চন্দ্রাহত চন্দ্রশেখর

টেস্ট ক্রিকেটে চারটি ‘পেয়ার’ সহ মোট ২৩টি ‘শূন্য’র অধিকারী ছিলেন চন্দ্রশেখর। একবার এক সাক্ষাৎকারে চন্দ্রশেখরকে তাঁর ব্যাটিং নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সানির (সুনীল গাভাস্কার) আর আমার ব্যাটিং দক্ষতায় ফারাক খুব কম। বলতে পারেন উনিশ-বিশ। সেই ফারাকটা হল, যে বলটা সেঞ্চুরি বা ডরবল সেঞ্চুরি করার পরে এসে সানিকে আউট করতো, আমার ক্ষেত্রে সেটা যে কোনভাবে ইনিংসের একেবারে গোড়াতেই চলে আসত।’

১৯৭৫-৭৬ মৌসুমের নিউজিল্যান্ড সফরে গেছে ভারত। ২৩ থেকে ২৮ জানুয়ারি ১৯৭৬। সম্ভবত অকল্যান্ড টেস্টের ঘটনা। অথবা গল্প। জন মরিসন (১), গ্লেন টার্নার (১), জন পার্কার (১) আর বেভান কংডনকে (১) চার চারবার পরিস্কার এলবিডব্লিউ আউট করেও উইকেট পেলেন না এক ডানহাতের ভারতীয় লেগ স্পিনার। একবারও আউট দিলেন না ‘দেশপ্রেমিক’ নিউজিল্যান্ড আম্পায়ার রবার্ট মন্টিথ। তখন একজন স্বদেশী আম্পায়ার অ্যালাউড ছিলেন আয়োজক দেশের।

অতঃপর সেই ইনিংসে শেষ অবধি ৬ উইকেট নেওয়া সেই ডানহাতের ভারতীয় লেগ স্পিনার পরিষ্কার বোল্ড আউট করে দিলেন জন পার্কারকে। এবং বিচিত্র অঙ্গভঙ্গীতে চীৎকার করে আউটের আবেদন করলেন রবার্ট মন্টিথের সামনে গিয়ে।

তারপর কথোপকথনটা ছিল এইরকম। রবার্ট মন্টিথ, ‘দেখতে পাচ্ছ তো স্ট্যাম্প ছিটকে গিয়ে বোল্ড হয়েছে। তাও এভাবে আবেদন করছ কেন?’ ডান হাতের ভারতীয় লেগ স্পিনার বললেন, ‘আপনার মত আমিও দেখতে পাচ্ছি, বোল্ড হয়েছে। কিন্তু আউট হয়েছে কি?’

সেই ডানহাতের ভারতীয় লেগ স্পিনার দুই ইনিংসে ৮ উইকেট নেন সে ম্যাচে, যেটা ভারত জিতেছিল আট উইকেটে। এমনিতে শান্ত তিনি সেদিন ভয়ঙ্কর রেগে গিয়েছিলেন। রবার্ট মন্টিথ সেদিন জেনেছিলেন, বিশ্বের সেরা সেরা ব্যাটসম্যান যেটা জানত অনেক আগে থেকেই।

 

ছয় বছর বয়সে পোলিওতে ঘেঁটে যাওয়া ডানহাত দিয়েই এই বোলার ‘চন্দ্রাহত’ করে গেছেন বিশ্বের তাবড় তাবড় ব্যাটকে। ইংল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যানরা ১৯৭১-এ ‘বিদেশে জয় বুভুক্ষু’ ভারতের কাছে উড়ে যায় মুখ্যত তারই লেগব্রেকে। তারপর সেই কলকাতা টেস্ট ১৯৭৪-৭৫। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুর্ধর্ষ টিমটার ধসে যাওয়া। তারই হাতে।

তার আগের তিন বছর ভারতের বহু টেস্ট জেতাও। তারই দৌলতে। তারপরেও অন্তত: বছর চারেক তার বোলিং প্রতিভা মন্ত্রমুগ্ধতায় নতজানু করে রেখেছিল বিশ্বের অনেক প্রথম সারির ব্যাটকে।

২১ জানুয়ারি ১৯৬৪ থেকে ১২ জুলাই ১৯৭৯, ১৫ বছরের ক্যারিয়ার আর ৫৮ টেস্টে ২৪২ উইকেট (সেরা ৭৯/৮) এই প্রতিভার প্রকৃত প্রতিফলন নয়। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ সালে খেলা তার একমাত্র ওডিআইতেও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনি ৩টি উইকেট নিয়েছিলেন, ৩৬ রানে।

কলিজাতে সাহসের ডায়নামো বেঁধে গতিময় লেগস্পিন জাদুতে বিশ্বত্রাস ব্যাটসম্যানদের নাকানি চোবানি খাওয়ানোটাই ‘তিনি’ হয়ে থেকে গেছে আমার কাছে। যে ‘থেকে যাওয়া’ ভুলিয়ে দেয় আমার অজস্র না থাকা। কিছু কিছু গভীর গোপন উপলব্ধি যেমন শুধু নিজের হয়েই থেকে যায়।

যেমন তার ছিল মুকেশের গান। মুকেশের গান তার মত আত্মস্থ আর কেউ করেছেন কিনা, আজও তর্কের বিষয়। তিনি নিজেও অসাধারণ গেয়ে গেছেন তার সঙ্গীত আইডলের গান, বছরের পর বছর। ১৯৯৪ সালে ৪৯ বছর বয়সে বিদেশে ঘটা পথদুর্ঘটনায় দিনের পর দিন গৃহবন্দী তাকে সঙ্গ দিয়েছিল মুকেশের গান। দেশে ফেরার পরে মুম্বাই বিমানবন্দরে কাস্টমসকে তাদের প্রশ্নের উত্তরে (কিছু ঘোষণা করার আছে কিনা) তিনি বলেছিলেন, ‘Only my pain. And some disappointment!’

তার বোলিং ক্লিপিং ইউটিউবে দেখতে দেখতেই বহুদিন ভেবেছি কিভাবে শেষ মুহূর্তে অত জোরের উপর অত বিশাল মাপের স্পিন বোলিং সম্ভব করে দেখাতেন তিনি, যাতে মন্ত্রমুগ্ধর মত উইকেট দিয়ে যেত বিশ্বের তাবড় তাবড় ব্যাটগুলি।কিভাবে? ভাবনাটা কাজে লাগল আজ, এখন।

২০২১ সালের জানুয়ারিতে ‘স্ট্রোক’ হয়েছিল তার। সেই ধাক্কা সামলে আপাতত ভালো আছেন তিনি, ভারতীয় ক্রিকেট যাকে চিনত ভগবত সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর নামে। ও হ্যাঁ, তার রসিকতার লেভেলটাও ছিল অনেক উঁচুতে, তার অসামান্য বোলিংয়ের মানের মতই।

টেস্ট ক্রিকেটে চারটি ‘পেয়ার’ সহ মোট ২৩টি ‘শূন্য’র অধিকারী ছিলেন চন্দ্রশেখর। একবার এক সাক্ষাৎকারে চন্দ্রশেখরকে তাঁর ব্যাটিং নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সানির (সুনীল গাভাস্কার) আর আমার ব্যাটিং দক্ষতায় ফারাক খুব কম। বলতে পারেন উনিশ-বিশ। সেই ফারাকটা হল, যে বলটা সেঞ্চুরি বা ডরবল সেঞ্চুরি করার পরে এসে সানিকে আউট করতো, আমার ক্ষেত্রে সেটা যে কোনভাবে ইনিংসের একেবারে গোড়াতেই চলে আসত।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...