শূন্য হাতের জাদুকর

বিশ্বকাপ ট্রফি সব দেশের কাছেই বিশেষ সন্মানের বিষয়। কিন্তু ব্রাজিলের জনগণের জন্য বিশ্বকাপ একটি মৌলিক চাহিদার মত বিষয়।

যে দল ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ সেরা ট্রফি এনে দিতে পারবে, তাদেরকে মাথায় তুলে রাখে ব্রাজিলের জনগণ। ব্রাজিলের জনগণের কাছে ফুটবলই একটা ব্রত। যারা ব্রাজিলকে বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দিতে পারবে, তারাই ব্রাজিলের জনগণের কাছে গ্রেট ফুটবলারের তকমা পায়।

বিশ্বকাপ শিরোপা না জেতার পরও কিছু কিছু ফুটবলারকে সর্বদাই সন্মানের জায়গায় রাখবে ব্রাজিলের সমর্থকরা। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো জিকো। যাকে বলা হয়ে থাকে ‘সাদা পেলে’।

১৯৮২ সালের ব্রাজিল দলকে বলা হয় ব্রাজিলের ইতিহাসের সেরা ফুটবল দল, যাদের মধ্যে প্রতিভা কিংবা সামর্থ্য কোনোটিরই অভাব কোনো দিন ছিলো না। কিন্তু তাদের সাফল্যের খাতা শূন্য। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলের ইঞ্জিন কিংবা মাঠের প্রধান কারিগর ছিলেন জিকো।

খোদ পেলে নিজে মনে করেন তাঁর সমতুল্য ফুটবলার হলেন জিকো। তখনকার সময়ে ব্রাজিল দল যে ফুটবল খেলত তাদের সেই খেলার ধরণ পরিচিত ছিল ‘জোগো বোনিতো’ নামে। আর এই স্টাইলের খেলার প্রধান ধারক ছিলেন জিকো।

জিকো ব্রাজিলের হয়ে খেলেছেন ১৯৭৮, ৮২ এবং ৮৬ বিশ্বকাপ। কিন্তু দলকে কোনো বারই সাফল্য এনে দিতে পারেননি। দলকে সাফল্য এনে দিতে না পারলেও বিশ্বকাপের ব্যক্তিগত অর্জনের দিক থেকে বেশ সফল ছিলেন তিনি।

১৯৬৮ সালে জিকো ফুটবল খেলতেন জুভেনটিডের হয়ে। আর এই ক্লাব চালাতো তাঁর বড় ভাই এবং তাঁর বন্ধুরা। তখনই আমেরিকা সকার ক্লাবে ট্রায়াল দিয়ে তাদের হয়ে খেলার সুযোগ পান। সেখানেই প্রথম নজর কাড়েন জিকো। এরপর সেখানকার এক স্কাউট জিকোর বাবাকে বলেন জিকোকে ফ্ল্যামিঙ্গোতে ট্রায়াল দেয়ানোর জন্য। এই ঘটনার পর জিকো ফ্ল্যামিঙ্গোতে ট্রায়াল দিয়ে হয়ে যান ফ্ল্যামিঙ্গোর ফুটবলার। ক্যারিয়ারের স্বর্ণালী সময়ে খেলেন ফ্ল্যামিঙ্গোতে।

জিকো শুধু অনফিল্ড গোল করতেন না, ফ্রি-কিকেও ছিল তার বিশেষ দক্ষতা। যেকোনো দিক থেকেই বল জড়াতে পারতেন গোলবারে। এই বিশেষ ক্ষমতার জন্যই অনেক বেশি আলোচিত ছিলেন জিকো। তিনি শুধু অসম্ভব ভাল ফুটবল প্রতিভা নিয়েই এগিয়ে যাননি, তাঁর পরিশ্রমও তাঁকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে অনেক দূর।

ছোট বেলায় শারিরীকভাবে বেশ দূর্বল ছিলেন জিকো। তাঁর সংকল্প এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে হয়ে ওঠেন শারিরীকভাবে সামর্থ্যবান। আর এর ফলেই ফুটবলে বেশ উন্নতি করতে থাকেন জিকো।

ব্রাজিলের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে অভিষেক হয় ১৯৭২ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের বাছাই পর্বের ম্যাচে। এই সময়ে পাঁচটি ম্যাচ খেললেও গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের দলের জন্য বিবেচিত হননি তিনি। এই ঘটনায় বেশ ভেঙ্গে পড়েন জিকো। তিনি ফুটবলকে বিদায় জানাতে চান। এমনকি টানা ১০ দিন ফ্ল্যামিঙ্গোর অনুশীলনেও যোগ দেননি তিনি। পরবর্তীতে তাঁর বাবা এবং বড় ভাইয়ের কথায় আবারও ফুটবলে মনোনিবেশ করেন তিনি।

ব্রাজিলের হয়ে খেলেন তিনটি বিশ্বকাপ। ১৯৭৮ সালে ব্রাজিল দল ভাল করতে না পারলেও স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন জিকো। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে কর্ণার কিক থেকে গোল করেন তিনি। কিন্তু রেফারি তা বাতিল করে দেন, অভিযোগ ছিল খেলা শেষ হবার বাশি বাজার পর বল গোল লাইন অতিক্রম করেছে। এই বিশ্বকাপে বাজিলের তৃতীয় স্থান জিতেই বিশ্বকাপ আসর শেষ করতে হয়। এরপর ১৯৭৯ সালের কোপা আমেরিকাতেও তৃতীয় স্থান অর্জন করে ব্রাজিল।

এরপর আরও পরিণত হয়ে ১৯৮২ সালে বিশ্বকাপ খেলতে আসে জিকো, সক্রেটিসের ব্রাজিল। কিন্তু ইতালির পাওয়ার ফুটবলের কাছে হেরে দ্বিতীয় রাউন্ডেই বাদ যেতে হয় ব্রাজিলকে। দলীয়ভাবে পারফর্ম করতে না পারলেও ব্রাজিলের আটটি গোলে অবদান ছিল জিকোর। চারটি গোল নিজে করেছিলেন এবং চারটি গোলে সহায়তা করেছিলেন জিকো।কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা ব্রাজিল দল ছিল জিকো, সক্রেটিসদের নিয়ে গড়া এই দল।

এই বিশ্বকাপের পর আবারও বিশ্বকাপ খেলতে আসেন জিকো। কিন্তু ইনজুরির কারণে এই বিশ্বকাপে মাত্র এক ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন। বদলি হিসেবে নেমে ফ্রান্সের বিপক্ষে পেনাল্টিতে গোল করেন তিনি।

জিকো প্রথম নজর কাড়েন ১৯৮২ বিশ্বকাপের পারফর্মেন্সের কারণে। তখন ইতালিয়ান সিরি এ কর্তৃপক্ষ  বিদেশী ফুটবলারদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল। সেই সময়ে জুভেন্টাস, এসি মিলান, রোমার এর মত ক্লাবের কাছ থেকে সেখানে খেলার সুযোগ অফার পান তিনি।

কিন্তু সব ক্লাব বাদ দিয়ে যোগ দেন চার মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। তখন বড় ক্লাবের চাপের মুখে অর্থনৈতিক কারণ দেখিয়ে এই চুক্তি বন্ধ করতে চায় ইতালিয়ান ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কিন্তু উদিনেসের জনগণের চাপের মুখে সেই চুক্তি বাতিল করতে পারেনি তারা। এই চুক্তি বাতিলের উদ্যোগ নিলে উদিনেসের জনগণ আন্দোলন শুরু করে-হয় অস্ট্রিয়া, না হয় জিকো।

উদিনেস শহরের অবস্থান ইতালি-অস্ট্রিয়া সীমান্তে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই এলাকা দখল করে নেয় ইতালি। যদি তারা জিকোর সাথে চুক্তি করতে না দেয় তাহলে তারা আবারও অস্ট্রিয়ার সাথে চলে যাবার হুমকি দেয়। এই কারণেই পরে আর চুক্তি বাতিল করতে পারেনি।

একই মৌসুমে ইতালিতে আসেন ফ্রান্সের তারকা ফুটবলার মিশেল প্লাতিনি। প্রথম মৌসুম থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলেন তারা। প্লাতিনির চেয়ে  চার ম্যাচ কম খেলে হন লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। এরপর ম্যারোডানা নেপোলিতে যোগ দিলে এই প্রতিদ্বন্দ্বীতা পরিণত হয় ত্রিমুখী যুদ্ধে।

ইতালিয়ান লিগে দুই মৌসুম খেলে আবারও পাড়ি জামান ফ্ল্যামিঙ্গোতে। ইতালিতে থাকাকালীন সময়ে জিকোর ফ্রি-কিক নিয়ে গবেষণা হয়েছিল ইতালিতে।

১৯৮৫ সালে ফ্ল্যামিঙ্গোতে ফিরে এসে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত খেলেছেন তিনি। এরপর দুই বছরের বিরতিতে গিয়েছিলেন জিকো। ১৯৯১ সালে যোগ দেন কাশিমা অ্যান্টেলার্সে। সেখান থেকেই ১৯৯৪ সালে ফুটবলকে বিদায় জানান জিকো।

খেলোয়াড়ি জীবনকে বিদায় জানালেও ফুটবলকে ছাড়তে পারেননি জিকো। এরপর কোচিং করিয়েছেন বিভিন্ন দেশ এবং ক্লাবকে। জাতীয় দল হিসেবে জাপান এবং ইরাককে কোচিং করিয়েছিলেন জিকো।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link