বলটা আরও উঁচুতে উঠছে। ওয়াংখেড়ে তাকিয়ে সেই সাদা বলটার দিকে। মেঘের গায়ে আছড়ে পড়লেই ১৩৫ কোটির দেশে ঝরে পড়বে ইতিহাস-চূর্ণ। কয়েক মুহুর্তের অপেক্ষা ৷ তারপর নামল বৃষ্টি। আনন্দের বৃষ্টি।
২৮ বছরের অপেক্ষার পর ক্রিকেট ঈশ্বর মহাকাব্যের শেষ পাতাটা লিখে সপাটে বন্ধ করলেন বইটা ৷ আসমুদ্র হিমাচল দুলে উঠল বিশ্বকাপ সুনামিতে। মহেন্দ্র সিং ধোনির এক দৃষ্টে চেয়ে থাকা চোখ দুটো খেয়াল করেনি ক্যান্সারে পুড়ে যাওয়া এক যোদ্ধা জাপটে ধরেছে তার শরীরটা৷ সম্বিত ফিরতেই বুকের খাঁচায় জাপটে নিলেন তাকে, অনেকগুলো দিন পর যেন নতুন করে পাওয়া পুরোনো বন্ধুকে।
সৌরভ নেই। শচীন নেই। দ্রাবিড় নেই। লক্ষ্মন নেই। কুম্বলে নেই। সৌরভ অধ্যায়ের রূপকথার পর চ্যাপেল যুগীয় অন্ধকার থেকে বেরিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কিছুটা আনকোরা অনভিজ্ঞ দল নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা পাড়ি দিল ভারত। অধিনায়ক তরুণ মাহি। আপাত শান্ত মাহির কাঁধে পাহাড়প্রমাণ চাপটা হয়ত বুঝে নিয়েছিলেন যুবি৷ নিজের ভারী হাতটা যেন প্রিয় বন্ধুর কাঁধে রেখে বলেছিলেন – ‘ভয় পাস না। আমি তো আছি!’
দলের এক ঝাঁক তরুণকে বুক দিয়ে আগলালেন মাহি। যুবি শুরু করলেন সংহার। বিশ্বকাপ শুরু হতেই মাহি-যুবি ম্যাজিক শুরু হল আফ্রিকার মাটিতে। ধোনি খুব ভালো করে জানতেন যুবি ঝলসে উঠলে ভারতের সামনে দাঁড়াতে পারবে না কোনো দল।
অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের সাথে কথা কাটাকাটিটা বাড়তেই তাই নিজের তুরুপের টেক্কার তাসকে আড়াল করতে এগিয়ে এলেন মাহি। যুবির প্রতিভাকে আগলে রাখতে হয়, সে আগুনের মতো, দাবানল হয়ে ছড়াতে পারে। মাহি সেই দাবানলের আগুন বাঁকিয়ে দিলেন ব্রিটিশ ঔদ্ধত্যে। স্টুয়ার্ট ব্রডের ফ্যাকাশে মুখের পাশে সেই দুই বন্ধুর গ্লাভস পাঞ্চ!
দলের কঠিন সময়ে উইকেটের পিছন থেকে মাহির সূচারু চোখ দুটো হয়তো খুঁজে নিত তাঁর ড্রেসিংরুমের সঙ্গীকে। বাঁ-হাতি ওপেনার স্কয়ার কাট শুরু করলেই মাহি আঙুলের ঈশারায় পয়েন্টটা দেখাতেন, মাথার টুপিটা সামলে সেই বিখ্যাত পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়াত ভারতের অস্ত্রভাণ্ডারের সবচেয়ে শাণিত চাকু, উইকেট না এলে পিছন থেকে ভেসে আসত মাহির গলা – ‘যুবি আগে গেম ডাল…’ চোখের ঈশারায় বলটা যুবি ড্রপ ফেলত মাহির এঁকে দেওয়া ম্যাপে। তারপর শুরু হত ভারতের জাতীয় পতাকার অবিরাম আন্দোলন।
২০০৭ জোহানেসবার্গ থেকে ২০১১-এর ওয়াংখেড়ের বৃত্ত জুড়ে রইল দুই বন্ধুর রূপকথা। ভারতীয় দলের কাঠামো গড়তে দু বন্ধু নিজেদের হাতে ঝরালেন রক্ত! মাহি-যুবির ছায়ায় একটু একটু করে বেড়ে উঠল আজকের বিরাট-রোহিতরা।
চোখ মিথ্যা বলে না। যুবরাজ সিং-এর বাবার অবিরাম মাহি বিদ্বেষ কিংবা লক্ষ লক্ষ মিডিয়ার ধোনি-যুবি দ্বন্দ্বকে মাটিতে মিশিয়েই সেদিন মাহিকে আঁকড়ে ধরেছিলেন যুবি। এক অদম্য ফিনিক্স যেন চুম্বন করেছিল আর এক ছাই চাপা অগ্নিশলাকাকে। দুই বন্ধুর চওড়া ব্যাটে পাঁচ বছরে পাল্টে গেল ভারতীয় ক্রিকেটের স্কোরবোর্ড।
‘ভালোবাসা কাছে এলে দূরে সরে যায় শুধু সে ই, সবকিছু আছে যার জড়িয়ে ধরার কেউ নেই’
হয়ত বোহেমিয়ান যুবির আঁকড়ে ধরার কেউ ছিল না, সৌরভ চলে যাবার পর কেউ ছিল না যে ওকে ধমক দিয়ে বলবে ‘প্র্যাকটিস মে লেট মাত কারনা যুবি…’। নিজের খেয়ালে ভেসে যাওয়া এই যুবিকেই দুহাতে আগলে ছিল স্থিতধী মাহি। এক কালো ঘোড়া আর তার যোগ্য জকি’র দৌড় বিশ্বের মানচিত্রে এতগুলো বছর ধরে রঙিন করে দিল ভারতের ম্যাপ, অনেক যন্ত্রণা বুকে নিয়েই হয়ত সেদিন জাপটে ধরেছিলেন যুবি তার প্রিয় বন্ধুকে যে এতগুলো দিন আগলালো তাকে।
শচীন-সৌরভ অধ্যায়ের পর যুবি-মাহি সাম্রাজ্য ছিল ভারতের শেষ দূর্গ। যুবি চলে গেলেন আগে। আরও একা মাহি যেন এখনো হাতরে চলেন কিছু, নিজের মাথার ভেতর খোঁজেন চার নম্বরে ব্যাট করার লোকটাকে, খোঁজেন দলের বিপদে তাঁর এক ডাকে এগিয়ে আসা কলজেটা, খোঁজেন প্রতিপক্ষকে শেষ করতে তাঁর সাথে মাঠে নামার সহযোদ্ধাকে, আর তো ক’টা দিন। এই করতে করতে এখন মাহিও নেই।
তারপরই সেই উড়ে যাওয়া সাদা বলটার আস্তানায় যাবেন দু’জনে। ফের জাপটে ধরবেন দু’জন দু’জনকে।এই মিডিয়া-প্রেস-কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির পৃথিবী থেকে দূরে গিয়ে মনের আনন্দে ব্যাট হাতে নামবেন যুবি-মাহি। নামবেন ক্রিকেট বিশ্বের দুই অদম্য যোদ্ধা, নামবেন ভারতের শেষ অজেয় দূর্গের দুই অতন্দ্র প্রহরী।