ফুটবলে হাঙ্গেরির নবজাগরণ

গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে জার্মানির বিপক্ষে জিততে পারলে ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপ রানারআপ দলটি আবার কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের নকআউট খেলবে। ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সের সেই দলটার কেউই বর্তমানে জীবিত নেই। বুদাপেস্টের পুসকাস অ্যারেনার সবুজ গালিচায় সুন্দরতম এই খেলার প্রতিনিধিদের সৌরভ ছড়ানো দেখে ওপারে নিশ্চয়ই হেসে উঠছেন তাঁরা।

ফুটবল ইতিহাসের সেরা দলগুলোর তালিকা করলে শুরুর দিকেই থাকবে ১৯৫০-৫৬ সালের হাঙ্গেরি ফুটবল দল। পুসকাস-হিদেকুটি-ককশিসদের নিয়ে গড়া এই দলটি ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্স নামেই পরিচিত। কেবল নান্দনিক আক্রমণাত্নক ফুটবল নয় বরং খেলার প্রথাগত কৌশলে পরিবর্তন, নতুন যুগের সূচনা করা সবই এসেছে এই দলের হাত ধরে। ১৯৫২ সালে হাঙ্গেরির ফুটবল ইতিহাসের প্রথম সাফল্য হিসেবে অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিতে তারা।

তবে হাঙ্গেরির সবচেয়ে বিধ্বংসী রূপ দেখা যায় পরের বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে; যে ম্যাচটি পরিচিত হয়ে আছে ম্যাচ অব দ্য সেঞ্চুরি হিসেবে। ওয়েম্বলিতে ৬-৩ গোলে ইংরেজদের হারানোর পর বুদাপেস্টে ইংলিশ ফুটবলারদের নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করে পুসকাসরা, ম্যাচের স্কোরলাইন ছিল ৭-১!

সাফল্যের পূর্ণতা পেতে হাঙ্গেরির তখন কেবল দরকার ছিল একটি বিশ্বকাপ জয়। ১৯৫৪ সালে সে লক্ষ্যেই জার্মানি যায় তারা। গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে জড়ায় ২৪ গোল! সেমিফাইনালে ব্রাজিলকে হারায় ৪-২ গোলে।

কিন্তু অঘটন ঘটে ফাইনালে, ফেরেঙ্ক পুসকাসের ইনজুরি আর বৃষ্টিস্নাত মাঠে নিজেদের স্বাভাবিক খেলা খেলতে না পারায় ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েও পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে বসে ৩-২ ব্যবধানে। টানা ৩১ ম্যাচ অপরাজিত থাকার পর ম্যাগিয়ার্সরা হেরে যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেই।

এই ম্যাচ হারেই বদলে যায় হাঙ্গেরির ফুটবল ভবিষ্যৎ, যেখানে পরের কয়েক দশক শাসন করার কথা ছিল তাদের সেখানে উলটো সবার চেয়ে পিছিয়ে যায় তারা। বিশ্বকাপ শেষে দেশে ফেরার পর মিডিয়ার তোপে পড়েন খেলোয়াড়েরা। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরির বিপ্লবের পর দেশ ছাড়েন পুসকাস-ককশিস-হিদেকুটিরা। পরের বিশ্বকাপে হাঙ্গেরি দলে ছিলেন ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সের কেবল চারজন।

হাঙ্গেরি ফুটবলের অধঃপতন শুরু তখন থেকেই। এরপর থেকে বিশ্বকাপে ভালো ফলাফল তো দূরে থাক, নিয়মিত খেলতেই পারেনি তারা। ১৯৮৬ সালে সর্বশেষ বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেয় তারা। মহাদেশীয় টুর্নামেন্টেও ভালো খেলতে পারেনি কখনো। ইউরোর দলসংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২৪ করা হলে ২০১৬ সাল থেকে অংশ নেবার সুযোগ পায় তারা, যদিও বাদ পড়ে যায় গ্রুপপর্ব থেকেই।

বহুবছর বাদে দারুণ এক প্রজন্ম পেয়েছে হাঙ্গেরি, নামেভারে ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সের আশেপাশে যেতে না পারলেও পুসকাসের দেশে পুনরায় ফুটবলের নবজাগরণ সৃষ্টিতে যথেষ্ট। এবারের ইউরোতে তাই হাঙ্গেরি এসেছে নিজেদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটাতে। গ্রুপ অব ডেথে পর্তুগাল, জার্মানি, ফ্রান্সের সাথে একই গ্রুপে পড়লেও এখনো টিকে আছে পরের রাউন্ডে যাবার লড়াইয়ে।

প্রথম ম্যাচে পর্তুগালের সাথে দারুণ ফুটবল খেলেও আটকে যেতে হয়েছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো নামের এক বাঁধার কাছে। শেষ দশ মিনিটে তিন গোল হজম করে ম্যাচ হারে তারা। কিন্তু প্রবলভাবে ফিরে এসেছে দ্বিতীয় ম্যাচেই, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে রুখে দিয়েছে ১-১ গোলে। শুরুতে গোল করে এগিয়ে যাওয়া হাঙ্গেরির জমাট রক্ষণ দেখে একসময় মনে হচ্ছিলো ম্যাচ জিতে যাচ্ছে হাঙ্গেরি।

কিন্তু, রক্ষণের ক্ষণিকের ভুলে কোনোমতে ম্যাচে সমতা ফেরায় ফরাসিরা। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে জার্মানির বিপক্ষে জিততে পারলে ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপ রানারআপ দলটি আবার কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের নকআউট খেলবে। ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সের সেই দলটার কেউই বর্তমানে জীবিত নেই। বুদাপেস্টের পুসকাস অ্যারেনার সবুজ গালিচায় সুন্দরতম এই খেলার প্রতিনিধিদের সৌরভ ছড়ানো দেখে ওপারে নিশ্চয়ই হেসে উঠছেন তাঁরা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...