চিত্তাকর্ষক অতন্দ্র প্রহরী

১৯৪৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। ইংল্যান্ডের লিস্টারে জন্ম হল পিটার শিলটনের। সেদিন তাঁর পরিবারের কেউ বা তার জন্মদাতা বাবা-মা কি আঁচ করতে পেরেছিলেন যে তারা জন্ম দিলেন বিশ্ব ফুটবলে প্রবাদপ্রতিম এক গোলরক্ষকের? যার খ্যাতি শুধু ক্লাব ফুটবলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে বিশ্ব ফুটবলে। সম্ভবত না।

ঘরের শহর লিস্টারের ক্লাবেই ১৯৬৫-’৬৬ সালের মে মাসে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁর ফুটবল জীবনের শুরু হয়। প্রতিপক্ষ ছিল এভারটন। শিলটনের মধ্যে অল্প বয়সেই অপার সম্ভাবনা দেখেছিলেন লিস্টার ক্লাবের কর্তৃপক্ষ। ইংরাজিতে একটা প্রবাদ আছে ‘Morning shows the day’. কথাটা শিলটনের জন্যে একশো ভাগ প্রযোজ্য। ফুটবল জীবনে শুরু থেকেই ঘরের ক্লাব লিস্টার সিটিতেই ক্লাব ফুটবল জীবনের দশটা বছর খেলেছেন।

এই দশ বছরে গোলরক্ষক হিসেবে খেলেছেন ২৮৬ টি ম্যাচ। সময় বদলায়, পরিবর্তন পৃথিবীর নিয়ম। সেই নিয়মেই শিলটন ক্লাব বদলেছেন। এরপর অবশ্য তিনি খেলেছেন স্টোক সিটি, নটিংহ্যাম ফরেস্ট, সাদাম্পটন, লেটন ওরিয়েন্টের মত ক্লাবে তৃতীয় ডিভিশনে। দীর্ঘ ফুটবল জীবনে প্রথম ডিভিশন, তৃতীয় ডিভিশন এবং প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন মোট ১০০৫ টি ম্যাচ। যা নি:সন্দেহে একটি রেকর্ড।

শিলটনের শৈশবের হিরো ছিলেন গর্ডন ব্যাঙ্কস। ইংল্যান্ডের আরেক স্বনামধন্য গোলরক্ষক। শিলটনের বেড়ে ওঠা যেহেতু লিস্টারে, তাই তার সৌভাগ্য হতো ফিলবার্ট স্ট্রিটে গর্ডনের মতো এমন বড় মাপের গোলকিপারেরর ট্রেনিং দেখার। শিলটনের শৈশবের নায়ক গর্ডন ক্লাব ছেড়ে দেবার পর শিলটনকে লিস্টার সিটিতে পাঠান। তখন শিলটনের বয়স মাত্র ১৫।

এর পরের বছরই তাঁর অভিষেক ঘটে। চলতি মৌসুমে লিস্টার খেলার সুযোগ পায় প্রথম ডিভিশনে। যদিও অন্য ক্লাবের সঙ্গে লড়াইটা খুব কঠিন ছিল। দেখতে দেখতে শিলটন ১৯৭২ সালে ইংল্যান্ডের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপে যোগ্যতা নির্ণয় খেলায় নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠত করে তুললেন। এর নেপথ্যে অবশ্য তার সেই শৈশবের নায়ক গর্ডন ব্যাঙ্কসের ভূমিকা ছিল।

১৯৭৪ সালের নভেম্বরে শিলটন যোগ দিলেন স্টোক সিটিতে। রেকর্ড অর্থমূল্যের বিনিময়ে ঘটেছিল সেই ক্লাব ট্রান্সফার। সেই সাড়া জাগানো ট্রান্সফার ফির মূল্য ছিল ৩২৫,০০০ পাউন্ড এবং স্টোক সিটি তাকে সেই মৌসুমে আটচল্লিশটি ম্যাচে খেলিয়েছিল। সেই সময় আরেক প্রতিদ্বন্দী ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাঁকে তাঁদের ক্লাবে খেলার জন্য প্রলুব্ধ করে। কিন্তু শিলটনের তৎকালীন সাপ্তাহিক বেতন তারা মেটাতে না পারায় শিলটন স্টোক সিটিতেই রয়ে গেলেন।

শিলটন নটিংহ্যাম ফরেস্টে যোগ দেন সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭ সালে। সেই ট্রান্সফারের নগদমূল্য ছিল ২৫০,০০০ পাউন্ড। সেবার নটিংহ্যাম ফরেস্ট লিগ কাপ জিতেছিল ব্রায়ান ক্লফের তত্ত্বাবধানে। ক্লাবের এমন তাক লাগানো পারফরমেন্সে ব্রিটিশ ক্লাব ফুটবল সরগরম হয়ে উঠেছিল। নটিংহ্যাম ফরেস্টে প্রথম মরশুমে শিলটন সাইত্রিশটি লিগ ম্যাচে মাত্র আঠারটি গোল হজম করেন।

তাঁর এই কৃতিত্বের জন্যে শিলটন পি.এফ.এ প্লেয়ার’স প্লেয়ার অফ্‌ দ্য ইয়ার পুরষ্কারে ভূষিত হন। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপে ইংল্যান্ড যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হল। দল ব্যাঙ্কের বিকল্প খোঁজার কথা ভাবছিল। গাড়ি দূর্ঘটনায় খেলা থেকে অবসর নিলেন ব্যাঙ্কস। তখন স্বাভাবিক নিয়মেই যোগ্যতম বিকল্প হিসেবে পিটার শিলটনের নাম উঠে আসে সবার আগে।

শুধু ক্লাব ফুটবলেই নয়, আন্তর্জাতিক ফুটবলেও শিলটন ছিলেন সপ্রতিভ গোলরক্ষক। ১৯৮৯ সালের জুন মাসে কোপেনহেগেনে শিলটন ফ্রেন্ডলি ম্যাচে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে নামেন এবং তার দেশের অধিনায়ক ববি মুরের দেশের হয়ে একশো আটটি ম্যাচ খেলার রেকর্ডটি ভাঙেন। সেই খেলায় তার গায়ে ওঠে ১০৯ নম্বর জার্সি। ১৯৮২ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার সুযোগ পায়।

সেই সুবাদ শিলটন তার বিশ্বকাপে অভিষেক ম্যাচ খেলেন বত্রিশ বছর বয়সে। তার সতীর্থ ক্লিমেন্স ফ্রেন্ডলি ম্যাচে খেললেও শিলটন গোলকিপার হিসেবে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সেই খেলায় ইল্যান্ড জেতে ৩-১ গোলের ব্যবধানে। সেই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড এগিয়ে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডে।

পরের বিশ্বকাপে ১৯৮৬ সালে মেক্সিকোয় কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে খেলায় ঘটে যায় ‘হ্যান্ড অব গড’ এবং ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ মতো দু’টি ঐতিহাসিক গোল। সেই দু’টি গোলেরই মালিক ডিয়েগো ম্যারাডোনা। প্রথম গোলটি ইতিহাস খ্যাত এবং বিতর্কিত। শিলটনের স্মৃতিচারণায় তিনি বলেন, ‘আমি গোলপোস্ট থেকে এগিয়ে এসে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম কিন্তু সাধারণত আমি যতটা লাফাতে পারি সেদিন লাফিয়ে ম্যারাডোনার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারিনি। মারাদোনা ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছিল বলেই বল পাঞ্চ করেছিল।’

দ্বিতীয় গোলটি ম্যারাডোনার একক প্রচেষ্টা। আটষট্টি মিটার লম্বা দৌড়ে বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের নাস্তানাবুদ করে মারাদোনা এগিয়ে আসছিলেন শিলটনের দিকে। শিলটন গোলপোস্ট থেকে সাত মিটার এগিয়ে ছিলেন। শেষমেশ ম্যারাডোনা পায়ের গতি এবং পায়ের জাদুতে তাকে বোকা বানিয়ে বল ঠেলে দেন ফাঁকা গোলের দিকে।

এরপরের ইতালির বিশ্বকাপ অর্থাৎ ১৯৯০ সালে সেমিফাইনালে পেনাল্টিতে পশ্চিম জার্মানির কছে হেরে যায় শিলটনের ইংল্যান্ড। তৃতীয় স্থান নির্ধারণের খেলাতেও ইংল্যান্ড ইতালির কাছে ২-১ গোলে ফের হেরে যায়। শিলটনের ভালো সময় বোধ হয় শেষ হয়ে এসেছিল। তার নিজের ভুলে ইতালির ব্যাজ্জিওর সেই গোলটি তার ফুটবল জীবনের একটি অস্বস্তিকর মুহূর্ত। সেই ম্যাচটিই ছিল তার একশো পঁচিশতম ম্যাচ।

এই বিশ্বকাপের পরেই তিনি আন্তর্জাতিক খেলা থেকে অবসর নেন। যদিও তখনও তিনি ক্লাব ফুটবল থেকে বিদায় নেননি। বয়সের ভার ক্লান্তি সমস্ত কিছুকে অগ্রাহ্য করে এক হাজার ম্যাচের লক্ষ্যে নাগাড়ে খেলে চলেছেন। সাতচল্লিশ বছর বয়সে তিনি তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গেলেন।

শিলটন ওরিয়েন্ট ক্লাবের হয়ে ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে ব্রাইটনের বিরুদ্ধে বিদায়ী ম্যাচটি খেলে দীর্ঘ ফুটবল জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। গোলপোস্টে তিনি ছিলেন অতন্দ্র প্রহরী। বিশ্বকাপ ফুটবলে টানা দশটি ম্যাচে কোনও গোল না-খাওয়ায় গোলরক্ষকের হিসেবে গিনিস বুকে আজও উজ্জ্বল তার নাম। শিলটন ছাড়া আর একজন গোলরক্ষকের অবশ্য এই রেকর্ড আছে। ফ্রান্সের গোলরক্ষক ফাবিয়ান বার্থেজের।

ফুটবল বিশেজ্ঞদের মতে পিটার শিলটন তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক। শুধু তাই নয়, তার সমসময়ের তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ একজন শর্ট-স্টপার এবং ইংল্যান্ডের একজন অন্যতম সেরা গোলরক্ষক। কোনও কোনও সংবাদ মাধ্যম শিলটনকে সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক বলেও মনে করেন। গোলকিপার শিলটন শুধু যে ছিলেন দক্ষ তাই নয়, তাঁর বুদ্ধিমত্তা, মনোসংযোগ, পজিশানিং বোধ এবং ধারাবাহিকতাও ছিল ব্যাতিক্রমী।

বিপক্ষের খেলোয়াড়ের শর্ট মুহূর্তে থেমে যেত শিলটনের গ্লাভসে। ক্ষিপ্রতা, রিফ্লেক্স এবং দলের অন্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে বোঝাপড়াতেও তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। একজন সফল এবং শ্রেষ্ঠ গোলকিপারের প্রয়োজনীয় যাবতীয় গুণাবলী ছিল শিলটনের মধ্যে। তবে শেষ দিকে তার গতি এবং ক্ষিপ্রতায় ভাটা পড়ে।

সেই সময়ের ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমের সমালোচনার মুখে পড়েতে হয় শিলটনকে। ছ’ফিট লম্বা শিলটনের শারিরীক উচ্চতার জন্য পেনাল্টি বাঁচাতে তিনি বারবার ব্যর্থ হতেন এমন কথা শোনা যায়। পশ্চিম জার্মানির কাছে ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে পেনাল্টি শুট-আউটে ইংল্যান্ড হেরে যাবার পর ফের এই গুঞ্জন ওঠে। তবে একথা সত্যি শিলটনের আন্তর্জাতিক খেলার জীবনের দিকে তাকেলে দেখা যায় পেনাল্টি বাঁচানোর রেকর্ড তাঁর মোটেই চিত্তাকর্ষক নয়।

লেখক পরিচিতি

পেশায় ফিজিও, নেশায় একজন লেখক। লেখালেখির ভাষাগত মাধ্যম বাংলা। মূলত কবিতা, গদ্য এবং ছোটো গল্প নিয়ে লেখালেখির চর্চা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link