১৮ ডিসেম্বরের পর আমার মেসিকে নিয়ে আর কিছুই লিখতে ইচ্ছে করে না। স্পোর্টস স্টারের পোস্টার বাঁধিয়ে এনে রাখলাম ঘরে। মেসি একটা অদ্ভুত হাসি হাসছেন। এমন হাসি, আমাদের পনেরো বছরের পার্টনারশিপে এই প্রথম দেখলাম। একদম অচেনা।
আমার মনে পড়ছিল অনেকদিন আগে পড়া একটা বই-এর কথা। যেখানে পড়েছিলাম একটা অদ্ভুত গল্প। বিখ্যাত জিওলজিস্ট শুমেকার চেয়েছিলেন একটিবার চাঁদের মাটিতে পা রাখতে। কিন্তু এক ভয়ঙ্কর গাড়ি দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণ হারালেন।
তাঁর ইচ্ছে তাঁর জীবদ্দশায় হয়ত পূরণ হল না, কিন্তু নাসার লুনার প্রসপেক্টর যেদিন চাঁদে পাড়ি দিল, তার ভেতর রাখা রইল শুমেকার চিতাভস্ম। সেই রকেটটি চাঁদের মাটিতে ক্র্যাশ ল্যান্ড করল, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, আর শুমেকার ছাই ছড়িয়ে গেল চাঁদের বুকে। এই ঘটনার পর শুমেকার স্ত্রী বলেছিলেন আজ থেকে আমার সমস্ত জ্যোৎস্নায় ও অফুরান হয়ে রয়ে গেল।
মেসির এই হাসি আমার অচেনা। এই হাসির ভেতরে মিশে গেছে আমার কৈশোর, হাফপ্যাডেল সাইকেলে যেতে যেতে রণ-মেসি ঝগড়া, ম্যাসচেরানোর অসহায় মুখ, প্যালাসিওর ১১৬ মিনিটে একটা মিস, আমার প্রথম পেপার কেটে স্ক্র্যাপবুকে লাগানো এসি মিলান ম্যাচ, চোদ্দ-র হাউ হাউ কান্না, কোপা সেন্টেনারির ডাগআউটের রুফ ধরে নুয়ে যাওয়া কাঁধ, একটা অসহায় মুখ, রথের মেলা থেকে কিনে আনা লা পুলগার ঝাপসা পোস্টার, কয়েকশো রাত, হাসি-কান্না-হীরা-পান্নার জহরত, আমার ইশকুলবাড়ি, মফসসলের কলেজ, মাঝরাতে ঘরজুড়ে অস্থির পায়চারি!
আর কিছু বেঁচে নেই যা আমাকে ব্যথা দেবে, আমি বিশ্বাস করি যন্ত্রণাই শাশ্বত৷ এই সর্বগ্রাসী হাসি আমার, থুড়ি আমাদের পনেরোবছরের কত কত মনকেমন গিলে নিয়েছে। যা পড়ে আছে, তা অবিনশ্বর। শাশ্বত। যতদিন বাঁচব ঐ হাসি একটা অক্ষয় অ্যালবাম হয়ে মনে করাবে আমার কৈশোরকে। চাঁদের মাটিতে শুমেকার ছাই-এর মতো, এই হাসির ভেতর আমাদের সমস্ত সেপিয়াটোনের ফ্রেম, সমস্ত ফেলে আসা সময় অফুরান হয়ে মিশে গেল।
এখন যে মেসি খেলে তাকে আমার অচেনা লাগে কেমন। আমার কী ভীষণ মনে হয়- সাতাশ বছরের জীবনে আমি, আর ছত্রিশ বছরের জীবনে মেসি, ফার্স্ট বাই লেনের আমি আর সুদূর রোজারিওর মেসি জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন হিসেবে একটাই তারিখ শেয়ার করে নিই- ১৮-ই ডিসেম্বর, ২০২২- একটা জীবন কাটিয়ে দেবার জন্য, এটুকুই কি যথেষ্ট না?