নিয়ন আলোয় সাজানো জিদান

আলজেরিয়ার রিফিউজি ক্যাম্প থেকে ফ্রান্সে চলে আসা একটা ছেলে ফুটবল খেলতে শুরু করল তখন। ওর নাম জিদান। ভাল ফুটবল খেলত। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে তাঁকে কেউ চিনত না। অথচ, দশক শেষের দিকে ন্যাড়ামাথার লোকটা ফ্রান্সের নয়নের মণি হয়ে উঠল। তখন অবশ্য পুরো মাথা ন্যাড়া ছিল না। কলকাতার অনেকে বলতো ঐ মাথাটা নাকি দৈব শক্তিতে তৈরি। ফাইনালে দু’খানা গোল এসেছিল ঐ মাথা থেকেই।

নয়ের দশক। পৃথিবীতে এমন একটা সময় এসেছিল। সে সময় মানুষ খবরে পড়ল তাদের ফুটবল ঈশ্বর ড্রাগ নিয়ে ধরা পড়েছে। মুষড়ে পড়েছিল কলকাতা। সদ্য সত্যজিৎ রায় চলে গেছেন। ভেঙে পড়েছিল কলকাতা। ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতে গেল সেবার ইতালির নয়া সুপারস্টার রবার্তো বাজ্জিওর পেনাল্টি মিসে।

কেউ কেউ রিমোট চেপে ধরেছিল। কারো কারোর চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছিল। আলজেরিয়ার রিফিউজি ক্যাম্প থেকে ফ্রান্সে চলে আসা একটা ছেলে ফুটবল খেলতে শুরু করল তখন। ওর নাম জিদান। ভাল ফুটবল খেলত। নব্বই দশকের গোঁড়ার দিকে তাঁকে কেউ চিনত না।

অথচ, দশক শেষের দিকে ন্যাড়ামাথার লোকটা ফ্রান্সের নয়নের মণি হয়ে উঠল। তখন অবশ্য পুরো মাথা ন্যাড়া ছিল না। কলকাতার অনেকে বলতো ঐ মাথাটা নাকি দৈব শক্তিতে তৈরি। ফাইনালে দু’খানা গোল এসেছিল ঐ মাথা থেকেই।

সে আনমনা ছিল। মন খারাপি এক বাউল ছিল। তার রাগ ছিল, যন্ত্রণা ছিল, আর্তি ছিল। মার্সেইয়ের রাস্তার গোলকধাঁধার বাইরে একটা জগত দেখার আকুল বাসনা ছিল। রিফিউজি তকমা ঝেড়ে ফেলার অদম্য জেদ ছিল। বদ্ধ ফরাসি দুর্গের অন্ধকার থেকে ছুটে পালানোর লক্ষ্য ছিল। জীবনে চলার পথে পায়ে পায়ে কাঁকর বিছিয়ে দিত সমাজ।

তখন সে ফুটবলকে আঁকড়ে ধরতো। ড্রিবল তার সহজাত, সে যান্ত্রিক পরিবেশনার বিরোধী ছিল। জিদান ফুটবলার ছিল। সেটার মধ্যে লুকিয়ে ছিল পরিশ্রম, সহজাত দক্ষতা এবং অনেক বেশি জন্মগত প্রতিভা।

আটানব্বইয়ের ফ্রান্সের সাথে দু’হাজার আঠারোর ফ্রান্সের অনেক পার্থক্য। সে সময়ের জিদান হাফভলিতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে গোল করতো। অনেকেই দেখেছে, জেনেছে। এই জিদান এখন বের্নাবৌয়ের ট্রফি ক্যাবিনেট ভরায়। নতুন ছেলেদের শিল্পী করে তোলে।

এই জিদান নাকি এখন অনেক পরিণত। জিতলে উচ্ছ্বসিত হয় না, মুখে এক চিলতে হাসির ছোঁয়া থাকে শুধু, আবার হারলেও ভেঙে পড়ে না। এই জিদান ট্রফি জিতলে জার্সির লোগোতে চুমু খেয়ে গোটা মাঠে দৌড়ে বেড়ায় না। সৌম্যকান্তি পরিচয় নিয়ে এই জিদান ঘুরে বেড়ায় মাদ্রিদের রাস্তায়। এই জিদান আর অপনেন্টের কথায় উত্যক্ত হয়ে ঢুঁসো মারতে যায় না। বিশ্বকাপের পাশ দিয়ে হেঁটে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়া এই জিদান এখন অনেক পরিণত।

জিদান নিয়ন আলোয় সাজানো কলকাতা। যেখানে সব হয়। আড্ডা, হাসিঠাট্টার সাথে মনখারাপের পাহাড়ও জমে যায়। ফুটবলপাগল প্রেমিক প্রেমে ব্যথা পেলে ২০০৬-এর ব্রাজিল-ফ্রান্স কোয়ার্টার ফাইনাল দেখতে বসে যায়। রবার্তো কার্লোসের কাছ থেকে ডান পায়ে, বাঁ পায়ে বল নিয়ে ফরোয়ার্ড পাসের মধ্যে সে নতুন করে ভালবাসা খুঁজে পায়।

গোটা মাঠ জুড়ে জিদান বাঁশি বাজিয়ে চলেন। তার জন্য স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন বলেন, ‘আমাকে একটা জিদান আর দশটা কাঠ দাও। আমি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতিয়ে আনব’। জিদান সব শোনেন। শুনেও বাঁশি বাজিয়ে চলেন। গড্ডলিকায় ভেসে যাওয়ার স্বভাব থেকে সে অনেক আলোকবর্ষ দূরে।

সেই দশ নম্বরের জন্মদিন ২৩ জুন। কারো কারোর জন্মদিনে আনন্দ করতে নেই। পিছনে ফিরে তার রেখে যাওয়া সৃষ্টি দেখতে হয়। একজন শিল্পীর প্রতি সম্মানে, শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...