নিখুঁত এক গোলশিকারি

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ।

পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে ইতালিয়ান সিরি ‘এ’ তে। নাপোলি, জুভেন্টাস, এসি মিলানের আধিপত্যে ভাগ বসাতে উত্থান ঘটেছে ক্যালিস্টো তানজির পার্মার। শিরোপা জয়ের নেশায় রিস্টো স্টইচকভ, লিলিয়ান থুরাম, লরেঞ্জো মেনোত্তি, জিয়ানফ্রাঙ্কো জোলা, এস্পিরিলা, বুফনদের মত খেলোয়াড়দের দলে ভেড়ালেও শিরোপাটা আসছিল না পার্মার।

কোথায় যেন এক পরশ পাথরের অভাব অনুভব হচ্ছিল। ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে কার্লো আনচেলত্তি আসার পর প্রেসিডেন্ট তানজি দলে ভেড়াতে চান রবার্তো ব্যাজ্জিওকে। কিন্তু আনচেলত্তি বাজি ধরেন আর্জেন্টাইন এক তরুণের উপর। এক প্রকার জেদ করেই দলে ভেড়ান ১৯৯৭ অলিম্পিকে ৬ গোল করা দীর্ঘকায় তরুণকে।

কিন্তু হায়! পার্মাতে যোগ দিয়ে প্রথম ১২ ম্যাচে গোলশূন্য রইলেন। মৌসুমের শেষভাগে এসে ছন্দ পেয়ে শেষ করলেন ৩০ ম্যাচে ১২ গোল করে। পরের মৌসুমেই দেখালেন নিজের ক্ষমতা। পার্মার আক্রমণভাগে চিয়েসাকে নিয়ে রীতিমত ছেলেখেলা করলেন প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের সাথে।

৪৫ ম্যাচে ২৮ গোল করে দলকে জেতালেন কোপা ইতালিয়া এবং উয়েফা সুপার কাপের শিরোপা। ছয় ফুট উচ্চতার ছিপছিপে গড়নের এই ফুটবলার ছিলেন হার্নান জর্জ ক্রেসপো; ভক্তরা যাকে ভালোবেসে ডাকে ‘ভালদানিতো’ নামে।

১৯৭৫ সালের ৫ জুলাই আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে জন্মগ্রহণ করেন ক্রেসপো।

ছোটবেলায় বুয়েন্স আয়ার্সের রাস্তায় রাস্তায় ফুটবল খেলেই বড় হন তিনি। ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে রিভারপ্লেটের হয়ে ফুটবল জীবন শুরু করেন ক্রেসপো। প্রথম মৌসুমেই লাল-সাদা জার্সিতে আলো ছড়ান তিনি; ২৫ ম্যাচে করেন ১৩ গোল। পরের মৌসুমেই দলকে জেতান কোপা লিবার্তোরোসের শিরোপা।

এরপরই আর্জেন্টিনার অলিম্পিক দলে ডাক পান ক্রেসপো। যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে কোয়ার্টার এবং সেমিফাইনালে জোড়া করে দলকে ফাইনালে তুললেও ফাইনালে নাইজেরিয়ার কাছে ৩-১ গোলে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। ফাইনালেও এক গোল করা ক্রেসপো ৬ গোল করে বেবেতোর সাথে যৌথভাবে গোল্ডেন বুট জেতেন।

অলিম্পিকে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর ৪ মিলিয়ন ইউরোতে তাকে দলে ভেড়ায় পার্মা। পার্মার হয়ে চার মৌসুমে ৮০ গোল করেন ক্রেসপো। ২০০০-০১ মৌসুমে পার্মা অর্থনৈতিক সংকটে পড়লে ক্রেসপো ৩৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে যোগ দেন ল্যাজিওতে।

সেখানে নিজের প্রথম মৌসুমেই ২৮ গোল করলেও ল্যাজিও শিরোপা জিততে ব্যর্থ হয়। মৌসুম শেষ করে তৃতীয় স্থানে থেকে। পরের মৌসুমের বেশিরভাগ সময় ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে থাকলেও ২০ গোল করেন ল্যাজিওর হয়ে। পরের মৌসুমে ৩১.৫ মিলিয়ন ইউরোতে তাকে দলে টানে ইতালিয়ান জায়ান্ট ইন্টার মিলান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৌসুমের শুরুতেই ইনজুরিতে পড়ে চারমাসের জন্য মাঠের বাইরে চলে যান ক্রেসপো।

ইনজুরি থেকে ফিরে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ১২ ম্যাচে করেন ৯ গোল। পরের মৌসুমেই ১৬.৮ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে যোগ দেন ইংলিশ জায়ান্ট চেলসিতে। ব্লুজদের হয়ে প্রথম মৌসুমে ১২ গোল করেন তিনি। দ্বিতীয় মৌসুমে হোসে মরিনহো চেলসির কোচ হলে তিনি ক্রেসপোকে এসি মিলানে লোনে পাঠান।

পরবর্তীতে দ্রগবার অফ ফর্মের কারণে চেলসি যখন নিয়মিত বিরতিতে পয়েন্ট হারাচ্ছিল তখন মরিনহো ক্রেসপোর গুরুত্ব অনুধাবন করে তাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনেন এবং ক্রেসপো দলে ফিরেই চেলসিকে ইউরোপা লিগের শিরোপা জেতান। পরবর্তীতে ইন্টার মিলান এবং জেনোয়ার হয়ে খেলেন ক্রেসপো।

১৯৯৫ সালে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ দিয়ে আলবিসেলেস্তেদের হয়ে অভিষেক ঘটে ক্রেসপোর। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে ইকুয়েডরের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকসহ চার গোল করেন তিনি।

১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্ততার বদলি হিসেবে খেলেন আকাশী-সাদাদের হয়ে। ২০০২ সালের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ ৯টি গোল করেন তিনি। এমন কি দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের সর্বোচ্চ গোলদাতাও ছিলেন তিনি। বিশ্বকাপে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে পেছনে ফেলে মূল ফরোয়ার্ড হিসেবে ক্রেসপোকে দলে নেন কোচ মার্সেলো বিয়েলসা। কিন্তু ২০০২ এর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পরে যায়।

২০০২ বিশ্বকাপের পর গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা আর্জেন্টিনার জাতীয় দল থেকে অবসর নেন এবং ক্রেসপো তার স্থলাভিষিক্ত হন। তখন ক্রেসপো বাতিস্তুতার ৯ নম্বর জার্সিটি গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে ক্রেসপো আর্জেন্টিনার হয়ে ৭টি গোল করে পুনরায় নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন।

২০০৬ বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেই আইভরি কোস্টের বিপক্ষে গোল দিয়ে শুরু করেন ক্রেসপো। এছাড়াও তিনি সার্বিয়া-মন্টেনিগ্রো এবং মেক্সিকোর বিপক্ষের ম্যাচে গোল করেন। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা জার্মানির বিপক্ষে হেরে গিয়ে ২০০৬ বিশ্বকাপ থেকে ছিঁটকে যায়।

২০০৭ সালে কোপা আমেরিকাতে আর্জেন্টিনার হয়ে অংশ নেন ক্রেসপো এবং নিজদের প্রথম ম্যাচেই যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ৪-১ গোলে জয় পায় আর্জেন্টিনা। ৪টি গোল আসে ক্রেসপোর পা থেকে। ২য় ম্যাচে কলম্বিয়ার বিপক্ষে ১-০ গোলের বিনিময়ে আর্জেন্টিনা জয় পায়।

পেনাল্টি থেকে একমাত্র গোলটি করেন ক্রেসপো। ইনজুরির কারণে তিনি টুর্নামেন্টের বাকি ম্যাচগুলি খেলতে পারেননি। ২০০৭ সালের কোপা আমেরিকার পর ক্রেসপো জাতীয় দল থেকে আর ডাক পাননি। ক্রেসপো জাতীয় দলের হয়ে তার ফুটবল কারিয়ারে ৬৪ ম্যাচ খেলে ৩৫ গোল করেন। মেসি,বাতিস্ততা, আইমারের পর আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে তিনি চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতা।

২০১০ সালের জানুয়ারিতে ক্রেসপো জেনোয়া ছেড়ে পুরনো ক্লাব পার্মায় চুক্তিবদ্ধ হন। ২০১০-২০১১ মৌসুমে ক্রেসপো ক্লাব পার্মার হয়ে ১১টি গোল করে চতুর্থবারের মত পার্মার সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। এই ক্লাব থেকেই ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে হার্নান জর্জ ক্রেসপো তার ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি টানেন।

বুটজোড়া তুলে রাখার পর কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন ক্রেসপো। খেলোয়াড়ি জীবনের মত সেখানেও সফল এই আর্জেন্টাইন। আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় বিভাগের ক্লাব ডিফেন্সাকে নিয়ে রীতিমত ইতিহাস গড়েন তিনি, দলকে প্রথম বিভাগে তুলে আনার পাশাপাশি জেতান কোপা সুদামেরিকানার শিরোপা। বর্তমানে বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সাও পাওলোর কোচ হিসেবে নিযুক্ত আছেন ক্রেসপো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link