ক্রিকেট ইতিহাসে আমরা অনেক বোলিং জুটি দেখেছি যারা জুটি বেঁধে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করেছেন। জুটি বেঁধে বোলিং করার কথা বললেই ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে কোর্টনি ওয়ালশ-কার্টলি অ্যামব্রোস কিংবা ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনুস জুটির কথা।
খুব কম ক্ষেত্রেই স্পিনারদের জুটি বেঁধে নিয়মিত বল করতে দেখা যায়। ষাট-সত্তরের দশকে এই কাজটিই নিয়মিত করে গিয়েছেন চার ভারতীয় স্পিনার! বিষান সিং বেদী, এরাপল্লি প্রসন্ন, ভগবত চন্দ্রশেখর এবং শ্রীনিবাসরাঘবন ভেঙ্কটরাঘবন। এই চার ঘূর্ণিজাদুকরের হাত ধরেই ভারত সফলতা পেয়েছিল ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ডের মত শক্তিশালী দলের বিপক্ষে। এই স্পিন চতুষ্টয় ভারতের মাটিতে যেমন সফল ছিলেন তেমনি সফলতা পান ইংল্যান্ডের সিমিং কন্ডিশন কিংবা অস্ট্রেলিয়ার বাউন্সি উইকেটেও।
ষাটের দশকে ভারত মানসম্মত পেস বোলারের সংকটে ভুগলে তৎকালীন ভারতীয় অধিনায়ক মনসুর আলী খান পতৌদি দলে মানসম্মত স্পিনারদের সুযোগ দেবার কথা ভাবেন। তাতেই বাজিমাত!!বামিংহামে খেলা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই টেস্টে চারজন মিলে দুই ইনিংসে শিকার করেন ইংল্যান্ডের ১৮ উইকেট। যদিও ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় ম্যাচটি ভারত হেরে যায়। এই স্পিন চতুষ্টয়ের একসাথে খেলা একমাত্র টেস্ট ছিল এই টেস্ট ম্যাচটি।
বিষান সিং বেদি ছিলেন ক্ল্যাসিক্যাল বাঁ-হাতি স্পিনার; ফ্লাইটের পাশাপাশি উইকেট থেকে বাউন্স আদায় করতেন তিনি এবং ব্যাটসম্যানকে উড়িয়ে খেলতে প্রলুব্ধ করতেন। ভগবত সুব্রানিয়াম চন্দ্রশেখর ছিলেন লেগস্পিনার। মিডিয়াম পেসারের মতো রানআপ, বোলিং অ্যাকশন, ফলো থ্রো নিয়ে যিনি করতেন গুগলি, টপস্পিন কিংবা শার্প টার্ন নেয়া লেগস্পিন!
স্পিন চতুষ্টয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিলেন চন্দ্রশেখর। অন্যদিকে প্রসন্ন এবং ভেঙ্কটরাঘবন দুজনেই ছিলেন অফস্পিনার। প্রথমজন বেদির মতোই ফ্লাইট এবং বাউন্সের উপর নির্ভরশীল ছিলেন অন্যদিকে ভেঙ্কটরাঘবনের শক্তির জায়গা ছিল একটানা ভালো জায়গায় বল করে যাওয়া। শেষদিকে নেমে ব্যাটও ভালোই চালাতে পারতেন তিনি।
এই স্পিন চতুষ্টয় একত্রে কেবলমাত্র একটি টেস্টই খেলেন। বেশিরভাগ সময়ই তিনজন একাদশে থাকতেন। প্রসন্ন এবং ভেঙ্কটরাঘবন দুজনেই অফস্পিনার হওয়াতে দল নির্বাচন কিছুটা সহজ হয়ে যায় এবং বেশিরভাগ সময় কোপটা ভেঙ্কটরাঘবনের উপরেই পড়তো।
চন্দ্রশেখর, প্রসন্ন এবং বেদি একত্রে ২৪ টি টেস্ট খেলেন। এই ২৪টেস্টে চন্দ্রশেখর এবং বেদি যথাক্রমে ১০৩ এবং ১০২ উইকেট নেন। প্রসন্নও যথারীতি ভালো সঙ্গ দেন এই দুজনকে ৬১উইকেট সংগ্রহ করে। এই ২৪টেস্টে চন্দ্রশেখর ৮বার পাঁচ উইকেট পান অন্যদিকে বেদি পান ৫বার।
ইংল্যান্ডকে পেলেই যেন আরও জ্বলে উঠতেন এই তিনজন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একত্রে ১১টি টেস্ট খেলে ১৪১ টি উইকেট নেন। বিশেষ করে চন্দ্রশেখর ছিলেন অনবদ্য, তিনি একাই নেন ৫২উইকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একত্রে পাঁচটি টেস্ট খেলেন এই তিনজন, যেখানে ২২উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী বিষান সিং বেদি। চন্দ্রশেখর এবং প্রসন্ন যথাক্রমে ১৬ এবং ১৪ উইকেট নেন।
চন্দ্রশেখর, বেদি এবং ভেঙ্কটরাঘবন একত্রে ১৮টি ম্যাচ খেলেন। যথারীতি এই ১৮ টেস্টেও বেদি এবং চন্দ্রশেখর পাল্লা দিয়ে উইকেট নেন; দুজনেই যথাক্রমে ৮৫ এবং ৮৪ উইকেট। তাদের তুলনায় ভেঙ্কটরাঘবন কম উইকেট নেন; মাত্র ৩৯টি। তবে তাঁর ইকোনমি ছিল ঈর্ষণীয় ২.২১! তিনি মূলত টানা ডট বল দিয়ে ব্যাটসম্যানকে চাপে ফেলতেন আর সেই চাপকে কাজে লাগিয়ে অপরপ্রান্ত থেকে উইকেট তুলে নেবার কাজটি করতেন অপর দুজন।
চন্দ্রশেখর, প্রসন্ন এবং ভেঙ্কটরাঘবন একত্রে তিনটি ম্যাচ খেলেন যেখানে প্রথম দুজন ২০টি করে উইকেট নিলেও তৃতীয়জন নেন ৮টি উইকেট। একইভাবে বেদি, প্রসন্ন এবং ভেঙ্কটরাঘবন একত্রে ১৩টি টেস্ট খেলেন। এই ১৩টেস্টে প্রসন্ন ২৭.৮৬ এভারেজে তুলে নেন ৬১ উইকেট। ৪১ উইকেট নিয়ে তাকে যোগ্য সঙ্গ দেন ভেঙ্কটরাঘবন। অন্যদিকে বেদি ছিলেন কিছুটা অনুজ্জ্বল, ৪৩উইকেট নেন ৩৪ এভারেজে। এখান থেকে স্পষ্ট যে বেদি চন্দ্রশেখরের সাথে জুটি বেঁধেই বেশি সফল ছিলেন।
বেদি এবং চন্দ্রশেখর একত্রে ৪২টি ম্যাচ খেলে সমানসংখ্যক উইকেট পান- ১৮৪! বেদির এভারেজ এবং ইকোনমি ভালো থাকলেও চন্দ্রশেখরের স্ট্রাইক রেট ছিল অনবদ্য। প্রতি উইকেট পেতে বেদির চেয়ে ১১ বল কম খরচ করেন চন্দ্রশেখর। চন্দ্রশেখরের ১৪ বার পাঁচ উইকেট শিকারের বিপরীতে বেদি পাঁচ উইকেট পান ১০ বার।
চন্দ্রশেখর ভারতের হয়ে ৫৮ ম্যাচ খেলে ২৯.৪৬ গড়ে ২৪২টি উইকেট শিকার করেন। ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেয়েছেন ১৬ বার আর ম্যাচে ১০ উইকেট দুইবার। বিষান সিং বেদি ৬৭টি ম্যাচ খেলে ২৮.৭১ এভারেজে ২৬৬ উইকেট পান। ইনিংসে ১৪বার পাঁচ উইকেটের পাশাপাশি ম্যাচে ১০উইকেট পান একবার। এরাপল্লি প্রসন্ন ৪৯ টেস্টে মাঠে নেমে ১৮৯ উইকেট নেন ৩০.৩৮ গড়ে। ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেন ১০ বার। ভেঙ্কটরাঘবন ৫৭ ম্যাচ খেলে ৩৬ গড়ে দখল করেন ১৫৬ উইকেট।
ক্রিকেটের সর্বোচ্চ তিন উইকেটশিকারী – মুত্তিয়া মুরালিধরন, শেন ওয়ার্ন কিংবা অনিল কুম্বলে – তিনজনই স্পিনার। ফলে, এখনকার বাস্তবতায় বসে দিব্যি স্পিনারদের রাজা বলে রায় দিয়ে দেওয়া যায়। তবে, এই বিশ্বাসটা স্পিনারদের মধ্যে প্রথম ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ওই স্পিন চতুষ্টয়।