ডি স্টেফানো, দ্য ডন

মেয়েটার নাম সারা। বোকা জুনিয়র্সের সমর্থক। রিভার প্লেটে খেলা এক ছেলের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব। দুইজন দুই দলের হওয়াতে তাঁর মধ্যে ঝামেলা হয়। তবে ঝামেলাটা ভিন্ন কিসিমের। বোকা-রিভার ম্যাচে বোকা জিতে গেলে ছেলেটা চকোলেট বক্স উপহার দেয় আর রিভার জিতলে মেয়েটা।

একটা সময় দুইজনের মধ্যের এই প্রীতি চকোলেট অদলবদলের সম্পর্ক বদলে যায়। না দুজনের বন্ধুত্বের নষ্ট হয়নি।আসলে সারা রিভার প্লেটের সমর্থক বনে যায়। রিভারে খেলা ছেলেটার নাম আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। আর সারার পুরা নাম সারা ফ্রেইতেস – ১৯৫০ সালে যাদের বিয়ে হয়।

কিংবদন্তি কোচ ভ্যালেরি লোবানোভস্কি বলেছিলেন ফুটবলার হিসেবে কে কেমন হবে সেটা জানার জন্যে সেই প্লেয়ারের সাইকোলজি আগে বুঝতে হবে। তাকে কীভাবে সাহায্য করা যাবে,এই ব্যাপারটা তখন সহজ হয়ে যায়। সারার সাথে পরিচয়ের সময় স্টেফানোর বয়স ১৮-১৯ হবে। জীবনসঙ্গিনী বেঁছে নিতে সেটাই যথেষ্ট ছিল তার। ব্যক্তিগত জীবনে গোছানো ডি স্টেফানোর ফুটবল জীবনটাও একেবারে সুন্দর করে গোছানো।সেটা লোবানোভস্কির সূত্রানুসারে এতক্ষণে বুঝা হয়ে গেছে সবার।

যেকোন গ্রেট ফুটবলারই নির্দিষ্ট একটা পজিশনের জন্যে বিখ্যাত। পেলে, অসাধারণ একজন ফরওয়ার্ড, পেনাল্টি বক্সে ত্রাস। মেসি-ম্যারাডোনা, যারা ড্রিবলিং উইজার্ড, যারা একজন ফরওয়ার্ডের পেছনে দুর্দান্ত। অবশ্য মেসি আক্রমণভাগের যেকোনো পজিশনই সেরা। একজন প্লেয়ারের ভারসাটিলিটির কথা আনলে আমার মনে হয় না কেউ ডি স্টেফানোর ধারেকাছে আসতে পারবে।

মাদ্রিদ যেবার স্কটল্যান্ডের হ্যাম্পডেন পার্কে টানা পঞ্চমবারের মতন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা স্পর্শ করেছিল জার্মানির এইন্টট্র্যাক ফ্র্যাঙ্কফুটকে ৭-৩ বিধ্বস্ত করে সেই ম্যাচে ক্রেসের গোলে কিন্তু জার্মান ক্লাবই এগিয়ে গিয়েছিল শুরুতে। অবশ্য সেই লিড মিনিট পাচেকের বেশি স্থায়ী ছিল না।

স্টেফানোর ৩ আর পুসকাসের ৪ এ ঠিকই ম্যাচ জিতে মাদ্রিদ। ওই ম্যাচে স্টেফানো অনেকটা সময় খেলেছিলেন মিডফিল্ডে। মানে একেবারে টিপিক্যাল সেন্ট্রাল মিডফিল্ড রোলে। ওখান থেকেই বলের যোগান দিতেন আবার দৌড়ে গিয়ে রিটার্ন পাসে গোল করতেন। ওই ম্যাচে ডি স্টেফানোর পারফর্ম্যান্স একটা আলাদা ফিচার ডিজার্ব করে। এতটাই দুর্দান্ত খেলেছিলেন।

সর্বকালের সেরাদের লিস্ট করা হয়ে থাকে সবসময়। ডিফেন্ডার-ফরওয়ার্ড সব পজিশনেরই। একমাত্র ডি স্টেফানোকেই একই সাথে সেরা মিডফিল্ডার এবং ফরওয়ার্ডের লিস্টে আপনি পাবেন। হয়তোবা সেরা ‘নাম্বার দশ’ এর তালিকাতেও নাম থাকবে দ্যা ব্লন্ড অ্যারোর নাম। ডি স্টেফানোর বাবা রিভার প্লেটে খেলেছিলেন একসময়। যদিও নিজে তো নেননি এমনকি স্টেফানোও যাতে ফুটবলকে ক্যারিয়ার হিসেবে না নেয় সেটাই চেয়েছিলেন আলফ্রেডো সিনিয়র।

কিন্তু, ফুটবল তো এসছে ডি স্টেফানোদের জন্যেই। আলফ্রেডো সিনিয়রের আমলের রিভার প্লেট গোলি, যিনি প্রফেশনালি একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান ছিলেন, একবার এক কাজের জন্যে স্টেফানোদের বাড়িতে আসলে কথা প্রসঙ্গে শুনলেন ডি স্টেফানোর ফুটবল খেলার কথা।এই লোকের হাত ধরেই রিভার প্লেটে যাওয়া। ১৭ তেই শুরু।

দু’বছরের মধ্যেই রিভার প্লেট দলে জায়গা করে নিলেন। ব্যাপারটা কিছুটা হবার করার মতন।ডি স্টেফানোর দুই বছর লাগলো! আসলে তখনকার রিভার প্লেট যে বিশ্বের সেরা। ছিল তাদের তখনকার আমলের সবচেয়ে ভয়ংকর অ্যাটাকিং লাইন আপ। লোস্তাও-লাব্রুনা-পেদেরনেরা-মুনোজ-মোরেনো; এই পঞ্চপাণ্ডবের রিভার প্লেট খেলত সিম্পলি এক্সকুইজিট ফুটবল।

তাঁদের এই আক্রমণভাগ ‘লা ম্যাকিনা’ মানে দ্য মেশিন নামে পরিচিত ছিল। ‘লা ম্যাকিনার’ গ্রেটনেস নিয়ে লিখতে গেলে ডি স্টেফানোকে নিয়ে এক শব্দও লিখা হবে না আর। শুধু একটি কথাই বলি। ডি স্টেফানোকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে, যার উত্তরে ডন আলফ্রেডো বলেছিলেন, ‘লা ম্যাকিনার পাঁচজনের যেকোন একজনকে বেঁছে নাও।’

এই তারকাদের ভিড়ে যাওয়া না পাবার ভয়ে স্টেফানো লোনে চলে যায় আরেক ক্লাব হুরাকানে। এক মৌসুম পরেই রিভারে ফিরে আসলেন। হুরাকানের যদি স্টেফানোকে একেবারে নিজেদের করে নিতে হয় তাইলে তাদের দিতে হত ৮০ হাজার পেসো। এদিকে এর আগে স্টেফানোকে লোনে নিতে কথা বলার জন্যে রিভার প্লেটে এসছিলেন ক্লাব প্রেসিডেন্ট মিলিটারি ম্যান টমাস ডুকো। আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে রেগে গিয়ে পিস্তল পর্যন্ত বের করেছিলেন।তার আলফ্রেডো ডি স্টেফানোকে চাই।

১৯৪৭ সালে স্টেফানোর রিভারের হয়ে ম্যাজিক দেখানো শুরু। ৩০ ম্যাচে ২৭ গোল করে ক্লাবকে জেতালেন লিগ শিরোপা। আবার ওই বছরেই অনুষ্ঠিত কোপা আমেরিকায় ছয় ম্যাচে ছয় গোলে আর্জেন্টিনাকেও দিলেন শিরোপার স্বাদ। এর বছর দুয়েক পরে আর্জেন্টিনায় শুরু হলে ফুটবলারদের আন্দোলন।বন্ধ হয়ে গেল লিগ।

অনেকেই পাড়ি জমালেন কলম্বিয়াতে।স্টেফানোর ঠিকানা হল মিলোনারিওস, যারা ‘ব্লু ব্যালে’ নামেই পরিচিত।কলম্বিয়াতে পাশে পেলেন সাবেক দুই রিভার প্লেট সতীর্থ পেদেরনেরা আর পিপো রসিকে। তিন লিগ আর এক কাপ জিতিয়ে ইউরোপের নজরে স্টেফানো। এর মধ্যে দু’বারই হয়েছেন লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা।

বার্সা ধরেই নিয়েছে তারা স্টেফানোকে কিনেছে মিলোনারিওস থেকে। এদিকে রিভার প্লেটের দাবী প্লেয়ার স্টেফানো এখনো তাদের অধীণে। শুরু হয় গ্যাঞ্জাম। স্পেনের ফুটবল সংস্থা আটকে দেয় এই ট্রান্সফার আর সুযোগ বুঝে কোপটা মেরে দেয় রিয়াল মাদ্রিদ আর তাদের বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। পরে অবশ্য অদ্ভুদ এক চুক্তি করতে চেয়েছিল। দু’দলের হয়েই খেলবেন স্টেফানো, এক সিজন করে করে। বার্সা না মানাতে বাতিল হল আর আলফ্রেডো বনে গেলেন পুরোদস্তর মাদ্রিদ খেলোয়াড়।

মাদ্রিদের হয়ে প্রথম সিজনেই স্টেফানো তাঁর কারিশমা দেখাতে শুরু করেন। ২৮ ম্যাচে ২৭ গোল করে লিগ জিতান দলকে। লিগ শিরোপা আসে ১৯৫৫, ১৯৫৬ মৌসুমেও। স্টেফানো টানা চারটি মৌসুম লা লিগার সর্বোচ্চ গোল স্কোরার ছিলেন।আর টানা পাঁচ ইউসিএল জেতা মাদ্রিদের হয়ে ফাইনালে গোল করেছেন সব ক’টিতেই।

ইউরোপের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ক্লাব হিশেবে নিজেদের আসন নিশ্চিত করতে থাকল রিয়াল মাদ্রিদ। আর নি:সন্দেহে ডি স্টেফানো হচ্ছে এই ব্যাপারে ক্লাবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। শুধুমাত্র গোল স্কোরারই ছিল না স্টেফানো। একই সাথে মিডফিল্ড জেনারেল,প্লেমেকার এবং লিডারও।ব্যক্তিগত দুই ব্যালন ডি’অরের সাথে ক্লাবের হয়ে জিতেন আটটি লিগ শিরোপা।

আরিগো সাচ্চি বলেছিলেন, ‘Di Stefano turned still photographs into the cinema.’ বার্সা কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রইফ বলেন, ‘He was my favorite player, and what I most loved about Di Stefano was everything he did he did for the team.’ স্যার ববি চার্লটনের ভাষায়, ‘He totally controlled the game. You looked at him and asked yourself: ‘how can I possibly stop him?’

ডি স্টেফানোতে মুগ্ধ ব্যক্তিদের তালিকা বেশ লম্বা। যাদের কথা বলেছি তাঁরা তো আছেই। সাথে আছে মিশেল প্লাতিনি, পেলে, ম্যারাডোনা, জাঁ ফন্টেইন এমনকি হেলেনিও হেরেরাও। এই আর্জেন্টাইন কোচ হেরেরা ছিল বেশ খিটখিটে, সহজে কারো প্রশংসা করতেন না।

ইতালির ইন্টার মিলান নিয়ে বেশ সফল এই কোচ সবার থেকে এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘Alfredo Di Stéfano was the greatest footballer of all time – far better even than Pelé. If Pelé is a lead violin, then Di Stéfano is an entire orchestra. He was, simultaneously, the anchor in defence, the playmaker in midfield, and the most dangerous marksman in attack.’

মেসি আর পেপ গার্দিওলার বদলতে ‘ফলস নাইন’ টার্ম এবং এই পজিশনটা বেশ জনপ্রিয় হয় গত দশকে। যদিও ফলস নাইন শুনলেই আমার পড়ে মনে সোয়ান্সি সিটি মিচুর কথা। এক সিজন ওন্ডার মিচু প্রিমিয়ার লিগে পুরো তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। যাই হোক,এই মেসি-মিচুদের অনেক অনেক অনেক বছর আগেই এই পজিশনে খেলে ফুটবল রাজত্ব করেছিল ডি স্টেফানো।

আসলে ডি স্টেফানো ছিলেন ‘falser than the falsest of false nines.’ আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে জার্সির পিছনে নাম্বারটা শুধু একটা নাম্বার। মাদ্রিদের হয়ে স্টেফানো যা খেলেছেন তা আসলে একটা পজিশনের মধ্যে আটকে রাখা যাবে না। ডি স্টেফানো এতটাই মেধাবী ফুটবলার ছিলেন যে ডি-বক্স কিংবা মাঠের যেকোন জায়গায় হোক অল্প সল্প একটু স্পেস পেলেই তাঁর সেরা ব্যবহার তিনি করতেনই সবসময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link