশ বছর।
নব্বইয়ের দশকে যে তিনজন ভারতের হয়ে সবচেয়ে বেশি সময় খেলেছেন সেই শচীন আজহার কুম্বলের মধ্যে ১৯৯২ এর সেপ্টেম্বর (এই সময়টা এই কারনে ধরা যেহেতু এর আগে কুম্বলে নিয়মিত ছিলেন না) থেকে ১৯৯৯ এর ফেব্রুয়ারী, এই দীর্ঘ সময়ে কেউ একটাও টেস্ট ম্যাচ মিস করেননি এবং তারপরেও যে আজহার খেলতে পারেনি সেটা অন্য অন্য কারনে।
হ্যাঁ, খেলতে গিয়ে কেউ কোন আঘাত পেলেন, হাড় সরে যাওয়া বা ভেঙে যাওয়া, এগুলোর পেছনে না হয় একটা যুক্তি আছে, কিন্তু বাকি ক্ষেত্রে? অবশ্য অনেকেই বলবেন যে এখন যে হারে ক্রিকেট খেলা হয় সেটা কি তিরিশ বছর আগে হতো? ঠিকই তো! আর কম সময়ের মধ্যে বেশ সংখ্যক ম্যাচ খেললে তো চোট এর সম্ভবনা বাড়বেই। তাহলে একটু দেখা যাক যে তিরিশ বছর আগে কত কম খেলা হতো। প্রয়োজনে আরও পেছনে যাওয়া যাক।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৪। টানা উনিশ বছর ধরে প্রফেশনাল ক্রিকেট খেলেছিলে কপিল দেব। মোট ২৭৫ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ এবং ৩০৯ টি লিস্ট এ ম্যাচ। অর্থাৎ ১৯ বছরে মোট ৫৮৪ ম্যাচ। বছর প্রতি গড়ে ৩০.৭৫ টি ম্যাচ। এর মধ্যে ১৩১ টি টেস্ট ম্যাচ আছে। আর যে সময়কালের মধ্যে তিনি এই ১৩১ টি টেস্ট খেলেছিলেন সেই সময়ে ভারত খেলেছিল ১৩২ টি টেস্ট। অর্থাৎ মাত্র একটি টেস্ট দীর্ঘ সতের বছরে তিনি মিস করেছিলেন এবং সেটিও চোট সংক্রান্ত কারণে নয়।
মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। দীর্ঘ কুড়ি বছরের ক্যারিয়ারে প্রথম শ্রেণি এবং লিস্ট ‘এ’ মিলিয়ে মোট ৬৬২টি ম্যাচ খেলেছেন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ৩৩.১টি ম্যাচ। এই কুড়ি বছরে চোট সংক্রান্ত কারণে কতগুলো ম্যাচ উনি খেলতে পারেননি?
এ যুগের অন্যতম সেরা ফিট খেলোয়াড়, বিরাট কোহলি গত ১৫ বছরে প্রথম শ্রেণি, ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে (আইপিএল ব্যতীত) মোট ৪৭৫টি ম্যাচ খেলেছেন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ৩১.৬৬টি ম্যাচ। কপিলের থেকে প্রতি বছরে গড়ে একটি ম্যাচ বেশি, আজহারের থেকে দেড় খানা কম। তাহলে অতিরিক্ত ক্রিকেট কোথায় খেলতে হচ্ছে আইপিএল ব্যতীত?হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। এখন যেটাকে অতিরিক্ত ক্রিকেট বলা হচ্ছে সেটা শুধুমাত্র আইপিএল।
এটা ঠিক যে এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আগের থেকে অনেক বেশি হচ্ছে, সামগ্রিক ক্রিকেট নয় (আইপিএল ব্যতীত)। কপিল আজহারদের সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেট, কাউন্টি, ট্যুর ম্যাচ এগুলোও নিয়মিত খেলতে হত। যেটা বর্তমান ক্রিকেটাররা খেলেন না। বিরাট এর অতি বড় ভক্তকেও উত্তর দেওয়ার আগে এক মিনিট ধরে ভাবতে হবে যদি তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে কোহলি শেষ কবে দিল্লীর হয়ে রঞ্জি খেলতে নেমেছেন।
শুধু তাই নয়, তখন বিদেশ সফরে এত খেলোয়াড় একসঙ্গে যেতেন না, থ্রো ডাউন স্পেশালিস্ট বলে কিছু ছিল না, পর্যাপ্ত ও ভালো মাপের স্হানীয় নেট বোলারও সবসময় পাওয়া যেত না। ফলে ব্যাটারদের নেট প্র্যাকটিসও দিতে হতো দলের নিয়মিত বোলারদের। সেই অবস্থায় এবং আলী ইরানির যুগে দাঁড়িয়ে একজন ভারতীয় ফাস্ট বোলার যাঁকে কিনা দলের প্রয়োজনে ৫০০০ টেস্ট রানও করতে হয়েছে, তাঁকে একটা টেস্টও বসতে হয়নি চোটের জন্য এটাতো আজকের দিনে এক কথায় অকল্পনীয়। স্বপ্ন।
এই স্বপ্নের আর একটু ভিতরে প্রবেশ করতে চান? উপরে যে হিসেবটা দেওয়া হলো সেটা ম্যাচ কেন্দ্রিক। ওটাকে যদি দিন কেন্দ্রিক করা যায়? কপিলের টেস্ট এবং বাকি ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট ম্যাচের অনুপাত যেখানে ১৩১/২৭৫, আজহারের ৯৯/২২৯ কোহলির ক্ষেত্রে সেটা ৯৯/১৩১ অর্থাৎ প্রফেশনাল ক্রিকেট খেলার জন্য প্রতি বছর কতদিন মাঠে কাটাতে হয়েছে এই হিসেব করতে বসলে দ্বিধাহীন ভাবে কপিল-আজহার অনেক বেশি এগিয়ে থাকবেন কোহলির তুলনায়।
কারণ, অঙ্ক বলছে কপিল যেখানে প্রতি বছরে গড়ে ১৫টা, আজহার সাড়ে ১১টা প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন কোহলি সেখানে খেলেছেন সাড়ে আট খানা। অর্থাৎ নূন্যতম তিনদিন করে ধরলেও কপিলকে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ (যার মধ্যে পাঁচ দিনের টেস্ট আছে) খেলার জন্য প্রতি বছর কোহলির তুলনায় প্রায় ২১দিন (আজহারের ক্ষেত্রে ৯ দিন) বেশি মাঠে কাটাতে হয়েছে।
এখন কোহলি প্রতি বছর যে অতিরিক্ত টি-টোয়েন্টি (দেশের হয়ে) এবং একদিনের আন্তর্জাতিক খেলছেন সেই সংখ্যাটা কখনোই ২১ নয়। ওয়ানডে এবং দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টির জন্য গড়ে প্রতি বছর কোহলি ২৩ দিন মাঠে থাকেন আর আজহার লিস্ট এ খেলার জন্য প্রতি বছর গড়ে ২১ দিন করে মাঠে থাকতেন। অর্থাৎ অঙ্ক বলছে সব মিলিয়ে আজহার গড়ে প্রতি বছর ৭ দিন বেশি খেলতে নামতেন, পাঁচ দিনের টেস্ট ধরলে এটা আরও বাড়বে। তাও শুনতে হয় অতিরিক্ত ক্রিকেটের জন্য খেলোয়াড়দের এত চোট আঘাত!
আজ কোন বোলার পরপর তিনটে সিরিজ খেলতে পারছে না, টিমের সম্ভবত সব থেকে ফিট খেলোয়াড় বিশ্রাম থেকে ফিরে এসে দুটো টেস্ট খেলেই চোট পেয়ে গেলেন। আর একজন তো ক্রিকেটের ‘কুম্ভকর্ণ’। ছয় মাস ফিট, তো ছয় মাস চোট। যদিও যুদ্ধের সময়ে বিশেষ প্রয়োজনে অনেক কষ্টে কুম্ভকর্নের ঘুম ভাঙিয়ে যুদ্ধ করানো গেছিল কিন্তু এনার ক্ষেত্রে তো সব ডাক্তার ফিজিও ফেল মেরে গেলেন।
হাজার চিকিৎসাতেও তিনি বড় সিরিজের আগে ফিট হন না। কিন্তু এনারা সবাই ফিট থাকেন আইপিএল এর সময়ে। তখন কেউ সেকেন্ড টিয়ার হ্যামস্ট্রিং নিয়ে খেলে যাচ্ছেন তো কেউ হাতে একাধিক সেলাই নিয়ে শতরান করে আসছেন।
যদিও সামাজিক মাধ্যমে বেশ কিছু মানুষের কাছে তিনি হাসির খোরাক, কিন্তু সুনীল গাভাস্কার অনেক দিন আগেই বলেছিলেন ক্রিকেট খেলার জন্য ‘জিম ফিট’ খেলোয়াড় নয়, বেশি প্রয়োজন ‘ক্রিকেট ফিট’ খেলোয়াড়। অবশ্য তিনি বোধহয় তখন জানতেন না যে এঁরা ‘জিম ফিট’ও নন আবার ‘ক্রিকেট ফিট’ ও নন, এঁরা আসলে ‘আইপিএল ফিট’ খেলোয়াড়।