ফিরে আসার ইতিহাস

কত ফুটবল ম্যাচ দেখেছি আমরা। সবগুলো ম্যাচের কথা মনে থাকার কথা নয় নিশ্চয়। তবে, এমন কিছু ম্যাচ আছে,  যেগুলো আমরা মনে রাখতে চাই। যে ম্যাচগুলো রূপকথাকেও হার মানায়। আমাদের মনে রোমাঞ্চ জাগায়, যে ম্যাচগুলো দেখলে আমরা অবিশ্বাস্য,  বিষ্ময়কর; এই শব্দগুলো ব্যবহার করতে বাধ্য হই।

এইরকম কিছু ম্যাচ হলো চ্যাম্পিয়নস লিগের সাড়া জাগানো কিছু কামব্যাক।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে সেরা কামব্যাকের কথা বললে, অনেক ম্যাচই সামনে আসবে। এরকম কিছু অসাধারণ কামব্যাকের গল্প হোক আজ।

  • বার্সেলোনা ৬-১ পিএসজি (ক্যাম্প ন্যূ)

চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ইতিহাসে সেরা কামব্যাকের কথা বললে, অবশ্যই আগে আসবে বার্সেলোনা-পিএসজি ম্যাচের কথা। ন্যূ ক্যাম্পে তো রীতিমত রুপকথা রচিত হয়েছিল। যেভাবে প্যারিসের ক্লাবটিকে কাঁদিয়ে বিদায় করেছিল স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নরা তা এখনো ফুটবলপ্রেমীদের চোখে লেগে আছে।

২০১৭ সাল। শেষ ষোলোর লড়াই।

প্রথম লেগে ৪-০ গোলে পিএসজির কাছে হেরেছিল বার্সেলোনা।  দ্বিতীয় লেগে শেষ ষোলের বাধা টপকাতে হলে চারের অধিক গোল দিতেই হতো বার্সাকে। সেই কাজটাই করে দেখালো তারা।

ম্যাচের ৩ মিনিটের মাথায় সুয়ারেজের গোলে এগিয়ে যায় বার্সা। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে পিএসজি ডিফেন্ডার কুরজাওয়ার আত্মঘাতি গোলে ব্যবধান দ্বিগুণ হয় বার্সার। দ্বিতীয়ার্ধের মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মেসির পেনাল্টি গোল। ম্যাচে ফিরতে বার্সেলোনার দরকার তখন আর মাত্র একটা গোল। এমন সময় গোল করে বসেন পিএসজির উরুগুয়ান স্ট্রাইকার কাভানি। হিসাবটা আরো জটিল হয়ে যায়। বার্সেলোনাকে জিতলে হলে তখন আরো করতে হবে ৩ গোল! ৮৮ মিনিটে গোল করে ম্যাচ আবার জমিয়ে দেন নেইমার।

ম্যাচের নাটকীয়তা তখনও অনেক বাকি। ইনজুরি টাইমে সুয়ারেজকে অবৈধ ভাবে বাধা দিলে পেনাল্টি পায় বার্সা। নেইমারের লক্ষ্যভেদে সমতায় ফেরে কাতালানরা। ইনজুরি টাইমের একদম শেষ মুহুর্তে আবারও নেইমারের ক্রস। পা ছুঁয়ে গোল করে বার্সেলোনাকে আনন্দে ভাসান সার্জিও রবার্তো। বার্সেলোনা অসম্ভবকে সম্ভব করলো!

  • চেলসি ৪-১ নাপোলি (স্টামফোর্ড ব্রিজ, লন্ডন)

২০১২ সালের কথা।

চ্যাম্পিয়ন্স লীগে শেষ ষোলোতে মুখোমুখি চেলসি-নাপোলি। প্রথম লেগে নাপোলির মাঠে ৩-১ গোলে হেরেছিল চেলসি। দ্বিতীয় লেগে নিজেদের মাঠে যা করলো চেলসি। তা তো রীতিমত অবিশ্বাস্য।

জিতলে হলে চেলসিকে দুইয়ের অধিক গোল দিতে হবে; কোনো গোলও হজম করা যাবে না। এমন সমীকরণ নিয়ে মাঠে নেমেছিল চেলসি। ২৯ মিনিটে হেডে গোল করে চেলসিকে এগিয়ে নেন দ্রগবা। এই এক গোলের লিড নিয়ে বিরতিতে যায় চেলসি। দ্বিতীয়ার্ধের মিনিট দুয়েকের মধ্যে কর্নার থেকে গোল করে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন জন টেরি। এরমধ্যে নাপোলি একটা গোল শোধ করে ম্যাচ জমিয়ে দেয়। ৭৫ মিনিটে পেনাল্টিতে গোল করে চেলসিকে সমতায় ফেরান ল্যাম্পার্ড। ম্যাচ গড়ায় এক্সট্রা টাইমে। ১০৫ মিনিটে ইভানোভিচের গোলে জয় নিশ্চিত হয় চেলসির।চেলসি তাঁদের ইতিহাসের সেরা জয়ের একটা পেয়ে গেল। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসের সেরা কামব্যাকের একটাও কি নয়?

  • রোমা ৩-০ বার্সেলোনা (স্টাডিও অলিম্পিকো, ইতালি)

২০১৮ সাল। চ্যাম্পিয়ন্স লীগের কোয়ার্টার ফাইনাল।

প্রথম লেগে বার্সা ন্যূ ক্যাম্পে  বরাবরের মতো নিজেদের আধিপত্য দেখাল। জিতলো ৪-১ গোলের বড় ব্যবধানে।

দ্বিতীয় লেগে ঘরের মাঠে সেই বার্সেলোনাকে মাটিতে নামিয়ে আনলো রোমা।  গুনে গুনে তিন গোল দিলো বার্সাকে। শুরুটা করেন এডিন জেকো। ম্যাচের বয়স যখন ৬ মিনিট; তখন রোমাকে এগিয়ে নেন এই বসনিয়ান ফরোয়ার্ড। এরপর দ্বিতীয়ার্ধে আরো দুই গোল দিয়ে বড় জয় নিশ্চিত করেছিল রোমা। দুই লেগ মিলিয়ে সমতা হলেও,  অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছিল ইতালিয়ান ক্লাবটি।

রোমার ইতিহাসের সেরা ম্যাচ তো বটেই; চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসের সেরা ম্যাচেরও একটি।

  • বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ৩-২ মালাগা (সিগনাল ইদুনা পার্ক)

২০১৩ সালের ঘটনা।

কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি বরুশিয়া ডর্টমুন্ড এবং মালাগা। প্রথম লেগে মালাগার মাঠে গোলশূন্য ড্র হয় ম্যাচ। সব রোমাঞ্চ মনে হই জমা ছিল দ্বিতীয় লেগের জন্য।

দ্বিতীয় লেগে মালাগা জয়ের জন্যই ডর্টমুন্ডের মাঠে নেমেছিল।  ম্যাচের ২৫ মিনিটেই তারা এগিয়ে যায়। প্রথমার্ধের মিনিট পাঁচেক বাকি থাকতেই ডর্টমুন্ডকে সমতায় ফেরান পোলিশ ও বর্তমান বায়ার্ন মিউনিখ স্ট্রাইকার লেওয়ানডস্কি। ৮২ মিনিটে আবারও এগিয়ে যায় স্প্যানিশ দলটি। ম্যাচের নাটকীয়তা যে তখনো অনেক বাকি। অতিরিক্ত সময়ে এবার ডর্টমুন্ডকে সমতায় ফেরান জার্মান মিডফিল্ডার মার্কো রয়েস। একদম অন্তিম মুহুর্তে মালাগার কফিনে শেষ পেরেকটা টুকে দেন ডর্টমুন্ডের ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার সানতানা। অবিশ্বাস্য। জয় নিশ্চিত হয় ক্লপের ডর্টমুন্ডের।

  • রিয়াল মাদ্রিদ ৩-০ উলসবার্গ  (সান্তিয়াগো বার্নাব্যূ)

২০১৬। চ্যাম্পিয়ন্স লীগ কোয়ার্টার ফাইনাল।

প্রথম লেগে উলসবার্গের মাঠে ২-০ গোলে হেরে যায় রিয়াল মাদ্রিদ। সব চাপ পিছনে ফেলে দ্বিতীয় লেগে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে যেভাবে ঘুরে দাঁড়ালো মাদ্রিদ পাড়ার দলটি তা সত্যি বিষ্ময়কর!

সম্ভব হয়েছিল অবশ্য ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কল্যাণে। ১৫ মিনিটে কারভাহালের পাস থেকে গোল করে এগিয়ে দেন রিয়ালকে। এর দুই মিনিট পরে টনি ক্রুসের কর্নার থেকে হেডে গোল করেন রোনালদো। ম্যাচ তখন ড্রয়ের দিকে এগোচ্ছিল।  ৭৭ মিনিটে আরেকবার রোনালদো ঝলক। অসাধারণ ফ্রিকিকে আরো একবার লিড এনে দেন রিয়াল মাদ্রিদকে।  নিজে পূরণ করেন হ্যাটট্রিক।  রিয়াল মাদ্রিদকে উপহার দেন,  তাদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা জয়ের একটি।

  • দেপোর্টিভো লা করুনা ৪-০ এসি মিলান (এস্টাডিও আবাঙ্কা রিয়াজর, স্পেন)

২০০৪ সাল। কোয়ার্টার ফাইনাল।

প্রথম লেগে ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার কাকার জোড়া গোলে মিলানের মাঠে ৪-১ গোলে হেরেছিল দেপোর্টিভো।

তাঁর প্রতিশোধটা তাঁরা নিল নিজেদের মাঠে দ্বিতীয় লেগে! ৪-০ গোলে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছিল মিলানকে।

৫ মিনিটে মিলানের জালে গোল উৎসব করে দেপোর্টিভো। ৩৫ মিনিটে তা দ্বিগুণ করে তারা। বিরতির এক মিনিটে আগেই  ৩ গোলের লিড নিয়ে ফেলে এই স্প্যানিশ দলটি। প্রথমার্ধেই মিলানের মনোবল ভেঙ্গে দেন দেপোর্টিভো।  ৭৭ মিনিটে আরো একবার বল জালে পাঠিয়ে মিলানের বড় পরাজয় নিশ্চিত করে দেপোর্টিভো।  কাকা, আন্দ্রে পিরলোদের কাঁদিয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে দেপোর্টিভো।

প্রথম লেগে এতো বড় ব্যবধানে হেরে,  দ্বিতীয় লেগে এমন দাপটে জয় নিয়ে ফেরা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে।

  • লিভারপুল ৪-০ বার্সেলোনা (এনফিল্ড)

২০১৯ সাল।

সর্বশেষ এমন সাক্ষী হয়েছিলাম আমরা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে। ন্যূ ক্যাম্পে প্রথম লেগে বার্সেলোনা লিভারপুলকে পাত্তাই দিলো না। লিও মেসির জোড়া গোলে ৩-০ গোলের বড় জয় তুলে নিয়েছিল।

দ্বিতীয় লেগে বার্সেলোনাকে অবিশ্বাস্য ভাবে হারিয়ে দিল লিভারপুল।এনফিল্ডে সেদিন বার্সেলোনাকে কাঁদিয়ে ৪-০ গোলে ম্যাচ জিতেছিল লিভারপুল। চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেরা কামব্যাকের একটা তো বলা চলে এই ম্যাচ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link