গল্পের শুরু আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সে, তাঁদের বিখ্যাত অ্যাকাডেমিতে। ‘The cradle of the stars’ – এই নামেই পরিচিত এই অ্যাকাডেমি। ম্যারাডোনা, সার্জিও বাতিস্তা, ফার্নান্দো রেদন্দোদের মতন তারকারা এসছেন এখান থেক। হুয়ান রোমান রিকুয়েলমের শুরুও এখানে। বেশ যত্ন নিয়েই তাকে লালন-পালন করেছে ক্লাব।
কিংবদন্তি হবার পথের পাথেয় মানে মানসিক ক্ষিপ্রতা আর প্রায়োগিক উদ্ভাবনকুশলতার হাতেখড়িটাও এখান থেকেই নেয়া। যদিও নিজের দ্বিতীয় ভালোবাসাকেই – ভালোবাসাতেই রিকুয়েলমে বনে গিয়েছিল কিংবদন্তি। বলছি বোকা জুনিয়ার্স আর হুয়ান রোমানের কথা। ম্যারাডোনা, রাতিন, মারজোলিনি, পালের্মো, হুগো গাতি, ইবোরা, তেভেজসহ আরো অনেক বিখ্যাত খেলোয়াড়দের আতুরঘর এই বোকা।
সবাইকে কোনো না কোনো ভাবে ছাড়িয়ে গেছেন রিকুয়েলমে। বোকার সর্বকালের সেরা ফুটবলার নি:সন্দেহে সে। ১৯৯৬ সালে তাকে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী রিভার প্লেটের সামনে দিয়ে দলে ভেড়ায় বোকা জুনিয়র্স। রিকুয়েলমে আর ক্লাব বোকার অন অ্যান্ড অফ সম্পর্ক চলতে থাকে বিশ বছর ধরে। রিকুয়েলমেকে বলা হত নতুন ম্যারাডোনা। খেলার দিক দিয়ে দুজন একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির।
রিকুয়েলমের অভিষেক হয়েছিল ম্যারাডোনার বদলি হিসেবে নেমেই। দুজনে একসাথে বোকার নীল জার্সিতে ম্যাচ খেলেছে মাত্র একটি। ম্যাচটার কিছু অংশ দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিল দুজন ফুটবলার প্র্যাক্টিস সেশনে নিজেদের মধ্যে ওয়ান-টু-ওয়ান খেলছেন। প্রতিপক্ষের প্লেয়াররা কিছুতেই পেরে উঠতে পারছেন না এই দুজনের ব্রিলিয়ান্সের সাথে।এরপরে আর একসাথে নামতে পারেননি দু’জন। ম্যারাডোনা ওই ম্যাচের পরেই ড্রাগটেস্ট ফেল করেছিলেন।
সাফল্য রিকুয়েলমের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে অল্পদিনেই। অবিশ্বাস্য কিছু নয়। তাঁর পায়ের যাদুতে আসতে থাকে একের পর এক শিরোপা। এর মধ্যে ছিল টানা দুটি কোপা লিবার্তোদোরেস। বোকার হয়ে প্রথম স্পেলে রিকুয়েলমে জিতে মোট ছয়টি শিরোপা। ট্রফি স্পর্শ সবাই করতে পারে কিন্তু যা স্পর্শ করা অসম্ভব তা হচ্ছে রিকুয়েলমের ব্রিলিয়ান্স।
ফুটবল লেখক ও অ্যানালিস্ট ওমর সালিম বলেন, ‘His movement, passing, control, finesse and vision was the stuff of wonder. His ability to create something from nothing rivalled that of Maradona. Despite being worlds apart in their playing style, Maradona and Riquelme sharing one innate skill: unpredictability.’
১৯৯৬ থেকে ২০০২ এই সময়ের মধ্যে বোকার হয়ে রিকুয়েলমে করেছেন ৪৪ গোল, ১৯৪ ম্যাচে। আহামরি কোনো পরিসংখ্যান নয় এটি। কিন্তু এই গোলগুলো হয়তো ছিল অসাধারণ ফ্রি-কিক বা চোখ ধাঁধানো ড্রিবলিং এর পরে আবার চোখ ধাঁধানো ফ্লিক কিংবা স্থম্ভিত করে দেয়া এমন দূরপাল্লার গোলাজো। এসব পড়ে যদি মন ছটফট করে,ব্যাকুল হয়ে উঠে তাহলে ওষুধ হিশেবে ইউটিউব তো আছেই। সমস্ত রকমের মানসিক রোগ সারিয়ে তুলবে।
বোকা অধ্যায় শেষ করে দ্যা রোমান রিকুয়েলমে ছুটলেন ইউরোপে। গন্তব্য বার্সালোনা। তখনকার কোচ ভ্যান গালের অনাগ্রহের শিকার হয়ে পড়েন শুরুতেই। এই ডাচ কোচের দর্শনে নেই লেজি এলিগেন্সের কোনো স্থান।আর রিকুয়েলমের কাছে সেটাই মূল – ‘He didn’t score, he didn’t run.’
কোচ ভ্যান গালের সরল স্বীকারোক্তি। আসলে ভ্যান গাল ব্যাপারটা বুঝতে পারলো না। এসব দিয়ে রিকুয়েলমকে বিচার করে বাতিল করে দেয়া অনেকটা বাজে ফ্রেমের কারণে কোন চমৎকার পেইন্টিংকে অবহেলা করা্র মতন। দুটোই পাপ। আল্পস পর্বতমালা দিয়ে ফ্রান্স থেকে ইতালি যেতে যেতে আফসোস করা যে প্লেনে গেলে আরামও পেতাম এবং সময়ও বাঁচত।
সিচুয়েশনটা এমনই লাগল আমার কাছে। মানুষ বলে সৌন্দর্য হচ্ছে দর্শকের চোখে, আমি নিশ্চিত ভ্যান গালের দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা ছিল। মাত্র ৯ মিলিয়নে বার্সায় যোগ দেয়া রিকুয়েলমেকে ক্লাব সমর্থকরা অভিনন্দন জানিয়েছিল দুহাত ভরে। ভ্যান গাল বলেছিল এটা শুধুমাত্র একটা পলিটিক্যাল সাইনিং। সেটা না হয় বুঝলাম।
কিন্তু, বিশ্বকাপ জয়ী ফর্মে থাকা রিভালদোকে ক্লাব ছাড়া করে দিয়েছিল কেন সেটি বুঝলাম না। নাহ ভ্যান গালের আসলেই ব্লারি ভিশন। অনেকটা বাধ্য হয়ে অন্য ক্লাবে চলে যায় রিকুয়েলমে। সেখানে (ভিলারিয়ালে) সরিন-সেনা-ফোরলানকে নিয়ে ম্যানুয়েল প্যালেগ্রিনির অধীনে ঠিকই সব সমালোচনার জবাব দিয়ে দেন।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে ভিলারিয়ালে আসেন উরুগুয়ের আইকনিক ফুটবলার ডিয়েগো ফোরলান। কোন রাগঢাক না করেই বলেছিলেন ভিলারিয়ালে আসার কারণ হচ্ছে রিকুয়েলমে। আর্জেন্টাইন ক্লাব ইন্ডিপিন্ডিয়ান্দেতে ক্যারিয়ার শুরু করা ফোরলান বোকায় রিকুয়েলমেকে দেখে একসাথে খেলার লোভ সামলাতে পারেননি।
প্যালেগ্রিনির অধীনে রিকুয়েলমে-ফোরলান জুটি যেন ফিউরেন্টিনার কস্তা-বাতিস্তুতার মতন ব্রাদার্স ইন আর্মস। রিকুয়েলমের অ্যাসিস্ট আর ফোরলানের গোল। এই দুয়ে ছিল তখনকার ভিলারিয়াল। লিগে তৃতীয় হয়েছিল তারা অনেকদিন পর। খেলেছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালও। আর্সেনালের বিরুদ্ধে সেই সেমিতে পেনাল্টি মিস রিকুয়েলমেকে কষ্ট দেয় আজও।
ওমর সালিম বলেন, ‘It’s easy to criticize the horse for not pulling the cart, but some horses just aren’t meant for the field. They’re too perfect. They belong in more refined surroundings. In his head, he must’ve painted a thousand pictures. Where mere mortals passed the ball, Riquelme guided it.’
দুর্দান্ত ফর্ম নিয়ে রিকুয়েলমে যাবেন ২০০৬ এর জার্মানি বিশ্বকাপে। ভক্তদের আশা তাঁর হাত ধরেই আর্জেন্টিনা হাতে তুলবে পরম আরাধনার বিশ্বকাপ। ২০০২ এর বিশ্বকাপটা মিস করেছিলেন ব্যক্তিগত কারণে। রিকুয়েলমের ভাইকে অপহরণ করা হয়েছিল। তখনকার কোচ মার্সেলো বিয়েলসাকে জানিয়েছিলেন মানসিকভাবে খেলার জন্যে প্রস্তুত নন তিনি।
তাই জার্মানি বিশ্বকাপে প্রত্যাশা আর চাপ দুটোই বেশি। তখনকার সময়ে যারা স্প্যানিশ ফুটবল দেখার সুযোগ পাননি, যারা রিকুয়েলমের খেলা দেখার সুযোগ পাননি বিশ্বকাপ যেন তাঁদের জন্যেই এসেছে। আইভোরি কোস্টের সাথে দুই অ্যাসিস্ট। সার্বিয়া-মন্টেনেগ্রোকে দেয়া ৬ গোলের সবগুলোতেই কোনো না কোন ভূমিকা রেখেছেন। মেক্সিকোর বিপক্ষে দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনার প্রথম গোলটাও এসছে তাঁর কর্নার থেকে।
রিকুয়েলমের কর্নারগুলো ছিল একেবারে আউট অফ দিস ওয়ার্ল্ড। অসাধারণ ট্যাকনিকের সাথে একেবারে প্রিসাইজ ডেলিভারি। মেক্সিকোর বিপক্ষে জয়টা আসে অতিরিক্ত সময়ে ম্যাক্সি রদ্রিগেজের অসাধারণ এক গোল থেকে।ডি-বক্সের পাশ থেকেই ম্যাক্সি ভলিতে করেন বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোল।মেক্সিকোর সাথে জয়ের জন্যে এতক্ষণ আলবিসেলিস্তিদের অপেক্ষা করা লাগত না।
যদি স্যাভিওলা আর ক্রেসপো রিকুয়েলমের বানানো দুটি চমৎকার সুযোগ মিস না করতেন। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে আয়ালার গোলের উৎস রিকুয়েলমের কর্নার কিক। পেকারম্যানের মিসক্যালকুলেশন আর জার্মানির কাছে টাই ব্রেকারে হার। ৭১ মিনিটে ১-০ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় রিকুয়েলমেকে তুলে ক্যাম্বিয়াসোকে নামান কোচ।
ডিফেন্সিভ মিড ক্যাম্বিয়াসোর ফুটবল দক্ষতা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু সে আর যা হোক রিকুয়েলমে না।মাঝমাঠের দখল নিয়ে একের পর এক আক্রমণ করে ঠিকই গোল আদায় করে নেয় জার্মানি। মাঝমাঠ আর আক্রমণভাগের মধ্যে নেই কোন সংযোগ। আর্জেন্টিনার হার লেখা হয়ে যায় তখনই। মানসিক অবসাদ ঘিরে ধরে রিকুয়েলমকে। অবসর নিয়ে নেন জাতীয় দল থেকে।
পরে আবার ফিরে এসে আবারো ধাক্কা খান। আলফিও বাসিলের অধীনে ২০০৭ কোপা আমেরিকায় ফাইনালে হেরে যায় আর্জেন্টিনা, তাও চিরপ্রতিদ্বন্দী ব্রাজিলের কাছে। ওই টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনা ছিল পুরো রিকুয়েলমেময়। গোল না হয় অ্যাসিস্ট করেছেন প্রায় সব ম্যাচেই। ফাইনালেই বিধি বাম। পরে অবশ্য রিকুয়েলমে পেয়েছিলেন তাঁর প্রতিশোধ। পরের বছরের অলিম্পিকে সেমিতে ব্রাজিলকে হারিয়ে ফাইনালে যান এবং স্বর্ণ জিতে নেন। ওই একমাত্র পদকছাড়া কিছু নেই আর। ফুটবল ঈশ্বর বড়োই স্বার্থপর।
বিশ্বকাপ থেকে স্পেনে ফিরে আসলেও ইউরোপে নিজেকে আর রাখতে চাইলেন রিকুয়েলমে। ভিলারিয়ালের সাথে সম্পর্ক খারাপ করেই ক্লাব ছাড়েন। প্রথমে লোনে গেলেও পরবর্তীতে পারমানেন্টলি বোকাতে চলে যান।
ওমর সালিম লিখেছেন, ‘The move to Buenos Aires represented the passing of the most graceful player to have come out of Argentina since Fernando Redondo. It represented the end of a dream. The end of the fantasy. Ego, a lack of motivation, and the chance to control his own life tore Riquelme away from Europe.’
এসেই ২০০৭ তে দেখা পান কোপা লিবার্তোদোরেসের। সাথে আরো দুটি লিগ শিরোপা। এবার ১৮৭ ম্যাচে গোল ছিল ৪৮টি। বুট জোড়া তুলে রাখার আগে ফিরে যান নিজের প্রথম ক্লাব আর্জেন্টিনা জুনিয়র্সে। প্রথম ম্যাচেই পান গোলের দেখা। এক মৌসুম খেলেন সেখানে। ১৮ ম্যাচ আর ৫ গোল। এরপরে বিদায় জানিয়ে দেন ফুটবলকে – ‘I enjoyed football to the maximum. I hope the people have enjoyed it alongside me.’
নিজের ফুটবল ক্যারিয়ার নিয়ে রিকুয়েলমের সরল স্বীকারোক্তি। বিতর্ক সঙ্গে ছিল সবসময় কিন্তু রিকুয়েলমে চলেছে নিজের গতিতে, নিজের মতন করে। ফুটবলের সৌন্দর্য্যের জন্যে খেলেছেন সবসময়। এদুয়ার্দো গালেয়ানো, জর্জ ভালদানোদের প্রশংসা নিশ্চিত পেতেন।
নিজের পাস থেকে সতীর্থদের গোল তাঁকে দিতো পরম শান্তি। রিকুয়েলমে আসলে একটি আইডিয়ার নাম। মডার্ন ফুটবলে যার স্থান নেই। সেই কারণেই রিকুয়েলমে নিজের সুরেই গান গেয়েছেন সবসময়। তোয়াক্কা করেননি কিছুরই। রিকুয়েলমের আইডল ছিল ব্রাজিলিয়ান সক্রেটিস। সক্রেটিসের বিশ্বাস ছিল ফুটবল হচ্ছে একটা বিশুদ্ধ শিল্প। আর কোনো সুন্দর কিছু অর্জনে শুধু ম্যাচজয়ই সব নয়। আর রিকুয়েলমে সেই জন্যেই খেলেছেন সবসময়।