খেমরাজ ‘কাউফ্লাই’ চন্দরপলের মেজাজটা আজ বিগড়ে আছে। সে একজন জেলে পাশাপাশি প্রতিভাবান ক্রিকেটারও। মাহাইকা নদী যেখানে আটলান্টিকের সাথে মিশেছে, তার ঠিক কাছেই দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর উপকূলে তার বসবাস। তবে আজকে খেমরাজের মাছ ধরা নিয়ে রাগ নয়, রাগটা হচ্ছে স্থানীয় ক্রিকেট দলে তার সতীর্থদের নিয়ে। রাগের কারণটাও বেশ যৌক্তিক, তারা কেউই রান করতে পারছে না। সব মিলিয়ে সে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে।
কি ছিল সেই সিদ্ধান্ত?
তাঁর নিজের ছেলেকেই ক্রিকেট শেখাবে। ভদ্র, সুবোধ, শান্ত ছেলে। গায়ানার স্থানীয় এলাকার সবাই তাকে খুব ভালোবাসে নম্র আচরণের জন্য। কিন্তু চাইলেই তো আর ক্রিকেটে হাতেখড়ি দেয়া যায় না, তার জন্য প্রয়োজন ব্যাট-বল, গার্ড, হেলমেট।
এদিকে বিশ্বজুড়ে মন্দার কারণে গায়ানাতে আর্থিক দুরবস্থা তখন চরমে। ভেবে এক উপায় বের করলেন, ক্যারিবিয়ান উপকূলকে সারি বেঁধে পাহারা দেয়া নারকেল গাছ থেকেই বানালেন সব সরঞ্জাম। নিজেই প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন ছেলেকে। কিন্তু তখন কি জানতেন ভিভ রিচার্ডস, ব্রায়ান লারাদের বিদায়ের ক্যারিবিয়ানের পতাকা সমুন্নত রাখার ভার বইবে তার ছোট্ট ছেলেটা। খেমরাজের সুবোধ সেই ছেলেটার নাম ছিল শিবনারাইন চন্দরপল।
অদ্ভুতুড়ে ব্যাটিং স্ট্যান্ট, চোখের নিচে কালো দাগ নিয়ে ক্রিজে এসে বেল ঠুকে ব্যাটিং শুরু করাটাকে রীতিমত এক কিংবদন্তিতে পরিনত করেছিলেন তিনি। কখনো আলোচনার শীর্ষে থাকতেন না, ক্যারিয়ারের শুরুতে ছিলেন ব্রায়ান লারার ছায়ায় । পরে পাগলাটে সারওয়ান কিংবা আমুদে ব্রাভোদের ভিড়ে নীরবেই নিজের কাজটা করে যেতেন তিনি। টেস্ট ইতিহাসের সপ্তম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তো আর এমনি এমনি হননি।
ছোটবেলা থেকেই আলভিন কালিচরনের ধীরস্থির ব্যাটিংয়ের ভক্ত ছিলেন তিনি। আক্রমণাত্মক ভিভ রিচার্ডসের চাইতে কালিচরণের নীরব উপস্থিতিই বেশি টানত তাঁকে। নিজের ক্যারিয়ার জুড়েই তাই লালন করে গিয়েছেন তার আদর্শ। ১৯৯১-৯২ মৌসুমে গায়ানার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক চন্দরপলের। সে ম্যাচেই ৯০ রান করে জানান দেন ক্যারিবিয়রা পাচ্ছে নতুন এক তারকা।
তখন অবশ্য স্বাভাবিক স্টাইলেই ব্যাটিং করতেন তিনি। দুই বছর পরেই রিচি রিচার্ডসনের দলের হয়ে ডাক পান চন্দরপল। প্রথম শ্রেণির মত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও অভিষেকে আলো ছড়ান তিনি, ইংলিশদের বিপক্ষে করেন ৬২ রান। পরের ম্যাচেই ক্ল্যাসিক চন্দরপলের দেখা পায় পুরো বিশ্ব, ১৩৪ রানে সাত উইকেট হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন ধুঁকছে।
প্রথমে কার্টলি অ্যামব্রোসের সাথে ৭৩ এবং পরে কেনি বেঞ্জামিনের সাথে মিলে যোগ করেন ৭১ রান, দল পায় লড়াই করার মত সংগ্রহ। তিনি অপরাজিত থাকেন ২৩১ বলে ৭৭ রানের এক দারুন এক ইনিংস খেলে। তখন কি তিনি জানতেন পরের দুই যুগও দলের টেলএন্ডারদের নিয়ে এভাবেই বোঝা বইতে হবে?
পরের ম্যাচেই গ্যারি সোবার্সের ৩৬৫ রানের ম্যাচে ৭৫ রান করে অপরাজিত থাকেন চন্দরপল। নিজের প্রথম সিরিজে চার ফিফটিতে তার সংগ্রহ ছিল ২৮৮ রান। পরের মাসেই দেখা পান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের একমাত্র ত্রিশতকের। এতকিছু করার পরেও ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দলে জায়গা পাকা ছিল না তার। অবশেষে গ্যাবায় ম্যাকগ্রা, ওয়ার্ন, গিলেস্পিদের বিপক্ষে ৮২ রান করার পর দলে নিজের জায়গা মোটামুটি স্থায়ী করেন চন্দরপল।
কিন্তু, ১৩ ফিফটি করে ফেললেও ক্যারিয়ারের প্রথম শতকের দেখা পেতে বিলম্ব হচ্ছিল তার। ভারতের বিপক্ষে ব্যাটিং এ প্রমোশন পেয়ে উঠে আসেন তিন নম্বরে। আর তাতেই বাজিমাত, ১৩৭ রানের দারুন এক ইনিংস খেলেন তিনি। তার ব্যাটে ভর করেই ৩৭ রানে ম্যাচ জিতে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
টেস্টের পাশাপাশি একদিনের ক্রিকেটেও দারুণ সফল তিনি। একদিনের ক্রিকেটেও রান করেছেন চল্লিশোর্ধ গড়ে। লারার অবসরের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং পুরোটাই তার উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। কচ্ছপ গতির ব্যাটিং এর জন্য বিখ্যাত থাকলেও দলের প্রয়োজনে যে তিনি হাত খুলে খেলতে পারেন সে নির্দশনও দেখিয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একবার শেষ বলে ছক্কা মেরে দলকে জেতান তিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একবার ৬৯ বলে সেঞ্চুরি করার রেকর্ডও আছে তার। ২০১২ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলেন ২০৩ রানের চোখ জুড়ানো এক ইনিংস।
১৬৪ টেস্ট খেলে ৩০ শতক এবং ৯৬ অর্ধ-শতকে ৫১.৯৬ গড়ে ১০,৮৬৭ রান করেন তিনি। অথচ ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় তাকে ব্যাট করতে হয়েছে লোয়ার অর্ডারদের সাথে, ছয় কিংবা সাত নম্বরে। অথচ দশ হাজারি ক্লাবের বাকি ব্যাটসম্যানরা খেলতেন টপ অর্ডারে, ফলে তাদের রান করার সুযোগও ছিল বেশি। এছাড়া তাঁরা সবাই দলের বাকিদের কাছে থেকে সহায়তা পেতেন। কিন্তু চন্দপলকে সহায়তা করার মত কেউ ছিলেন না, বেশিরভাগ ম্যাচেই দেখা যেত সেঞ্চুরি কিংবা ডাবল সেঞ্চুরির খুব কাছে গিয়ে অপরাজিত রয়েছেন তিনি।
দলকে দুই যুগ সার্ভিস দেবার পর চন্দরপলের বিদায়টা ছিল অপমানজনক। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড একপ্রকার পত্রপাঠ করে বিদায় দেয় তাকে। মাঠ থেকে অবসর নেবার ন্যূনতম সম্মানটুকু পাননি তিনি। অথচ এরকম বিদায় তার প্রাপ্য ছিল না। কিন্তু চন্দরপলরা এসব মনে রাখেন না।
সাধারণ মানুষের মত রাগ-ক্ষোভ, হতাশা, আক্ষেপ থাকলে তারা আর অসাধারণ হয়ে উঠলেন কোথায়। চন্দরপলও তাই মনে রাখননি, আক্ষেপ ভুলে নিজের ছেলেকেও বানিয়েছেন ক্রিকেটার। ছেলে ত্যাগনারায়ণের সাথে খেলেই তাই সবার চোখের আড়ালে থেকে বিদায় জানিয়েছেন ক্রিকেটকে।