গত এক যুগে কোন উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা নেই, নেই কোন উয়েফা সুপার কাপও। এফএ কাপ নেই নয় বছর ধরে। সর্বশেষ পাঁচ বছরে জিততে পারেনি লিগ কাপ। এবং সবচেয়ে বড় কথা, দীর্ঘ ২৬ বছর পাওয়া হয়নি কোন প্রিমিয়ার লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ। ২০১৪, ১৫ সালের লিভারপুল ভক্তদের জন্য এসব কথা বড্ড পরিচিত।
কি একটা সময়ই কাটিয়েছিল তখন অলরেড সমর্থকরা। এরপর লিভারপুল ক্লাবে এসেছে ২০১৫ সাল, এসেছে নতুন একজন। তারপরই বদলে গিয়েছে দৃশ্যপট। নতুন মানুষটির অবদানেই ক্লাবটি এরপর জিতে নিয়েছিল বহুল প্রতীক্ষিত ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, আরাধ্য চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ এফএ কাপ আর লিগ কাপ। না, লিভারপুলের কোন তারকা খেলোয়াড়ের আগমনের কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে ইউর্গেন ক্লপের কথা – যিনি ডাগআউটে দাঁড়িয়ে বিপ্লব এনেছিলেন অলরেড শিবিরে।
জার্মানিতে জন্ম ইউর্গেন ক্লপের। সৌখিন ফুটবলার হিসেবে বেড়ে উঠেছিলেন একসময়, কিন্তু পেশাদার ফুটবলে বলার মত কিছু করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে বিদায় বলতে হয়েছিল ফুটবলকে। কিন্তু যার প্রেম ফুটবলের প্রতি, সে দূরে থাকবে কিভাবে। ইউর্গেন ক্লপ আবারও ফিরেছিলেন ফুটবলে, তবে এবার কোচ হয়ে। নিজে যা করতে পারেননি মাঠে, সেটি আবার কাগজে-কলমে শিখিয়ে দিতে শুরু করলেন শিষ্যদের।
জার্মানির দ্বিতীয় সারির দল মেইঞ্জ-কে কোচিং করানোর মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু হয় ইউর্গেন ক্লপের। একটা সময় ছিল, যখন বুন্দেসলিগার ধারেকাছেও ছিল না দলটা। এমনকি অন্যদলগুলোর তুলনায় সবচেয়ে ছোট স্কোয়াড, সব থেকে ছোট স্টেডিয়াম ছিল মেইঞ্জের। বলা চলে ধুঁকছিল দলটা। এমন দুঃসময়ের মাঝে সেই দলটাকে তীরে ভেড়ানোর দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে দেয়া হয়।
সবমিলিয়ে মেইঞ্জকে দিয়ে বড় কিছু করার সামর্থ্য তেমন ছিল না। কিন্তু ক্লপের ছিল ফুটবল-দর্শন, ছিল আবেগ, ছিল ভালোবাসা। আবেগ-ভালবাসা থাকবেও না কেন, এই দলের হয়েই তো প্রায় একযুগ ফুটবল খেলেছিলেন তিনি।
সব চ্যালেঞ্জে জিতেই প্রথম মৌসুম শেষেই মেইঞ্জকে তুলে বুন্দেসলিগাতে তুলে নিয়ে আনেন ইউর্গেন ক্লপ। সেখানেই শেষ নয়, এরপর এই দলটাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন উয়েফা কাপ পর্যন্ত। ২০০৮ সাল পর্যন্ত মেইঞ্জেই ছিলেন তিনি, এরপর দায়িত্ব নেন আরেক জার্মান ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের।
বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে ইউর্গেন ক্লপ কাটিয়েছেন আরো দুর্দান্ত কিছু সময়। ২০০৮ থেকে শুরু করে ২০১৫ এই সাত বছরে ডর্টমুন্ডের হয়ে অনবদ্য সব গল্প লিখেছেন তিনি। নিজের প্রখর ফুটবলীয়-মেধা দিয়ে গড়পড়তা দলটাকে তুলে এনেছিলেন সেরাদের কাতারে। ব্যাক-টু-ব্যাক বুন্দেসলিগা জিতেই ক্ষান্ত হননি, লিগে ফিরিয়ে এনেছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বীতা। বহু বছর বাদে আবারও জার্মান লিগ শিরোপার দৌড়ে দুই শক্ত প্রতিযোগিতার দেখা মিলেছিল। বায়ার্ন মিউনিখের আধিপত্য ভেঙ্গে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কালো-হলুদের শক্তি।
অন্যদিকে সাফল্যের জন্য হাহাকার করতেই ব্যস্ত ছিল ইংল্যান্ডের লিভারপুল নামের ক্লাবটি। জিততে থাকার পরেও তখন কেন জানি শিরোপার ছোঁয়া হচ্ছিল না অল রেডদের। শেষমুহুর্তে এসে খেই হারাচ্ছিল দলটি। এরই মাঝে অবসর নিয়েছিলেন ক্লাব কিংবদন্তি স্টিভেন জেরার্ড; দলের গোলমেশিন সুয়ারেজ আর উইঙ্গার রহিম স্টার্লিং লিভারপুল ছেড়ে গিয়েছিলেন। ক্লাবে থাকা ডিওক অরিগি, ক্রিশ্চিয়ান বেনটেকে বা রিকি ল্যাম্বার্ডরাও তখন ছিল অফ ফর্মে।
সাফল্যের খোঁজে বারবার কোচ বদলে ছিল লিভারপুল। সেসময় অবশ্য সেরা কোচ হিসেবে পরিচিত ছিল পেপ গার্দিওলা, জোসে মরিনহো, কার্লো আনচেলত্তি’রা। কিন্তু খোঁজাখুজি শেষে লিভারপুল বোর্ড জার্মানি থেকে খুঁজে আনে অর্ধপরিচিত পাগলাটে এক ফুটবল ব্যক্তিত্বকে। ২০১৫ সালের অক্টোবরে সেই ইউর্গেন ক্লপের হাতে তুলে দেয়া হয় লিভারপুলের দায়িত্ব৷ মেইঞ্জ-ডর্টমুন্ড জয় করে ইউর্গেন ক্লপ লিভারপুলে এসে তখন নতুন চ্যালেঞ্জ হাতে পান।
নতুন ক্লাবের হয়ে প্রথম মৌসুমটি খুব একটা ভালো কাটেনি ক্লপের, পয়েন্ট টেবিলে অষ্টম হয়ে সেই মৌসুম শেষ করে লিভারপুল। এরপরের টানা দুই মৌসুম পয়েন্ট টেবিলে চতুর্থ হয়ে শেষ করে কোনরকমে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করেছিল অলরেডরা।
কিন্তু এরই মধ্যে লিভারপুলের উন্নতিটা চোখে পড়ছিল সবার। বিশেষ করে নিজেদের সামর্থ্যদের মধ্যেই সেরা খেলোয়াড়দের দিয়ে দল সাজানোর কাজে ঈর্ষনীয় সফলতা অর্জন করেছিলেন ক্লপ। অল্প দামে তরুন ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার আর্নল্ড আর অ্যান্ডি রবার্টসনকে দলে ভিড়িয়ে তাদের দুইজনকে দিয়েছিলেন ফুলব্যাকের দায়িত্ব। এরপর ভার্জিল ভ্যান ডাইককে লিভারপুলে এনে দলের রক্ষনকে পুরোপুরি শক্ত করে তোলেন ক্লপ। এর পাশাপাশি আক্রমনে তখন সালাহ-মানে আর ফিরমিনো এর ত্রিফলা রীতিমতো প্রতিপক্ষের জন্য ত্রাস হয়ে উঠেছিল।
সবকিছুর উর্ধ্বে তখন নজর কেড়েছিল ইয়ুর্গন ক্লপের ‘গেগেনপ্রেসিং’। দুর্দান্ত এই ট্যাকটিক্সে বাজিমাত করে লিভারপুল। এই প্রেসিং ফুটবলের উপর ভরসা করেই লিভারপুল পুনরায় জেগে উঠে। শেষপর্যন্ত ২০১৮/১৯ মৌসুমের উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে খরা কাটায় অলরেডরা, পরের মৌসুমেই দীর্ঘ তিন দশকের সাধনার সমাপ্তি ঘটিয়ে ঘরে তোলে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। এর বাইরেও জিতে নিয়েছে লিগ কাপ আর এফএ কাপ।
সম্ভাব্য সব ট্রফি জেতা লিভারপুল এখন ইউরোপের সেরা ক্লাবগুলোর একটি। সব মিলিয়ে লিভারপুলের যে পুনর্জন্ম, তার পিছনে প্রধান কারিগর কিন্তু এই জার্মান ভদ্রলোক, ইউর্গেন ক্লপ। ডাগআউটে দাঁড়িয়ে পরিকল্পনা সাজানো ছাড়াও মাইন্ডগেমটা ভাল খেলতে পারেন ক্লপ। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিপক্ষের প্রশংসার করে তাদের উপর প্রত্যাশার চাপ ও মিডিয়ার নজরদারি বাড়াতে বেশ দক্ষ তিনি।
এত এত সাফল্যের পরেও ইয়ুর্গেন ক্লপ যদি তার লিভারপুল অধ্যায়ের দিকে ফিরে তাকান তাহলে নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন। কারন তার এই সাতবছরের সময়কালে তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলে দুইবারই মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়তে হয়েছে অলরেড বাহিনীকে। দুইবার মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে লিগ শিরোপা হাতছাড়া করতে হয়েছে। অথচ ভাগ্যের একটু সুদৃষ্টি ফেলে হয়তো তিনবার করে ঘরোয়া এবং ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিততে পারতেন ইউর্গেন ক্লপ।
প্রকৃতি নাকি ‘দ্বিতীয়’-কে মনে রাখে না, সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায় দ্বিতীয় হওয়া মানুষগুলো। কিন্তু লিভারপুলের হয়ে বারবার ‘দ্বিতীয়’ হওয়া এই ইউর্গেন ক্লপকে আজন্ম মনে রাখবে ‘অ্যানফিল্ড’। You’ll never walk alone এর সুরে পুরো গ্যালারি স্মৃতিতে লালন করবে এই জার্মানকে।