ঈশ্বর-পৃথিবী-ভালবাসা-মাদক

সিগারে টান দিয়ে বান্ধবীর গলা জড়িয়ে মাথাটা এলিয়ে দিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। নেশায় বুঁদ হয়ে দুহাতে কী যেন অঙ্গভঙ্গি করতে করতে ঢলে পড়লেন ঘুমে। সকালে দেহরক্ষীরা উদ্ধার করতে এলে তাঁদের অফার করলেন বহুমূল্য সিগার। চোখ টিপে একটা মুচকি হেসে প্রায় অর্ধ-উলঙ্গ হয়েই টলতে টলতে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়।

পিটার বিয়ার্ডস্লে আর পিটার রিডের ক্লোজ মার্কিংটা একটা কোমরের মোচরে ছিটকে দিয়ে বলটা প্লেস করলেন ফ্রি স্পেসে। সামনে বুচার, ফেনউইকের মতো খেলোয়াড়রা ছুটছেন বলটা সাইডলাইন পার করে দিতে। কিন্তু, মেক্সিকোর এস্তাদিও স্টেডিয়ামে লক্ষ লক্ষ সমর্থকের শব্দব্রহ্ম কানে নিয়ে যেন বলের কাছে পৌঁছেই বাঁ পায়ের ইনসাইড টোকায় বলটা কাটিয়ে আবার দৌড় দিলেন তিনি।

দু’জন ব্রিটিশ ডিফেন্ডারের মাঝখান দিয়ে বলটা বার করতেই সামনে দাঁড়ালেন পিটার শিল্টন। সেই পিটার শিল্টন যাকে বলা হয়েছিল শতাব্দীর অন্যতম সেরা গোলরক্ষক। ম্যারাডোনা জানেন ঈশ্বরের হাতে সঁপে দেওয়া ভাগ্য নয় বরং এই চল্লিশ গজ দৌড়টা বুয়েনস আয়ার্সের ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটাকে প্রত্যেকটা ইনসাইড আর আউটসাইড কাটে ধাপে ধাপে স্বয়ং ঈশ্বর বানিয়ে দিয়েছে।

ঐ লম্বা রাস্তাটা সেই ঈশ্বরের স্বর্গমার্গ যেখানে মাটিতে লুটিয়ে রয়েছেন ৭ জন খেলোয়াড়। ম্যারাডোনা জানেন ওই দৌড়টাই ফ্লোরিটো গ্রামের অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা ডিয়োগোকে প্রতিষ্ঠা করেছে চারটে জাদুমাখানো বর্ণমালায়- ‘ম্যা রা ডো না’।

ম্যারাডোনা জানেন ঐ দৌড়টা সারাপৃথিবীর লক্ষ লক্ষ ভিন্ন দল সমর্থকের হাতে তুলে দিয়েছে সাদা নীল পতাকা। ম্যারাডোনা জানেন ঐ দৌড়টা ফুটবল বিশ্বের হলুদ ম্যাপটা আড়াআড়ি ভাবে টুকরো করে এঁকে দিয়েছে সাদা-নীল নকশা তাই এত ইতিহাসের সামনে পিটার শিল্টন হয়ে রইলেন নির্বাক যুবরাজ।

বিষ্ময় চোখে নিয়ে শিল্টন দেখলেন তার দুহাতের ফাঁক দিয়ে বলটা ট্যাংগো মিউজিকের মতো কাটিয়ে নিয়ে ফুটবলের বিষ্ময় বালক জালে ঠেলে দিয়ে হয়ে উঠলেন ফুটবল ঈশ্বর। যার প্রসারিত দু বাহুতে জন্ম নিল একটা জাতি যার নাম – ‘আর্জেন্টিনা’!

আসলে ম্যারাডোনা হাত দিয়ে গোল করলেও তিনি ম্যারাডোনাই থাকেন কারণ সেই হাতে ধরা থাকে সৃষ্টির জাদুদণ্ড। ম্যারাডোনা তাঁর উত্তরসূরীকে হেয় করে বিতর্কের পর বিতর্কে জড়ালেও তিনি ম্যারাডোনাই থাকেন। কারণ কয়েক মুহুর্তের জন্য তা প্রমাণ করে তিনিও মোহ-ঋপুর ধারক কোনো রক্ত মাংসের মানুষ। ম্যারাডোনা মাদক সেবন করে নিয়ম লঙ্ঘন করলেও তিনি ক্যানভাসে এঁকে যান অবচেতনে থাকা কোনো ফুটবল নকশা। কারণ তিনি ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা।

ফুটবল উচ্ছৃঙ্খল-অবাধ্যতার শিক্ষা দেয় না তাই হয়ত নব্বই-এর কান্নায় নিজেই নিজেকে বিদ্ধ করেছেন ফুটবল ঈশ্বর। হয়তো ফুটবল অন্যায় অপমানকে প্রশ্রয় দেয় না বলেই সেই জার্মানির কাছে চার গোল খেয়ে মাথা নীচু করে যেতে হয় ফুটবল ঈশ্বরকেই। সময়ের চাকা যে হিসেব বাকি রাখে না।

ফুটবল ঈশ্বর নিজেও হয়ত কাঁদেন। মনে পড়ে ফ্লোরিটোর বাড়ির পাশে ছোট্ট সবুজ মাঠটার কথা কিন্তু ফিরে যেতে পারেন না কারণ তিনি ঈশ্বর হয়ে অনেক গিয়ে দূরে চলে গেছেন মাটির পৃথিবী থেকে। কোনো এক নতুন সকালে একবুক শ্বাস নিয়ে সেই ছেলেটা আবার দৌড় শুরু করুক ঐ ছোট্ট সবুজ ঘাসের মাঠটা থেকে। হাজার হাজার আলোরছটায় আবার ঢেকে যাক ফুটবল বিশ্ব। ঈশ্বরের শ্লোকমন্ত্রে আমরা চেঁচিয়ে উঠি সেই চারটে ম্যাজিকাল অক্ষরে- ‘ম্যা রা ডো না!’

তবে, এই সবই এখন অতীত। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দ্য গ্রেট ম্যারাডোনা চলে গেলেন সব কিছুর উর্ধ্বে, চলে গেলেন জীবন নদীর ওপারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link