টানা নবমবারের মতন বুন্দেসলিগা শিরোপা জিতে নিয়েছে বায়ার্ন মিউনিখ।
এটা অবাক করার মতন কোনো বিষয়ই নয়। আরেকটি পিছিয়ে যদি এই শতক থেকে শুরু করা হয়, তবে ২০০০-০১ মৌসুম থেকে মোট ১৪ বার এই বুন্দেসলিগা শিরোপা হাতে নিয়ে লিগ শেষ করেছে তারা। আর বুন্দেসলিগার পুরো ইতিহাসের দিকে তাকালে তা গিয়ে দাঁড়ায় ২৯-এ। ১৯৬৩ সাল থেকে শুরু হওয়া বুন্দেসলিগায় অন্য কোনো দলের সৌভাগ্য হয়নি এই শিরোপা ৫ বার বেশি জেতার। তো ঘুরে ফিরে প্রশ্নটা চলেই আসে, বুন্দেসলিগায় বায়ার্নের প্রভাব ঠিক কতটা? আর কেনই বা তা দিনকে দিন বেড়েই চলছে।
বুন্দেসলিগায় বায়ার্নের প্রভাবটা শুধু শিরোপা দিয়ে দেখলেই চলবে না। বুন্দেসলিগার ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১০ ট্রান্সফারের ৯টিই বায়ার্নের দখলে। আর জার্মানি ফুটবল দলের ইতিহাসের এমন কোনো বড় নাম নেই, যার গায়ে বায়ার্নের জার্সি চড়েনি। আর তার থেকেও অবাক করা বিষয় ফুটবল বিশ্বকাপে।
১৯৮২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিটি বিশ্বকাপ ফাইনালে অন্তত একজন বায়ার্নের খেলোয়াড় ছিলেনই। কিন্তু এই ডমিনেশন, এটা এক দশক কিংবা দুই দশক চালানো যায়। কিন্তু বুন্দেসলিগার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কীভাবে নিজেদের নাম ও প্রভাব-প্রতিপত্তি সমানভাবে ধরে রেখেছে বায়ার্ন?
ছোটবেলার এক কথায় উত্তরের মতন করে বলতে গেলে টাকা। আর সেটা বুন্দেসলিগার অন্য যেকোনো ক্লাবের থেকে বায়ার্নের অনেকগুণ বেশি। ২০২১ সালে ক্লাব রেভিনিউ থেকেই বায়ার্নের পকেটে ঢুকেছে ৬৩৪ মিলিয়ন ইউরো। যাতে করে সেই তালিকায় বার্সা-রিয়ালের পরের জায়গাটাই বুঝে নিয়েছে তারা। বুন্দেসলিগার অন্যসব দলকে খুজলে গেলে স্কল করে বেশ খানিকটা নিচে নামতে হবে আপনাকে। তালিকার ১২ নম্বরে আছে বুরুশিয়া ডর্টমুন্ড, ৩৬৫ মিলিয়ন ইউরো নিয়ে। আর শীর্ষ ২০-এ ঢুকতে পারা ক্লাবগুলোর মধ্যে আছে শুধু শালকে আর ফ্রাঙ্কফ্রুট। আর কষ্টে-শিষ্টে ৩০ এ ঢুকতে পারা আরেকটি ক্লাব হলো বুরুশিয়া মনচেনগ্লাডব্লা; যাদের রেভিনিউ প্রিমিয়ার লিগের নিচের সারিতে থাকা ক্রিস্টাল প্যালেসের থেকেও কম।
কথায় আছে, সাফল্য ভবিষ্যৎ সাফল্যের দরজা খুলে দেয়। কথাটা সত্যও। কিন্তু বায়ার্নের এই বিশাল পরিমাণ রেভিনিউর পেছনে বড় হাত রেখেছে বুন্দেসলিগার টিভি রাইটস পলিসি। পুরো টিভি রাইটসের ২৫% ভাগাভাগি করা হয় সমানভাবে। অর্থাত বুন্দেসলিগাজয়ী দল যত পাবে, বুন্দেসলিগা থেকে অবনমিত দলটাও ঠিক সেই পরিমাণ টাকা পাবে। আর বাকি ৭৫% ভাগাভাগি করা হয় দলের পারফরম্যান্সের উপর। সেই মৌসুমে ক্লাবের লিগ ও ইউরোপে খেলার পরিমান, পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে ভাগ করা হয় টাকা। শুধু তাই নয়, ছোট্ট একটা অংশ বরাদ্দ থাকে তাদের যুব দলের জন্য। দলগুলোর নিজস্ব একাডেমি থেকে কতজন খেলোয়াড় যোগ দিয়েছেন সেই মৌসুমে, তার উপর ভিত্তি করেও অর্থ বন্টন হয়। এটা আজ থেকে নয়, যবে থেকে ফুটবলের বাণিজ্যিকিকরণ শুরু হয়েছে ইউয়েফার হাত ধরে, তখন থেকেই তাদের পলিসিটা এরকম।
ফলাফলটা যেমনটা ভাবছেন তেমনটাই। ফুটবল ফাইনান্সের মতে বায়ার্ন এই মৌসুমে আয় করবে মোট ১০৫ মিলিয়ন ইউরো, অন্যদিকে এই বছর বুন্দেসলিগা খেলতে আসা আর্মেনিয়া বিলিফিল্ড পাবে মাত্র ৩৪ মিলিয়ন ইউরো।
তবে শুধু আর্থিক অবস্থানের উপর ভর করে বায়ার্ন এতদূর এসেছে এমনটা ভাবলেও ভুল হবে। এর পেছনে জার্মানির রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানও অনেক বড় একটা প্রভাব ফেলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সকলে যে যেভাবে পেরেছিল দোষ চাপিয়ে দিয়েছিল জার্মানির উপর। জার্মানির মানুষের কাছে তখন ভরসার জায়গা ছিল ফুটবল। যে কারণে বেশিরভাগ ফুটবল ক্লাবই তখন ছিল সমর্থকদের মালিকানাধীন। প্রতিটি ক্লাবই ছিল একেকটি নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন। সেটা ছিল ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ফুটবলের বাণিজ্যিকিকরণের সাথে তাল মেলাতে সে বছর সিদ্ধান্ত নেয় জার্মান ফুটবলের হর্তা-কর্তারা। তাতে করে ১৯৯৮ সাল থেকে ফুটবল ক্লাবগুলো পিএমসি বা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। আর সেখানেই চলে এসেছে ৫০+১ রুল।
৫০+১ রুল হলো এমন একটা রুল, যার সাপেক্ষে কমার্শিয়াল কোনো মালিক ক্লাবের ৪৯% এর মালিক হতে পারবেন। বাকি ৫১% এর মালিকানা থাকবে ক্লাবের সদস্য ও সমর্থকদের কাছে। ফলে যেকোনো সময় ক্লাব মালিককে বিদায় বলার অধিকার থাকবে তাদের কাছে।
বায়ার্নও এই আওতায় আসে ২০০২ সাল থেকে। বর্তমানে ক্লাবের স্টকহোল্ডার মূলত তিনটি কোম্পানি। অডি, অ্যাডিডাস ও অ্যালিয়াঞ্জ; প্রত্যেকেই ক্লাবের ৮.৩% এর মালিক। আর বাকি ৭৫ শতাংশের মালিক ক্লাবের সদস্যরা। আর সেটি দিয়েই এই সময়ে লাভ করে চলেছে বায়ার্ন। ২০০২ থেকে ২০১৭, ১৫ বছরে তাদের রেভিনিউ বেড়েছে ৩৩৫%।
তবে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলে বায়ার্নের স্পোর্টিং ফিলোসফি। বুন্দেসলিগায় বায়ার্নই একমাত্র ক্লাব যাদের খেলোয়াড় বিক্রির কোনো চিন্তাই করতে হয় না। অন্তত নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তো নয়ই। ইংলিশ লিগ, লা লিগা, সিরি-আ এমনকি ফ্রেঞ্চ লিগেও (দিনে দিনে যেটিও ওয়ান-ক্লাব-লিগ হয়ে উঠছে) কিছু গ্রুপ আছে, যারা নিজেদের মধ্যে খেলোয়াড় বেচা-বিক্রি করে না। কিন্তু বায়ার্ন এখানে রাজত্ব্য করে একাই। প্রতিটি খেলোয়াড়ের জন্যই বায়ার্নের জার্সি জড়ানো স্বপ্ন। আর বায়ার্নের জার্সি গায়ে থাকা মানে জার্মানি দলে সুযোগ পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এতে করে যে শুধু নিজেদের ক্লাবের অবস্থাই উন্নতি করে তা কিন্তু নয়, বরং আস্তে আস্তে বড় হতে থাকা ক্লাবগুলোকে ছেটেও দেয়।
মারিও গোৎজে, রবার্ট লেওয়ান্ডস্কি, আলেকজেন্দার নুবেল, লিওন গোরেৎস্কা, সেবাস্তিয়ান রুডি, বেঞ্জামিন পাভার্ড; বুন্দেসলিগার সেরা খেলোয়াড়দের তারা দলে ভিড়িয়েছে ফ্রিতে। একটা পয়সাও দিতে হয়নি তাদের সাবেক ক্লাবকে। নামমাত্র মূল্যে কিনেছে নিকলাস সুলে, সান্দ্রো ওয়েগনার, জশুয়া কিমিখ, উলরিখের মতন খেলোয়াড়কে। বুন্দেসলিগার এমন কোনো দল নেই যেখান থেকে উঠে আসা তরুণ খেলোয়াড়দের টান দেয়নি তারা। এমনকি আগামী বছরও আরবি লাইপজিগ থেকে আসছেন ডায়েট উপমেচানো। শুধু খেলোয়াড়ই নন, আরবি লাইপজিগের কোচ জুলিয়ান লাগেসম্যানের সাথেও আগে থেকেই চুক্তি করে রেখেছে তারা।
এই খেলোয়াড়দের দলে এনেই নিজেদের কোর বদলে দেয় তারা। ফলে হুট করে ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ডে পরতে হয়না তাদের। যেমনটা এখন কাটাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা বার্সেলোনা, সেই ভয় তাদের নেই। রোবেন-রিবেরিকে তারা রিপ্লেস করেছে সানে-ন্যাব্রিকে দিয়ে। মাঝমাঠে আলান্সো-ভিদালের জায়গায় এসেছে কিমিচ, গোরেৎস্কা। আর সেই সাথে নিজেদের দলের সাবেক খেলোয়াড়দের তারা নিয়ে আসে ক্লাবের মাথা হিসেবে। উলি হোন্যাস, কার্ল-হেইঞ্জ রুমিনিগে, হাসান সালিহামিদিচ, অলিভার কান; সকলেই বায়ার্ন বোর্ডের সদস্য, প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেন তারা বুদ্ধিমত্তার সাথে।
২০০০ সাল থেকে বায়ার্ন বাদে মোটে তিনটি দল জিতেছে বুন্দেসলিগা। স্টুটগার্ড, ভলসবুর্গ আর বুরুশিয়া ডর্টমুন্ড। এর মধ্যে স্টুটগার্ট অবনমিত হয়েছে দুইবার। ভলসবুর্গ এখন মিড টেবিলে ঘুরে বেরায় আর বুরুশিয়া ও জেতার পরদিনই নিজেদের সেরা খেলোয়াড়দের হারিয়েছে বায়ার্নের কাছে। এমনকি গত কয়েক মৌসুম ধরে থ্রেট হয়ে উঠা লাইপজিগ থেকেও খেলোয়াড় কিনে তাদের ইতোমধ্যে দূর্বল করে দিয়েছে বায়ার্ন।
বায়ার্ন ইতোমধ্যে তাদের সিস্টেম গড়ে তুলেছে, বাকি ক্লাবগুলো শুধু সেই জায়গাতেই আসছে আর যাচ্ছে। নতুন কোনো ক্লাব বড় হতে শুরু করলেই তাদের থেমে যেতে হচ্ছে বায়ার্নের প্রতাপের কারণে। হয় সেটা বায়ার্নের খেলোয়াড় কিনে নেওয়ার মাধ্যমে কিংবা রিসোর্সের অভাবে হারিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। আর দিনে দিনে বুন্দেসলিগা থেকে উঠে যাচ্ছে সাধারণ ফুটবল সমর্থকদের মন আর তা হয়ে উঠছে বায়ার্নের একার রাজত্ব!