‘পাপা’ পেরেজ: এল প্রেসিদেন্তে

বর্তমানে পেরেজ রিয়ালে একজনই, তাঁর কোনো তুলনা নেই। তিনি রিয়ালকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন যা ২০০০ সালে কেউ ভাবতেও পারতো না। এটি এমন এক যুগ যেখানে অর্থই শেষ কথা আর রিয়াল সেখানে অদম্য। পেরেজ যদি রিয়ালে না আসতেন তাহলে রিয়াল এখন পর্যন্ত জায়ান্ট থাকতে পারত কিনা সেটা একটা প্রশ্ন।

বর্তমানে ফুটবল বিশ্বে দ্যা সুপার লিগ একটি আলোচনার নাম। যে লিগ কমিটির প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। রিয়াল মাদ্রিদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট যে ফুটবল বিশ্বে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেছিলেন তা পুরোপুরি সফল হয়নি। তবে পেরেজ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে যেমন ভাবে কথা বলছেন তাতে বোঝা যাচ্ছে যে দ্যা সুপার লিগ নিয়ে এখনো তিনি আশা ছাড়েননি।

কেবল সুপার লিগ আইডিয়া দিয়ে বিশ্ব কাঁপিয়ে দিয়েছেন, তাই নয়। এই মানুষটি দীর্ঘকাল ধরে ফুটবল জগত কাঁপাচ্ছেন। একটার পর একটা চমক দিয়েছেন এই জগতটাকে। একের পর এক গ্যালাক্টিকো গড়েছেন। তিনি হয়ে উঠেছেন, শ্রদ্ধার দ্যা প্রেসিডেন্ট বা ভালোবাসার পাপা পেরেজ।

পেরেজের জন্ম ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে স্পেনের মাদ্রিদে। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। পেরেজ ব্যবসার পাশাপাশি কিছুদিন রাজনীতিতেও ছিলেন। তার নিজস্ব কোম্পানি হচ্ছে এসিএস।

১৯৯৫ সালে তিনি রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু হেরে যান। ২০০০ সালে আবার নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। তবে এবার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য তিনি নতুন চাল চালেন।তিনি ঘোষণা দেন যে তিনি যদি জয়ী হন তবে বার্সালোনা থেকে বার্সার প্রধান খেলোয়াড় ও অধিনায়ক ফিগোকে রিয়াল মাদ্রিদে নিয়ে আসবেন। সবাই এটাকে হাসি-তামাশা হিসেবে নিলো। কিন্তু পেরেজ বলে বসলেন তিনি যদি না জেতেন এবং ফিগোকে রিয়ালে না আনতে পারেন তবে তিনি সকল মাদ্রিদিস্তাকে এক বছর ফ্রিতে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে খেলা দেখতে দেবেন।

পেরেজ কি জিততে পেরেছিলেন? ফিগো কি এসেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে? অবশ্যই,পেরেজ জিতেছিলেন এবং ফিগো রিয়াল মাদ্রিদে এসেছিলেন। তবে ফিগোকে রিয়ালে আনার পেছনের গল্পটাও বিস্ময়কর। ফিগোকে রিয়ালে আনার ঘোষনা যখন দেন তখন তিনি ফিগোর এজেন্টকে ২ মিলিয়ন ডলার দেন এবং বলেন যদি তিনি জেতেন তবে ফিগোকে রিয়ালে আসতে হবে আর যদি তিনি হেরে যান তবে টাকা ফেরত দিতে হবেনা। ফিগোর এজেন্টও খুশিমনে টাকা নিয়েছিলেন। অন্য সবার মতোও তিনিও ভেবেছিলেন যে পেরেজ জিততে পারবেননা।

কিন্তু পেরেজ নির্বাচনে জিতে যান এবং ফিগোও রিয়ালে আসেন।ফিগোকে রিয়ালে আসতেই হতো কেননা পেরেজ যখন ফিগোর এজেন্টকে ২ মিলিয়ন দেন তখন সেই চুক্তিতে লেখা ছিল যে যদি ফিগো না আসেন তবে তাকে পেরেজকে ১৯ মিলিয়ন দিতে হবে। ফিগোর আসার মধ্য দিয়ে রিয়ালে শুরু হয়েছিল গেলাক্টিকো বা তারার মেলা।

পেরেজ যখন প্রেসিডেন্ট হয়ে রিয়ালে আসেন তখন রিয়াল মাদ্রিদ ঋণের ভারে জর্জরিত। ঋণ প্রায় ৩০০ মিলিয়ন। পেরেজ তখন কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নেন। রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাব যেটি মাদ্রিদের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সেটাকে ৫০০ মিলিয়নে বিক্রি করে দেন। যা নিয়ে ওই সময়ে অনেক সমালোচনা হয়েছিল।

পেরেজের মাথায় ছিল রিয়ালের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করা। তখন রিয়াল মাদ্রিদ কেনা শুরু করে এমন সব ফুটবলার যারা তাদের সেরা সময়ে আছেন, যাদের দর্শকমহলে প্রচুর জনপ্রিয়তা রয়েছে, যাদের অনেক বেশি বিপণন মূল্য রয়েছে। সেইসব ফুটবলারদের অনেকেই তাদের ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে ছিলেন কিন্তু পেরেজের কাছে তারা ছিলেন সাফল্যের চাবিকাঠি এবং অবশ্যই বাণিজ্য।

পেরেজ আর্থিক দৈন্যদশায় থাকা এক ক্লাবে নিয়ে আসেন ফিগো, রোনালদো, জিদান, ওয়েনের মতো তারকাদের। রোনালদিনহোকে পেরেজ রিয়ালে আনেননি শুধুমাত্র তার স্মার্টনেসের অভাবের কারণে। এজন্যও পেরেজকে অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তাছাড়া ডেভিড বেকহামকেও রিয়ালে ভেড়ান পেরেজ। যাকে ভেড়ানোর মাধ্যমে রিয়ালের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটে।

রিয়ালের সেই সময়কার তারকাদের মেলাকে বলা হতো গ্যালাক্টিকো। তবে গ্যালাক্টিকোকে নিয়েও অনেক সমালোচনা ছিল। পেরেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি ছিল এই বিষয়ে যে তিনি দলে অনেক হস্তক্ষেপ করতেন। দেল বস্ক ৫ মৌসুমে রিয়ালকে ২ বার লা লিগা এবং ২ বার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানোর পরেও পেরেজ তাকে কোচ হিসেবে রাখেননি। অবশ্য এর পেছনে পেরেজের কাছে একটা কারণ ছিল। সেটা হচ্ছে এই যে, রিয়াল তখন দলে শুধু তারকা ফুটবলার ঢুকাতেই ব্যস্ত ছিল কিন্তু দেল বস্কের দরকার তার স্টাইল এর সাথে মিল খায় এমন খেলোয়াড় আসছিলো না।।

ফলে এই বিষয়ে পেরেজ ও দেল বস্ক এর মধ্যে মনোমালিন্য হয়। তাই দেল বস্ক কোচ হিসেবে টিকতে পারেননি। তবে দেল বস্ক যাওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দলের মধ্যে সংকট দেখা দেয়।রিয়ালের আয় হচ্ছিল কিন্তু খেলার মাঠে অনেক ব্যর্থতা ছিল। তাই ২০০৬ সালে দলের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে পেরেজ রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে যান।

২০০৯ সালে আবার ফেরেন পেরেজ। এসেই দলে নিয়ে আসেন কাকা, রোনালদো, জাবি আলেন্সোর মতো বিশ্বসেরা খেলোয়াড়দের। তবে সেই সময়ে বার্সালোনা পেপ গার্দিওলার অধীনে এক ড্রিম টিমে পরিণত হয়। তাই পেরেজ রিয়ালে নিয়ে আসেন জোসে মরিনহোকে।

মরিনহো আসার পর রিয়াল লা লিগায় শিরোপা লাভ করলেও চ্যাম্পিয়নস লিগ ছিল অধরা। তাই মরিনহোকেও দল ছাড়তে হলো। কোচ হয়ে এলেন কার্লোস আনচেলোত্তি। রেকর্ড ট্রান্সফারে দলে আসেন গ্যারেথ বেল। দলে আসেন ইস্কো, ইয়ারামেন্দিরাও। আনচেলোত্তি এসে চ্যাম্পিয়নস লিগ ও কোপা দেল রে জেতালেও পরের মৌসুমে দল ট্রফিলেস থাকায় তাকেও পেরেজ বরখাস্ত করেন।

নিয়োগ পান রাফা বেনিতেজ। কিন্তু বেনিতেজের সময়ে অন্ধকার যুগে ফিরে যায় রিয়াল। পেরেজ বেনিতেজকেও ৬ মাসের মধ্যে বরখাস্ত করেন। তারপর রিয়াল মাদ্রিদের দায়িত্ব পান দ্যা গ্রেট জিনেদিন জিদান। জিদানকে কোচ হিসেবে নিয়ে আসাটা ছিল পেরেজের জন্য প্রায়শ্চিত্ত এর সমান। তারপরের গল্পটা তো সবার জানা।পেরেজ জিদানের হাত ধরে পেতে শুরু করলেন ফল।

পেরেজ বিখ্যাত ছিলেন তার ঝড়ো সাইনিং এর জন্য। তবে সময়ের সাথে সাথে পেরেজও বদলে যেতে থাকেন। কোনো খেলোয়াড়কে ২৫ বছর বয়সে ১০০ মিলিয়নে আনার চাইতে তিনি ১৮ বছরে ১০ মিলিয়নে কেনার সিদ্ধান্ত নেন। ক্রুস,ক্যাসেমিরো, এসেন্সিও, লরেন্তে, ভাজকেজ, ভারানে, থিও এদেরকে তাদের পরিণত অবস্থায় কিনলে রিয়ালকে ১০ গুণ বেশি খরচ করতে হত। এখন পেরেজ যুব প্রতিভাদের দলে নিয়মিত ভেড়াচ্ছেন। যা বার্সা আগে করতো, রিয়াল সেটা এখন করছে।

পেরেজের আরো সমালোচনার মধ্যে একটি ছিল প্রভাবশালীদের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ভিআইপি বক্সে নিয়মিত দেখা যায় স্পেনের প্রভাবশালীদের। তাছাড়া সংবাদ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণেও তিনি অভিজ্ঞ। এটা তিনি করেন ভিআইপি টিকেট এর দ্বারা। কোনো খেলোয়াড় কেনার ক্ষেত্রে রিয়ালের শেষ অস্ত্র তিনি।

বর্তমানে পেরেজ রিয়ালে একজনই, তাঁর কোনো তুলনা নেই। তিনি রিয়ালকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছেন যা ২০০০ সালে কেউ ভাবতেও পারতো না। এটি এমন এক যুগ যেখানে অর্থই শেষ কথা আর রিয়াল সেখানে অদম্য। পেরেজ যদি রিয়ালে না আসতেন তাহলে রিয়াল এখন পর্যন্ত জায়ান্ট থাকতে পারত কিনা সেটা একটা প্রশ্ন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...