জার্মান মাস্টারদের বিশ্বজয়

গ্যারি লিনেকার একবার বুকভর্তি কষ্ট নিয়ে বলেছিলেন, ‘ফুটবল খেলায় ২২ জন ৯০ মিনিট ধরে এক গোল বলের পেছনে দৌড়ায় আর দিনশেষে জিতে জার্মানি।’

যদিও দু’দিন আগে কথাটা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে মেসেডোনিয়া; পুঁচকে এক দেশ ২০ বছর পর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে হারের স্বাদ দিয়েছে জার্মানিকে। তাতে করে কথাটা একেবারে মিথ্যে হয়ে যায়নি। ফুটবল ইতিহাসে জার্মানির গল্প যতটা গৌরবের, তার থেকে বেশি গ্রেটদের কাঁদানোর! একটু ভেবে দেখুন তো, চারবার বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরেছে জার্মানরা, কোনবার তারা গ্রেটদের অশ্রুসিক্ত করেনি? ১৯৫৪ সালে ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্স, ’৭৪ এ ক্রুইফের নেদারল্যান্ড, ’৯০ এ ম্যারাডোনা আর ২০১৪-তে এসে লিওনেল মেসি। সব জায়গাতেই অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গা থেকে শিরোপা নিজেদের ঘরে তুলে নিয়েছে জার্মানরা।

তবে আজকের গল্প শুধু জার্মান খেলোয়াড়দের নিয়ে নয়। বরং তাদের ডাগআউটে বসে থাকা লোকেদের নিয়ে। ডাগ আউট থেকে কখনও হাসিমুখে, কখনো উত্তেজিত হয়ে সামলে থাকেন নিজের খেলোয়াড়দের। জার্মান ইতিহাস বলে, মাঠের ভেতরে-বাইরে দুই জায়গাতেই সফল তারা।

মাঠের মধ্যে যদি লোথার ম্যাথিউস, মাইকেল বালাক, অলিভার কানদের তৈরি করে তারা, তবে মাঠের বাইরে তৈরি করেছে ইয়ুপ হেইকেন্স, ওটমার হিটজফিল্ড, হেলমুট শানের মতন কোচ। ফ্র্যাঞ্জ বেকেনবাওয়ারকে না হয় হিসেবেই বাইরেই রাখি।

ডাগ আউটে সেই জার্মান আধিপত্য এখনও বয়ে চলছেন ক্লপ, টুখেল, হ্যান্সি ফ্লিক, নাগেলসম্যানরা। গত মৌসুমই ধরুন। ইয়ুর্গেন ক্লপ লিভারপুলকে জেতালেন তাদের পরম আরাধ্য প্রিমিয়াত লিগ টাইটেল। গত ৩০ বছর ধরে যে শিরোপার জন্য তাদের প্রতীক্ষা, তা পূরণ হলো এই জার্মানের হাত ধরে। বায়ার্নের হয়ে হ্যান্সি ফ্লিক জিতলেন ট্রেবল।

শুধু কী তাই? গত বছরের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালেও মুখোমুখি হয়েছেন দুই জার্মান। রিয়াল-বার্সা বাদে গত ৪ চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী কোচই জার্মান। ফুটবলে জার্মান কোচেদের আধিপত্য বেশ স্পষ্ট। এ বছরের চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টারেও দেখুন না, ৮ কোচের মধ্যে ৪ জার্মান। ভাগ্যে থাকলে সেমি ফাইনাল হতে পারে অল জার্মান!

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটা সামনে চলে আসে, কী আছে এই জার্মান কোচেদের মধ্যে যে ফুটবল বিশ্বজুড়ে তাদের দাপট? আধুনিকযুগে বেশিরভাগ কোচই নিজের গণ্ডির বাইরে গেলেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেন, কিন্তু জার্মান কোচদের বেলায় সেটা ঠিক খাটে না। যদিও খুব কম কোচ জার্মানি ছেড়ে নিজেকে সফল করতে বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেরিয়েছেন, কিন্তু যারাই ছেড়েছেন সফল হয়েছেন। এমনকি বুন্দেসলিগার দল নিয়েও ফল পেতে সমস্যা হচ্ছে না তাদের। কিন্তু কেন?

  • ক্যারিশমা

ইয়ুর্গেন ক্লপ, থমাস টুখেল কিংবা অবসর নেওয়া ইয়ুপ হেইকেন্স, ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান; সবার মধ্যে জার্মান বাদে আরেকটা মিল কোথায় বলতে পারবেন? প্রত্যেকের মিডিয়া প্রেজেন্স। মিডিয়ার সামনে কখনোই নিজের বড়াই করা দূরে থাক, মিডিয়ার সামনে কখনো উচ্চবাচ্য করতেও দেখা যায়নি তাদের।

মাঠের বাইরে এত চাপের মধ্যে হাসিখুশি মানুষগুলো তাহলে ড্রেসিংরুমের ভেতরে কেমন হয়, তা নিশ্চয় বলে বোঝাতে হবে না। গার্দিওলা-মোরিনহোর মতন ড্রেসিং রুমের কড়া মাস্টার নন তারা। বরং হালকা চালে কথা বলে খেলোয়াড়দের ফ্রি করবার মানুষ তারা।

এই বছরের চ্যাম্পিয়নস লিগে থাকা চার জার্মান কোচের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ডিএফবি’র ফুটবল এডুকেশন কোর্স-এর মাধ্যমে। কোলনের পাশে হেনেফ শহরে বিশাল এক একাডেমি আছে জার্মানির। যেখান থেকে প্রতিবছর ভর্তি হতে পারেন মাত্র ২৫ জন কোচ। আর সেখান থেকে বেরিয়ে যাবেন শুধু ট্যাক্টিস-টেকনোলজি এক্সপার্ট হয়ে নন, বরং আধুনিক ফুটবলের সাথে মানিয়ে নিয়ে। এই একাডেমি থেকেই সার্টিফিকেট নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন জুলিয়ান নাগেলসম্যান, মার্কো রোজ। সেই একাডেমির আরেক গ্র্যজুয়েট ডানিয়েল নিয়েদকোস্কির মতে জিনিসটা এতো সোজাও নয়, ‘একজন কোচকে শুধু ট্যাক্টিক্যালি স্টং হলে চলে না, বরং তাঁর কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে নিজেকে তৈরি করতে হয়। যদি কোনো কোচের কথায় খেলোয়াড়েরা ভরসাই না পায়, কোচের মোটিভেশন যদি খেলোয়াড়দের জাগাতে না পারে, তবে বাকি সবকিছুই বৃথা।’

কথাটা হাস্যকর শোনালেও সত্যি। বর্তমান সময়ে কোচদের ছাড়াই হওয়ার অন্যতম বে একটা কারণ ড্রেসিং রুম হারিয়ে ফেলা। খোদ হোসে মোরিনহোই তিন ক্লাব থেকে চারবার বরখজাস্ত হয়েছেন এই দায় মাথায় নিয়ে। সেখানে জার্মান কোচদের ব্যাপারে এই অভিযোগ আসেই না বলতে গেলে। দলের ভেতরে-বাইরে সবসময় উৎফুল্ল মনোভাব, আলাদা একটা ক্যারিশমা সাফল্যের অন্যতম বড় একটা কারণ।

  • ওপেন মাইন্ডনেস

নাগেলসম্যানের ক্ষেত্রে শুধু ক্যারিশমাই নয়, বরং তার ওপেন মাইন্ডনেস তাঁকে এগিয়ে নিয়েছে দাফল্যের দিকে। মাত্র ৩৩ বছর বয়সী কোচ এখনই টেক্কা দিচ্ছেন ফুটবল বিশ্বের হেভি ওয়েট কোচদের সাথে। এর মূল কারণ তার নিত্যনতুন শিখবার ইচ্ছে।

সাধারণ মানুষের মতন ফুটবলেও এমন মানুষের অভাব নেই। নিজেদের পুরোনো ধ্যানধারণা আগলে রেখে নতুনের শরণাপন্ন না হওয়া। গার্দিওলা, মোরিনহো তাদের সাফল্য পাওয়া টিকি-টাকা কিংবা ডিফেন্সিভ বাস পার্ক ফুটবল নিয়ে এখনও সমানভাবে খেলে যাচ্ছেন। পেপ সাফল্য পেলেও মোরিনহো পাচ্ছেন না, কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই বললেই চলে। এই মৌসুমেই ডিফেন্সিভ ফুটবল খেলে ৬ ম্যাচে লিড হারিয়ে হেরেছেন মোরিনহো। মিডলম্যান আটকে দিলে এখনও পেপ গার্দিওলা অচল। কিন্তু জার্মান কোচেরা সবসময় তাদের প্রযুক্তি আর ট্যাক্টিস নিয়ে আপ-টু-ডেট।

নাগেলম্যান যখন প্রথম কোচিং করাতে আসেন, হফেনহেইমে তার বিশাল এক ‘ভিডিও ওয়াল’ ছিল, যাতে তার দলের প্রতিটি মূহুর্তের ভিডিও অ্যানালাইসিস ছিল পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে। যে সিস্টেম এখন পুরো বুন্দেসলিগায় ছড়িয়ে গিয়েছে।

এটুকুই নয়, বরং জার্মান লিগে প্রতি মৌসুমেই রেকর্ডসংখ্যক তরুণ খেলোয়াড় খেলেন। যাদের বেশিরভাগই উঠে আসেন যুবদল থেকে। আর তাদের নিয়েই নিত্যনতুন আইডিয়োলজি ট্রাই করে দেখেন জার্মান কোচেরা, ফলাফল আসে সাফল্যে!

  • ক্লপ-রাংনিক ইফেক্ট

“ক্লপ আর রাংনিক জার্মান ফুটবলকে নতুন এক পথের সন্ধান দিয়েছে। আপনি যদি সেই পথ ফলো না করেন তবে আর যাই হোক, বর্তমান জার্মান ফুটবলে আপনার জায়গা নেই।

রাফায়েল হোনিগস্টেইন, জার্মান ফুটবল বিশেষজ্ঞ

ইয়ুর্গেন ক্লপ আর রালফ রাংনিক, দুজনেই জার্মান ফুটবলের পুরনো সৈনিক। কোচিং করাচ্ছেন তাও দুই দশকের কাছেকাছি। বলতে গেলে তারা দুজনে জার্মান ফুটবলের ওল্ডার জেনারেশন, কিন্তু তাই বলে তারা পুরোনো ধ্যান-ধারণায় পরে আছেন, সেটা ভাবলে ভুল হবে। ক্লপ সবার আগে নজরে এসেছিলেন তার গেগেনপ্রেসিং ফুটবল দিয়ে। কিন্তু সেই গেগেনপ্রেসিংয়ে আর আগের ধার নেই।

ফুটবল বদলেছে, গত মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে রাজত্ব করা লিভারপুলকে এ মৌসুমে চোটের সাথ্যে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে। ক্লপ বদলেছেন, প্রিমিয়ার লিগের আশা শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন পন্থা কাজে লাগাচ্ছেন চ্যাম্পিয়নস লিগে।

অন্যদিকে রাংনিক, তিনি কাজ করেছেন লাইপজিগ দলের সাথে। যে লাইপজিগকে কয়েকবছর আগেও কেউ চিনতো না সেই দলকে পৌছে দিয়েছেন শীর্ষে। জার্মান ফুটবলের অন্যতম সেরা কাজ এসেছে ‘রেড বুল’ কোম্পানির হাত ধরে। আর সেখানেই ডিরেক্টর পদে ছিলেন রাংনিক।

তাদের সাফল্য বদলে দিয়েছে জার্মান ফুটবল। এখন জার্মান ফুটবলে বেড়েছে ফ্লুয়েডিটি। আর সেটাই ফলো করছেন তাদের উত্তরসূরিরা। রোজ, নাগেলসম্যানও সেই পথ ফলো করছেন। ফুটবল শুধু এখন মাঠেই নয়, কোচেরা শুধু কোচ নয় দলের ম্যানেজার হয়ে উঠতে হয় ভালো করার জন্য। আর সেটাই করে দেখাচ্ছেন নতুন কোচেরা। আর তাতেই আসছে সফলতা।

  • দ্যা ‘ফ্লিক’ ফ্যাক্টর

এক মৌসুমে সুযোগ পেয়েই পুরো দলকে বদলে দিয়েছেন হ্যান্সি ফ্লিক। নিকো কোভাচের সময় থাকা ছন্নছাড়া বায়ার্ন আর এই বায়ার্নের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এক মৌসুমে এসে কীভাবে জাদুর ছোয়ায় বদলে দিয়েছেন ফ্লিক? এর কারণটা দেখতে একটু পেছনে ফিরতে হবে।

ফ্লিক কোচিং করাচ্ছেন দেড় বছর ধরে। কিন্তু ডাগ-আউটে তার এই বসা প্রথম বসা নয়, বরং ডাগ-আউটে তিনি নিয়মিত মুখ ২০১৩ সাল থেকে। জার্মানির সহকারী কোচ হিসেবে জোয়াকিম লোর সাথে জিতেছেন বিশ্বকাপ। এমনকি লো নিজেও স্বীকার করেন, ব্রাজিলের বিপক্ষে ৭-১ গোলের জয়ে তার থেকে ফ্লিকের অবদান বেশি। ছয় বছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন কোচেদের সাথে থেকে নিজেকে পোক্ত করেছেন ফ্লিক। তাই যখন প্রয়োজন পরেছে তার, তিনি ঠিকই এসে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সকলকে। ফ্লিকের পার্সোনা অন্য কোচেদের মতন নয়, কিন্তু তার ট্যাক্টিক্যাল অ্যাবিলিটি এবং এক্সপেরিয়ান্স তাঁকে করেছে অনন্য। যে কারণে আসতে না আসতেই এক মৌসুমে ৬ শিরোপা জিতে ফেলেছেন তিনি।

বেশীরভাগ জার্মান কোচই মূল দলের দায়িত্ব নেন বিশাল এক পথ পেরিয়ে। এতদিন লেগে থাকার ফসল তাই মাঠে নামতে না নামতেই পান তারা। তড়িঘড়ির কাজ যে ভালো হয় না, সেটা চেলসি-জুভেন্টাস বুঝেছে ল্যাম্পার্ড-পিরলোকে ডাগ আউটে বসিয়ে।

ক্লপ, ফ্লিক, টুখেল, রাংনিক, নাগেলসম্যান, রোজ; প্রত্যেকে জার্মান কোচ হলেও প্রত্যেকের ফিলোসফি, কোচিং স্টাইল একে অপরের থেকে প্রচণ্ড আলাদা। ফুটবল বিশ্বে জার্মান কোচদের আধিপত্য দেখানোর পেছনেও তাদের এই ইউনিকনেস বড়রকম প্রভাব ফেলেছে। খালি চোখে ভিন্ন মনে হলেও তাদের উত্থান আর মিলগুলো জার্মানদের ইউনিটিকেও মনে করিয়ে দেয় বারবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link