ভরসার কাঁধ, এক জোড়া শক্ত হাত

ত্রিকালদর্শী এক ক্রিকেটার তিনি। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় তখন জিম্বাবুয়ে পার করছে ইতিহাসের সেরা সময়। সিনিয়র হিসেবে পেয়েছিলেন ফ্লাওয়ার ব্রাদার্স, অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল, হেনরি ওলোঙ্গা, নিল জনসন, হিথ স্ট্রিকদের মতো ক্রিকেটারদের।

এরপর মাঝ বয়সে এসে একাই টেনেছেন মৃতপ্রায় জিম্বাবুয়ে দলকে। সেই যাত্রায় একে একে হারিয়েছেন টাটেন্ডা টাইবু, ডিওন জনসন, ব্রেন্ডন টেইলর, কাইল জার্ভিসদের। শেষ বেলায় ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে গেয়েছেন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখার গান। মুজারাবানি, ভুসি সিবান্দা, ওয়ালারদের আগলে রেখেছিলেন মাথার উপর ছায়া হয়ে। তিনি জিম্বাবুয়ের সাবেক অধিনায়ক হ্যামিল্টন মাসাকাদজা।

১৯৮৩ সালে হারারেতে জন্মগ্রহণ করেন মাসাকাদজা। সেই সময়ে জিম্বাবুয়েতে কেবল শ্বেতাঙ্গরাই ক্রিকেট খেলতেন। দারিদ্র‍্যতার সাথে লড়াই করে জীবিকা নির্বাহ করা কৃষ্ণাঙ্গদের ক্রিকেট নামক বিলাসিতার সুযোগ কই? কিন্তু মাসাকাদজা ঠিকই প্রেমে পড়লেন ক্রিকেটের। কেবল তাই নয়, তার ছোট দুই ভাই ওয়েলিংটন এবং সিঙ্গিরাই মাসাকাদজাও পরে বড় ভাইয়ের পথ অনুসরণ করে খেলেছেন জাতীয় দলে।

তবে অন্যসব কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের তুলনায় মাদাকাদজাকে ভাগ্যবান বলা যায়। তার বাবা-মা ক্রিকেট কি, না বুঝতে পারলেও শত দারিদ্র‍্যতার মাঝে ছেলেকে ভর্তি করে দেন ক্রিকেট একাডেমিতে। ক্যারিয়ারের শুরুতেই অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের মতো কিংবদন্তিকে পরামর্শক হিসেবে পেয়ে যান মাসাকাদজা।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তাঁর। অভিষেকেই সেঞ্চুরি করে হইচই ফেলে দেন তিনি। জিম্বাবুয়ের কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারের সেটাই ছিল প্রথম সেঞ্চুরি।

সময়ের ধারাবাহিকতায় জাতীয় দলেও জায়গা করে নেন দ্রুতই। প্রথম ম্যাচেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলেন ১১৯ রানের দারুণ এক ইনিংস। পরের টেস্টেই করেন ৮৫ রান। সুযোগ বুঝে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হয়ে যায় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অভিষেকও।

কিন্তু সুসময় বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের ভবিষ্যত তখন হুমকির মুখে। পরিবারের চাপে তাই সাময়িকভাবে ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে মাসাকাদজা চললেন দক্ষিণ আফ্রিকা অভিমুখে, মার্কেটিংয়ের উপর পড়াশোনা শেষ করতে। তার তিন বছরের এই বিরতিতে বদলে গেল জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের গতিপথ।

তিন বছর পর মাসাকাদজা যখন ফিরলেন জিম্বাবুয়ের সেই দলটার কেউই তখন খেলছেন না। মুগাবে সরকারের নীতির বিরোধিতা করায় ক্রিকেট থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে তাঁদের। মাসাকাদজা, তরুণ টাটেন্ডা টাইবু এবং ডিওন ইব্রাহিমকে সাথে নিয়ে দলের হাল ধরলেন।

বছর খানেকের মাঝে দলটাকে প্রায় গুছিয়েও এনেছিলেন। কিন্তু বেতন নিয়ে বোর্ডের সাথে ঝামেলায় ২০০৫ সালে দেশ ছাড়েন টাইবু, ইব্রাহিম, হিথ স্ট্রিকরা। আবারো একা হয়ে পড়েন মাসাকাদজা। পাশাপাশি মাঠের বাইরের নানা কর্মকান্ডের কারণে নিজেও ভুগছিলেন ফর্মহীনতায়। জায়গা পাননি ২০০৭ এবং ২০১১ বিশ্বকাপের দলে।

অবশেষে ২০১৫ বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন পূরণ হয় মাসাকাদজার। খেলার সুযোগ পেতে পারতেন ২০১৯ বিশ্বকাপেও। কিন্তু রশিদ খান-নবীদের আফগানিস্তানের সাথে পেরে ওঠেনি ক্ষয়িষ্ণু জিম্বাবুয়ে। দুই দফায় জিম্বাবুয়ের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। চেয়েছিলেন অধিনায়ক হিসেবে ২০২০ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলে অবসর নিতে।

কিন্তু, দেশের ক্রিকেট বোর্ডে ক্ষমতাসীন সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে আইসিসি ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করে জিম্বাবুয়েকে। এদিকে বয়সটাও থেমে থাকছিল না, সব মিলিয়ে তাই বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই ক্যারিয়ারের ইতি টানেন মাসাকাদজা। পরে জিম্বাবুয়ে অবশ্য ফিরে আসে, তবে মাসাকাদজা ফেরেননি মাঠে। তবে, তিনি দলের প্রশাসনিক দায়িত্বেই আছেন।

প্রায় দুই দশকে ৩৮ টেস্ট খেলে পাঁচটি সেঞ্চুরি এবং আটটি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন ২,২২৩ রান। পাশাপাশি সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ২০৯ ম্যাচে তার সংগ্রহ ৫,৬৫৮ রান। ক্যারিয়ারের শেষ দিন অবধি ছিলেন দলের ব্যাটিংয়ের মূল ভরসা, সবচেয়ে বড় নাম।

হ্যামিল্টন মাসাকাদজার ক্যারিয়ার রেকর্ড হয়তো আহামরি নয়। ক্রিকেট ইতিহাসের সেরাদের তালিকায় হয়তো তার নাম থাকবে না। খোদ জিম্বাবুয়ের সেরা ব্যাটসম্যানও বোধহয় তাকে বলবেন না কেউ। কিন্তু যদি জিম্বাবুয়ের সবচেয়ে সংগ্রামী ক্রিকেটারের কথা বলা হয়, যার কাঁধে ভরসা পেয়েছে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট সেক্ষেত্রে প্রথম নামটাই হবে হ্যামিল্টন মাসাকাদজা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link