ইমরান খানের নেতৃত্বে একটা দল, সম্ভবত পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা দলটি বিশ্বকাপ খেলতে যায় অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে। যেই বিশ্বকাপ আজীবন থেকে যাবে পাকিস্তানের ক্রিকেট প্রেমীদের হৃদমাঝারে, ১৯৯২ বিশ্বকাপ।
পাকিস্তান তো বটেই, বিশ্বক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে একেকজন কিংবদন্তি সেই দলটিতে। অধিনায়ক ইমরান খানের সাথে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, ইনজামুল হক, জাভেদ মিয়াদাদের মত সব গ্রেটরা। তবে পাকিস্তানের এই চাঁদের হাটে ছিলেন এক জ্বল জ্বল করা নক্ষত্র, মঈন খান। যদিও, পরিসংখ্যান দেখলে তাঁকে খুব সাদামাটা একজনই মনে হবে।
সেই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি পাকিস্তান দল। ২৬৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করা পাজিস্তানের শেষ ৮ বলে প্রয়োজন ৯ রান। এর মধ্যেই দলে সেরা ব্যাটসম্যানরা প্যাভিলিয়নে ফিরে গিয়েছেন। পাকিস্তানের সংগ্রহ তখন ৬ উইকেটে ২৫৫ রান। ব্যাট হাতে এবার সেই চাঁদের হাট থেকে নিজের আলো ছড়াতে বেড়িয়ে এলেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান মঈন খান।
পরের বলটিতে ছয় মেরে আগে থেকেই ফাইনাল নিশ্চিত করা ইংল্যান্ডকে জানান দিলেন, ‘আমরা আসছি, পাকিস্তান আসছে।’ এখন শেষ ৭ বলে পাকিস্তানের ফাইনাল খেলার জন্য প্রয়োজন মাত্র তিন রান। তবে সেদিন তাঁর আলোকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য যেন মুখিয়ে ছিলেন পাকিস্তানের এই ক্রিকেট নক্ষত্র। পরের বলেই অন্ধকারকে পিছনে ফেলে আবারও বল সীমানা পাড় করলেন। দলকে প্রথম বারের মত নিয়ে গেলেন বিশ্বকাপের ফাইনালে।
এত এত তারকার ভিড়ে তিনিই সেদিন সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়েছিলেন। তিনি যেন বললেন, ‘আলোকে চিনে নেয় আমার অবাধ্য সাহস/ ভেতরে এখন কি নেই কাপুরুষ অন্ধকার একা?’
মঈন খান ১৯৯২ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দলের একজন তো বটেই। সাথে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা দলেরও উইকেটের পিছনে ছিলেন তিনি। উইকেটের পিছনে তাঁর প্রাণবন্ততাও দলের বোলারদের উজ্জীবিত করতো। বলা হয়, সাইকলাইন মুশতাকের সেই রহস্যময়ী দুসরারও নামকরণ করেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান।
টেস্ট ক্রিকেটে ১২৪ টি ও ওয়ানডে ক্রিকেটে ২১৪ টি ক্যাচ ধরেছেন তিনি। তবুও তাঁর ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় দলে তাঁর জায়গার জন্য লড়াই করতে হয়েছে মঈন খানকে। আরেক কিপার ব্যাটসম্যান রশীদ লতিফের কাছে প্রায়ই জায়গা হারিয়েছেন। যেমন ১৯৯২ ও ১৯৯৯ বিশ্বকাপে তিনি থাকলেও ১৯৯৬ ও ২০০৩ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের উইকেট কিপার ছিলেন রশীদ লতিফ। বলা হতো মইন খানের থেকে টেকনিক্যালি ভালো উইকেটরক্ষক ছিলেন লতিফ।
তবে ব্যাটসম্যান হিসেবে লতিফকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি ক্রিজে থাকা মানে মাথা উচু করে আক্রমনাত্মক ব্যাটিং করে দলের জন্য লড়ে যাওয়া। শিয়ালকোটে এমনই একটি ইনিংস খেলেছিলেন শ্রীলংকার বিপক্ষে। সিরিজের তৃতীয় টেস্টে পাকিস্তানের জয়ের জন্য প্রয়োজন ৩৫৭ রান।
দলের বাকি সব ব্যাটসম্যানদের ব্যার্থতার দিনে একাই লড়ে গিয়েছিলেন। খেলেছিলেন ১১৭ রানের লড়াকু এক ইনিংস। ১৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে পাকিস্তানের হয়ে টেস্ট খেলেছেন মোট ৬৯ টি। ৩০ ছুঁই ছুঁই গড়ে করেছেন ২৭৪১ রান। ওয়ানডে ক্রিকেটেও তাঁর ঝুলিতে রয়েছে তিন হাজারেও বেশি রান। যদিও তাঁর এই ব্যাটিং পরিসংখ্যান দিয়ে ঠিক মঈন খানকে ব্যাখ্যা করে না। দলের জন্য বুক উচিয়ে লড়ে যাওয়া কিংবা উইকেটের পিছনে একজন মঈন খানকেও এই পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না।
২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান পাকিস্তান ক্রিকেটের এই অনুল্লেখ্য তারকা। বিদায়ের পরের বছর ঘরোয়া দল করাচি ডলফিনসেরব হয়ে এক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে সেঞ্চুরি করে বসেন তিনি। খেলেছেন ঠিক তিনি যেমনটা চিরকাল খেলেছেন সেভাবেই। ১১২ রানের ইনিংসটি খেলেছিলেন মাত্র ৫৯ বলে। সেটা টি-টোয়েন্টিতে কোনো পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানের প্রথম সেঞ্চুরি। সে বছরই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে হায়দ্রাবাদের হয়ে ২০০ রানের অপরাজিত এক ইনিংস খেলেন তিনি। সেটাই ছিল তাঁর শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ।
২০১৩ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) তাকে পাকিস্তান দলের ম্যানেজার ঘোষণা করে। পরের বছরই ডেভ হোয়াট্মরের জায়গায় তাকে পাকিস্তান জাতীয় দলের হেড কোচ বানানো হয়। তবে ২০১৫ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচের আগে অস্ট্রেলিয়ার এক ক্যাসিনোতে গিয়ে তোলপাড় তুলে ফেলেন তিনি। পরে বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়েই তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে পিসিবি।
পাকিস্তান ক্রিকেটেরই যেন নিয়তি এটা। যত বড় কিংবদন্তিই হোক, তাঁর জীবনে একটা সমালোচনার অধ্যায় থাকবেই!