সৌরভ-ধোনি ও যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্ত

ক্রিকেট মাঠে অধিনায়কের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তাঁদের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের উপরেই অনেক সময় নির্বাচিত হয় কিছু ক্রিকেটার। দলের খেলার পরিকল্পনা তৈরি করে অধিনায়ক।

ভারতের ক্রিকেটে বিভিন্ন সময় কিংবদন্তিতুল্য কিছু অধিনায়ক এসেছেন। টাইগার পতৌদি থেকে অজিত ওয়াদেকার। কাপিল দেব থেকে আজহারউদ্দীন। হাল সময়ের সৌরভ গাঙ্গুলি থেকে মহেন্দ্র সিং ধোনি।

সবাই দলের প্রয়োজনে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে সিদ্ধান্তের ফল ছিলো খুবই কার্যকরী। সৌরভ গাঙ্গুলি আর ধোনির কিছু সিদ্ধান্তের ফলাফল ছিলো ক্রিকেট মাঠে ভারতীয় ক্রিকেটারদের দাপট বৃদ্ধির কারণ। সেসব সিদ্ধান্তের ওপর ভর করেই আজকের অবস্থানে এসেছে ভারতীয় ক্রিকেট।

  • শেবাগ-ধোনিতে আস্থা ছিল ধোনির

২০০০ দশকের গোড়ার দিকে একজন ওপেনারের খোঁজে ছিলো ভারতীয় দল। এমন একজন ওপেনারকে খোজা হচ্ছিলো যে কিনা টেস্টে দূর্দান্ত শুরু এনে দিতে পারে। ব্লুমফন্টেইনে ভারতের হয়ে মিডল অর্ডারের এক দূর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করে অভিষেক ঘটে বীরেন্দ্র শেবাগের। দূর্দান্ত শুরুর পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষের সিরিজে বেঞ্চ গরম করেন তিনি। পরে ভারতীয় অধিনায়কের সিদ্ধান্তে ওপেনিং এ নামেন বীরেন্দ্র শেবাগ।

এটা মনে রাখার মত বিস্ময়কর হলো ভারতীয় দলের আগে আর কখনোই ওপেনিং করার সুযোগ পাননি শেবাগ। সব সময়ে খেলেছিলেন মিডল অর্ডারে। কিন্তু এরপরেও শেবাগকে ওপেনিংয়ে নামান অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। ওপেনিংয়ে অনেকবার ব্যর্থ হলেও তাকে কখনোই দল থেকে বাদ দেননি ভারতীয় অধিনায়ক। পরবর্তীতে ভারতীয় দলের সেরা ওপেনিং ব্যাটসম্যানে পরিণত হন শেবাগ।

চার বছর পর ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে তিন নম্বর পজিশনে ব্যাটিংয়ে পাঠান মহেন্দ্র সিং ধোনিকে। আর এই ম্যাচেই ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি।

  • রোহিত শর্মার সঠিক জায়গা

সৌরভের সিদ্ধান্তের ১১ বছর পর ভারতীয় ক্রিকেটে অন্যতম সেরা ওপেনার হিসেবে ক্যারিয়ার শেষ করেন শেবাগ। ওয়ানডেতে শেবাগের বিদায়ের পর ওপেনার সংকটে ভুগতে থাকে ভারতীয় দল। এই সময়ে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান রোহিত শর্মাকে ওপেনার হিসেবে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন ধোনি।

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ছিলেন রোহিত। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে সাধারণ মানের একজন ক্রিকেটার। কিন্তু যখনই তাকে ওপেনিং এ খেলানোর সিদ্ধান্ত নেয় তখনই বদলে যেতে থাকে রোহিত শর্মার ক্যারিয়ারের গতিপথ। ওপেনার হিসেবে এ মুহুর্ত্বে বিশ্বের অন্যতম মারকুটে ওপেনার রোহিত শর্মা। ধোনির এক সিদ্ধান্তেই সাধারণ মানের ক্রিকেটার থেকে বনে যান ইতিহাসের অন্যতম মারকাটারি ব্যাটসম্যানের তালিকায়।

  • যুবরাজ সিংকে ফেরানো

একজন বড় নেতার গুণ হলো প্রতিভাকে ধরে রাখার চেষ্টা করা। পারফর্ম না করার পরও যুবরাজকে সুযোগ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। এই আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন যুবরাজ। ২০০০ সালে আইসিসি নক আউট টুর্নামেন্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৮৪ রানের ইনিংস খেলেন যুবরাজ সিং।

কিন্তু এই ইনিংসের পর নিয়মিত পারফর্ম করতে পারছিলেন না যুবরাজ সিং। তারপরও ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ জানতেন যুবরাজ সিং একজন ম্যাচ বিজয়ী। খারাপ পারফর্মের পরও ২০০৩ বিশ্বকাপের দলে সুযোগ পান তিনি। বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত হাফ সেঞ্চুরি করে দলকে দূর্দান্ত জয় এনে দেন যুবরাজ।

নিয়মিত দলে সুযোগ পেয়ে ভা রতের ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন যুবরাজ সিং।

  • ধোনির রোহিত শর্মা এবং রবীন্দ্র জাদেজাকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত

২০১৩ সালের আগে মাত্র ৮৭ ওয়ানডেতে মাত্র ৩১ গড়ে রান করছিলেন রোহিত শর্মা। এছাড়াও প্রথম ৮৭ ম্যাচে ছিলো মাত্র ২ টি সেঞ্চুরি।  এই সময়ে ২০১২ সালে বাজে একটা সময় কাটাচ্ছিলেন রোহিত শর্মা।

 

১৩ ইনিংসে মাত্র ১৬৮ রান করেছিলেন। ২০১২ সালের পর জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন রোহিত। কিন্তু অধিনায়ক ধোনির সিদ্ধান্তে দলে ফেরেন রোহিত। শুধু দলেই ফেরেননি,দলে ফিরে হয়েছেন ওপেনার ব্যাটসম্যান।

২০০৯ সালে অভিষেক হয় ভারতীয় অলরাউন্ডার রবীন্দ্র জাদেজার। এই সময়ে জাতীয় দলের হয়ে বলা মত কিছুই করতে পারেননি তিনি। ২০১৩ সালে অধিনায়ক ধোনির সিদ্ধান্তে দলে ফেরেন তিনি। আর তখন থেকেই দূর্দান্ত ফর্মে রয়েছেন রবীন্দ্র জাদেজা।

  • সৌরভের হরভজনকে দলে ফেরানোর সিদ্ধান্ত

১৯৯৮ সালে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয় হরভজন সিংয়ের। কিন্তু জাতীয় দলে নিয়মিত ছিলেন না। ২০০১ সালে ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির জেদে দলে ফেরেন হরভজন। কিন্তু প্রথমে জাতীয় দলে ফেরাতে চাননি নির্বাচকরা। জাতীয় দলে অভিষেকের পর খুবই টাল মাটাল অবস্থায় ছিলেন হরভজন সিং।

জাতীয় দলে অভিষেকের পর বাবাকে হারান তিনি, এছাড়াও শৃঙ্খলা জনিত কারণে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমি থেকেও বাদ পড়েন হরভজন।  ২০০১ সালে জাতীয় দলে সুযোগ না পেলে হয়তো কানাডায় স্থানান্তরিত হতে পারতেন।

সৌরভের কারণে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে দূর্দান্ত পারফর্ম করেন তিনি। অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ৩২ উইকেট নিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেন। এরপর আর কখনই পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

  • ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল ওভার: যোগিন্দর শর্মার বাজিমাৎ

২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে শেষ ওভারে বোলিং করেন যোগিন্দর শর্মা। হরভজন সিংয়ের পরিবর্তে বোলিং করেন যোগিন্দর শর্মা। এ বিষয়ে ধোনি রবি শাস্ত্রীকে বলেন, ‘ভাজ্জি বোলিং করার জন্য নিজেকে শতভাগ মনে করছিলো না। এর পরিবর্তে যে বোলার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভালো করতে চায় তাকে দিয়ে বোলিং করানো ভালো।’

ধোনির এই বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি নেতা গিসেবে কতটুকু ভালো। তিনি ফলাফলগুলো নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন। তিনি জেনে বুঝেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন।

  • অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে অনিল কুম্বলেকে ফেরত আনা

২০০৩-০৪ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে সিরিজ ছিলো স্মরণীয় একটি সিরিজ।এই সিরিজে রাহুল দ্রাবিড়ের ডাবল সেঞ্চুরি, ভিভিএস লক্ষণের পুরো সিরিজ জুড়ে পারফর্ম, টেন্ডুলকারের ২৪১ রানের ইনিংস। বিভিন্ন কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই সিরিজ।

কিন্তু এই সিরিজে ভারতীয় দলের সবার পারফরম্যান্সের পরও এই সিরিজ স্মরণীয় হয়ে থাকবে অনিল কুম্বলের দূর্দান্ত ফর্ম। কিন্তু এই সিরিজের আগে নির্বাচকদের নজরে ছিলেন না তিনি। কিন্তু অধিনায়ক সৌরভের নাছোড়বান্দা স্বভাবের কারণে জাতীয় দলে সুযোগ পান অনিল কুম্বলে।

  • বিশ্বকাপের ফাইনালের তিন নম্বর: ধোনির রুদ্ধশ্বাস এক ইনিংস

২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালে যুবরাজের আগে ধোনির ব্যাটিংয়ে নামার বিষয়ে কে বা কারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সেটা এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি। কিন্তু পুরো বিশ্বকাপে ফর্মে না থাকা ধোনি ফাইনালে এক হাতে ম্যাচ জেতানোর কাজটি করেন। এর পিছনে রহস্য টা হলো – আগের আইপিএলে নিজ দলে মুরালিধরনের বোলিং নিয়মিত খেলার অভিজ্ঞতা।

মুরালিধরন আগের আইপিএলে ধোনির দল চেন্নাই সুপার কিংসে খেলৈন। ফলে ধোনি সহজেই মুরালিধরনের বোলিং বুঝতে পেরেছিলেন। এর ফলে সহজেই ব্যাটিং এ নেমে দলকে জয় এনে দিতে পেরেছিলেন। এছাড়াও নিজের উপর আত্মবিশ্বাস থাকায় ম্যাচ জেতা সহজ হয়ে উঠেছিলো তাঁর জন্য।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link