হাঁটি হাঁটি পা করে টেস্ট ক্রিকেটের আঙিনায় ১৩ বছর কাটিয়ে দিলেও বাংলাদেশের সাফল্য খুব বেশি নেই। দর্শকেরা তাই আনন্দ খুঁজে নেন ধুমধাড়াক্কা টি-টোয়েন্টিতে। কিন্তু কিছু মুহূর্ত আসে যখন পুরো জাতি একত্রিত হয়, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে।
সময় ২০১৩ সালের অক্টোবর মাস, সমুদ্রপাড়ের চট্টগ্রামে শীত আসি আসি করছে। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে স্বাগতিকদের মুখোমুখি নিউজিল্যান্ড। সেদিন যেন পুরো জাতির চোখ নিবদ্ধ হয়েছিল একটি জায়গায়, ঘড়ির কাঁটা থমকে গিয়েছিল। পারবেন কি তিনি?
নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৫তম ওভার। দ্বিতীয় বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরে যান কোরে অ্যান্ডারসন, পরের বলে বিদায়ঘণ্টা বাজে ওয়াটলিংয়েরও। অলক কাপালির পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে হ্যাটট্রিকের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি। আচ্ছা সমাপ্তিটা কি মধুর হবে? ডগ ব্রেসওয়েলের ব্যাটের কানায় লেগে মুশফিকের প্যাড ছুঁয়ে বল গিয়ে পড়তে লাগলো ফার্স্ট স্লিপে থাকা নাসিরের সামনে।
তবে কি আবারো হতাশা? সাকিব আল হাসান সেটা হতে দিলেন না, লেগস্লিপ থেকে দারুণ ডাইভ দিয়ে লুফে নিলেন ক্যাচটি। হ্যাটট্রিক! সোহাগ গাজীর হ্যাটট্রিক – ১৪৫ বছরের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এক ম্যাচে সেঞ্চুরি এবং হ্যাটট্রিকের ঘটনা এই একটাই।
দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পটুয়াখালী। সমুদ্রতীরের অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবটা এ অঞ্চলের মানুষের উপর দিয়েই বেশি যায়। সিডর, আইলা, নার্গিস বারবার ক্ষতবিক্ষত করেছে এ অঞ্চলের মানুষদের। সমুদ্রতীরের এ অঞ্চলেই বেড়ে উঠা সোহাগ গাজীর।
বন্ধুদের সাথে খেলতে খেলতেই একসময় বুঝতে পারলেন তার নিয়তি খেলাতেই। কিন্তু পেশাদার ক্রিকেটের আঙিনায় পা দিয়েই বুঝতে পারলেন কতটা কঠিন হতে পারে এ যাত্রা। বয়সভিত্তিক কোনো জাতীয় দলেই খেলেননি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করার সুবাদে ডাক পেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে।
বোলার হিসেবে সবচেয়ে খারাপ শুরু কি হতে পারে? নিশ্চয়ই বিশাল ছক্কা হজম করা। সোহাগের আগে সর্বশেষ ১৯০৯ সালে সর্বপ্রথম কোনো অফস্পিনার টেস্ট ক্রিকেটে বোলিং উদ্বোধন করেছিলেন। বল করার আগেই ইতিহাসের পাতায় সোহাগ, রোমাঞ্চিত বোধ করাই ছিল স্বাভাবিক। ধুকপুকানি বেড়েও গিয়েছিল সোহাগের।
প্রথম বলেই বিশাল এক ছক্কা মেরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাকে স্বাগতম জানালেন ক্রিস গেইল। সোহাগের জায়গায় আপনি কিংবা আমি হলে হয়তো বলতাম ছেঁড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। প্রথম ওভারেই হজম করলেন ১৯ রান, ততক্ষণে পরিসংখ্যানের পাতা উল্টানো শুরু হয়ে গেছে।
কিন্তু, সোহাগ অন্য ধাঁচে গড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করতে করতে তিনি জানেন কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। গেইলকে আউট করলেন কয়েক ওভার পরেই, শুধু তাই নয় গেইলকে বানিয়েছিলেন নিজের ‘বানি’। টেস্ট-ওডিয়াই কিংবা বিপিএল সবখানেই একই প্রশ্ন সোহাগ গাজীকে কতটা ভয় পান গেইল?
টেস্টের পর ওডিয়াইতেও কি দুর্দান্ত শুরু! ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে খুলনায় ২৯ রানে নিয়েছিলেন চার উইকেট। অভিষেকে কোনো অফস্পিনারের জন্য এটাই সেরা বোলিং। অবধারিতভাবেই ম্যাচ সেরার পুরস্কার ওঠে তাঁর হাতেই। ‘সকালের সূর্য নাকি দিনের পূর্বাভাস দেয়’ অন্তত সোহাগের ক্ষেত্রে এ কথাটা সত্য। সোহাগে বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখেছিল সাকিবের যোগ্য সঙ্গীর, দেশকে সামনে এগিয়ে নেবার স্বপ্ন সারথি।
মধুচন্দ্রিমা কেটে যেতে সময় লাগলো না। ২০১৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বোলিং অ্যাকশনে ক্রুটি ধরা পড়ে সোহাগের। দুবার পরীক্ষা দিয়ে উতরালেন সে বাঁধা। কিন্তু আগের ধার ফিরে পেলেন না। নখদন্তহীন বোলিং দিয়ে যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা যায় না।
ফিটনেস নিয়ে উদাসীনতা, অনুশীলনে অমনোযোগী, কোচ রুয়ান কালপাগের সাথে ঝামেলা এসব কথা যখন কানে এসে পৌঁছায় তখন হতাশা ব্যক্ত করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। বছর ঘুরে ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্টই হয়ে আছে তার খেলাব শেষ টেস্ট হিসেবে। ১০ টেস্ট আর ২০ টু একদিনের ম্যাচেই থমকে গেছে সোহাগের ক্যারিয়ার।
নাইম হাসান, মেহেদী মিরাজ, তাইজুল ইসলামদের আগমনে জাতীয় দলের দরজা একপ্রকার বন্ধই হয়ে আছে সোহাগের জন্য। বাংলাদেশ জাতীয় দলের জন্য সোহাগ তাই হয়ে আছেন এক হতাশার নাম। সোহাগের সামনে সুযোগ ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র হবার কিন্তু তিনি হারিয়ে গেলেন উল্কাপিণ্ড হয়ে।