সে এক অলস কবি

তিনি ফুটবলার ছিলেন না কেবল। তিনি একজন কবি। আরেকটু ভালো করে বললে বলা যায়, তিনি একজন মাঝমাঠের দার্শনিক। হোর্হে ভালদানো বা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার মতো তার নামের আগে ‘পণ্ডিত’ শব্দটা কেউ বসায়নি। তারপরও তিনি একজন ফুটবল চিন্তাবিদ। তিনি এক ও অনন্য হুয়ান রোমান রিকুয়েলমে।

গ্যালারি ভর্তি লাখো দর্শকের গলা ফাটানো চিৎকার চলছে; প্রবল উত্তেজনা।

দু দলের খেলোয়াড়দের মুখ বেয়ে গড়াচ্ছে ফোটা ফোটা ঘাম। খেলার সময় শেষ হয়ে আসছে। যে বল পাচ্ছে, সেই ছুটছে; গোল করতে হবে। এর মধ্যে ডিফেন্স থেকে নিখুঁত পাস চলে এলো তাঁর পায়ে। তিনি বলটা থামালেন, বলের ওপর পা তুলে দিলেন এবং ঠিক মাঝমাঠে দাড়িয়ে পড়লেন।

তিনি কিছু ভাবছেন।

চারপাশে খেলোয়াড়রা চিৎকার করছে। সতীর্থরা পাস চাইছে। তিনি নির্বিকার। বলের ওপর পা রেখে দাড়িয়ে আছেন। যেনো চলচিত্রের দৃশ্যের মতো ঠাৎ স্থির হয়ে গেলো দুনিয়া। ধীর গতিতে চলতে শুরু করলো ঘড়ি। তিনি ভাবছেন। আস্তে আস্তে সকলে শান্ত হয়ে এলেন। খেলোয়াড়দের গতি কমে এলো।

তার মুখে এবার স্মিত একটা হাসি। খেলাটা এখন তার নিয়ন্ত্রণে। এবার সামনে তাকিয়ে প্রতিপক্ষের দূর্গটা দেখে নিলেন; একবার চোখ বোলালেন নিজের স্ট্রাইকারদের দিকে। একটু পা দুলিয়ে ভূবন চেরা একটা পাস দিলেন; বল চলে গেলো বিশ্বসেরা খেলোয়াড়টির পায়ে। তিনি একা একাই শিশুদের মতো হেসে উঠলেন।

যেনো ফুটবল খেললেন না; একটা কবিতার লাইন রচনা করলেন।

হ্যাঁ, তিনি ফুটবলার ছিলেন না কেবল। তিনি একজন কবি। আরেকটু ভালো করে বললে বলা যায়, তিনি একজন মাঝমাঠের দার্শনিক। হোর্হে ভালদানো বা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার মতো তার নামের আগে ‘পণ্ডিত’ শব্দটা কেউ বসায়নি। তারপরও তিনি একজন ফুটবল চিন্তাবিদ। তিনি এক ও অনন্য হুয়ান রোমান রিকুয়েলমে।

একান্তই আমাকে রেটিং করার দায়িত্ব দিলে আমি রায় দিয়ে দেবো যে, আর্জেন্টিনার ইতিহাসে জন্ম নেওয়া অন্যতম প্রতিভাধর ফুটবলারটির নাম রিকুয়েলমে। আর্ন্তজাতিক বা ইউরোপিয়ান ফুটবলে তার প্রতিভার এক শতাংশও অনুবাদ হয়নি। কেবল কয়েকটা ঝলক দেখা গেছে মাত্র। আর তাতেই দিব্যি পরিষ্কার যে, মাঝ মাঠে দুনিয়ায় রিকেলমের মত কবি খুব বেশি দেখা যায়নি।

আরও শ খানেক আর্জেন্টিনার অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের মত ছোটবেলায় তাকেও ‘নতুন ম্যারাডোনা’ বলে ডাকা হতো। কিন্তু ম্যারাডোনার সাথে তার মিলের চেয়ে অমিলই বেশি ছিলো।

হ্যাঁ, বল কন্ট্রোল, ড্রিবলিং, সেট পিস; এসব বিবেচনায় ‍নিলে ১৯৯৪ সালে ম্যারাডোনার বিদায়ের পর রিকেলমেই ছিলেন আর্জেন্টিনার সেরা আবিষ্কার। অন্তত ১৯৯৭ সালের যুব বিশ্বকাপে তাকে দেখে তেমনটাই মনে হচ্ছিলো।

কিন্তু ম্যারাডোনার চেয়ে অনেকটাই আলাদা ছিলেন। ম্যারাডোনার সেই তীব্র গতি কখনোই তার ছিলো না। ম্যারাডোনা বল পেলেই ছুট দিতেন, প্রবল গতিতে ড্রিবল করতেন। আর রিকুয়েলমে ছোটবেলা থেকেই উল্টোটা। বল পেলে প্রথমেই একটু থমকে যেতেন। ড্রিবল করতেন অনেক আস্তে আস্তে। প্রতিপক্ষকে  পাশ কাটাতেন মোহনীয় ভঙ্গিতে।

তার এই ফুটবল খুব মানিয়ে গেলো আর্জেন্টিনার দার্শনিক কোচ হোসে পেকারম্যানের সাথে। এই একটা লোকই ঠিকমত বুঝতে পেরেছিলেন এবং ব্যবহার করতে পেরেছিলেন রিকেলমেকে। তাকে নিয়ে পেকারম্যান একটি যুব বিশ্বকাপ, একটি যুব দক্ষিণ আফ্রিকান চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ফ্রান্সের একটি টুর্নামেন্ট জেতেন। তিনটি টুর্নামেন্টেই রীতিমতো ম্যাজিশিয়ান ছিলেন রিকেলমে। এখান থেকেই রিকুয়েলমেকে মূল দলে দেখার দাবিটা উঠতে থাকে।

এর মধ্যে বোকা জুনিয়র্সেও মাঠ মাতাতে শুরু করেছেন রিকুয়েলমে। সেখানে রীতিমতো লম্বা জাদুকর হিসেবে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। সবমিলিয়ে আর্জেন্টিনা তখন তাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। এই স্বপ্ন থেকেই ১৯৯৯ সালের কোপা দলে ডাকা হলো তাকে। আর্জেন্টিনা ব্যর্থ হলেও রিকুয়েলমে নজর কাড়লেন। কিন্তু ২০০২ সালের মার্সেলো বিয়েলসার দলে তার জায়গা হলো না।

বিয়েলসা বলেছিলেন, ২০০২ বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা দলটি ইতিহাসের সেরা দল। সেই দল প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিলো। ফলে আর্জেন্টিনা নতুন করে সবকিছু গোছাতে শুরু করে। ২০০৫ সাল থেকে নতুন আর্জেন্টিনার প্রাণভোমরা হয়ে ওঠেন রিকেলমে। এবং এই দলের দায়িত্ব পান তার ছোটবেলার কোচ পেকারম্যান।

ফলে আরও বেশি জায়গা এবং আরও বেশি স্বাধীনতা নিয়ে খেলতে শুরু করেন রিকেলমে।

এই আর্জেন্টিনার জাদুকর ততোদিনে পৌছে গেছেন বার্সেলোনায়। বার্সেলোনার স্কাউটরা মুগ্ধ ছিলো এই প্লে মেকারের খেলায়। কার্যত ইয়োহান ক্রুইফ যে বার্সেলোনার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটা সত্যি করতে মাঝ মাঠে দরকার ছিলো এই রিকেলমের মত কাউকে; যেটা পরবর্তী কালে জাভি-ইনিয়েস্তা করেছিলেন। কিন্তু রিকুয়েলমে যখন বার্সেলোনায় গেলেন, তখন সেখানে এক অন্ধকার যুগ চলছে।

ক্লাবের দর্শনের একেবারেই বিপরীত মানসিকতার লুই ফন গাল তখন বার্সেলোনার কোচ। আর ফন গাল নিজে চলেন সহকারী কোচ হোসে মরিনহো। মরিনহো-ফন গাল জুটি শুরু থেকেই রিকুয়েলমের সাথে বিমাতাসূলভ আচরণ করছিলেন। ফন গাল তো মিডিয়াতেই বললেন, ‘রিকুয়েলমে একটা পলিটিক্যাল সাইনিংস। আমি তাঁকে খেলাবো, এমন নিশ্চয়তা নেই।’

তাই হলো।

ম্যাচই পেতেন না খুব একটা রিকুয়েলমে। যদিওবা দু একটা ম্যাচে নামানো হতো, তাকে কোথায় খেলানো হতো, জানেন? উইংগার হিসেবে খেলানো হত এই নিখাদ প্লে মেকারকে!

প্রথমে ধারে ও পরে দল বদলে ভিলারিয়ালে গিয়ে শ্বাস নিতে পেরেছিলেন রিকেলমে।

ভিলারিয়ালে থাকতেই ২০০৬ বিশ্বকাপ খেলতে গেলেন জার্মানিতে। জার্মানির বিপক্ষে হেরে ছিটকে যাওয়ার আগে আর্জেন্টিনা এক অসাধারণ সুন্দর ফুটবল দেখালো বিশ্বকাপ জুড়ে। পেকারম্যানের দলের সেই সুন্দর ফুটবলের প্রাণ ছিলেন রিকেলমে। আইভরি কোস্টের বিপক্ষে অ্যাসিস্ট করে শুরু করলেন। এরপর সার্বিয়া-মন্টেনেগ্রোর বিপক্ষে সেই তুলকালাম কাণ্ড। সর্বকালের সবচেয়ে সুন্দর গোলের একটি বলে কথিত ২৪ পাসের গোলটার মূল ছিলেন এই রিকেলমে। এ ছাড়াও ম্যাচে দুটি গোলের উৎস ছিলেন তিনি। ওই ম্যাচে শতাধিক সফল পাস দিয়েছিলেন; কোনো ভুল পাস করেননি।

২০০৭ কোপা আমেরিকাতেও ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে হারের আগ পর্যন্ত সেই জাদু দেখা গেলো। তখন সারা বিশ্ব আবিষ্ট রিকেলমেতে। ২০০৮ সালে অলিম্পিক সোনা জিতে কিছু একটু পাওয়ার তৃপ্তিটা অন্তত পেলেন।

সে বছরই প্রথমবারের মতো জাতীয় দল ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন। কারণ হিসেবে বলেছিলেন, তাকে টিভিতে খেলতে দেখলে মায়ের শরীর খারাপ করে। তারপরও তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিলো।

কিন্তু দুনিয়ার বিস্ময় হয়ে ২০১০ বিশ্বকাপের দলে ঠাই পেলেন না।

ম্যারাডোনা সেই দলটা নিয়ে তালগোল পাঁকিয়ে ফেলেছিলেন। ট্রেবল জয়ী ইনফর্ম হ্যাভিয়ের জানেত্তি ও এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসোকে দলে নিলেন না ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনার ইতিহাসের সেরা ডিফেন্ডার জানেত্তিকে তার সোনালী সময়ে দলে না ডাকাটাই সবচেয়ে বড় ক্রাইম। এর সাথে তিনি রিকুয়েলমেকেও ডাকলেন না!

রিকুয়েলমের সাথে অবশ্য ম্যারাডোনার ইগোর লড়াইটা চলছিলো বেশ আগে থেকেই।

মেসির সাথে হ্যাভিয়ের জানেত্তি, ক্যাম্বিয়াসো, রিকুয়েলমে থাকলে ২০১০ বিশ্বকাপটা নিশ্চয়ই অন্যরকম হতে পারতো। তা হয়নি। হয়নি বলেই ২০০৮ সালের পর আর কখনো জাতীয় দলে খেলা হলো না।

২০০৭ সালেই বোকা জুনিয়র্সের হয়ে খেলার জন্য দেশে ফিরে এসেছিলেন। ২০১৪ সালে আর্জেন্টিনা জুনিয়র্স দলের হয়ে শেষ প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলেন। এরপর আর খেলাটা টানেনি তাকে। জীবন ও ক্যারিয়ারের মতই নীরবে চলে গেছেন ফুটবল থেকে।

এখনও ফুটবল মাঠে যান তিনি। এখন বোকা জুনিয়র্সের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। সেখানেই অফিসে হয়তো চলতে থাকে ফুটবল। হয়তো সেখানে বসেই কোপা আমেরিকায় মেসির একটা ড্রিবল দেখে বলে ওঠেন-ইস!

নাকি, খেলাটাও দেখেন না। তাকে নিয়ে অনুমান করা তো শক্ত। কবিরা কোনো অনুমানের ধার ধারে না।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...