লঙ্কান ব্যাটিংয়ের নম্রতা/নির্মমতা

বিংশ শতাব্দীর আশির দশক। বিশ্বরাজনীতির উত্তাল সময়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল। তামিল টাইগাররা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য প্রতিনিয়ত হামলা চালাচ্ছে দক্ষিণ ভারতে। যার কিছুটা প্রভাব এসে পড়েছে লঙ্কাপুরিতেও। ক্রিকেটেও যাচ্ছে পালাবদলের সময়।

বিংশ শতাব্দীর আশির দশক। বিশ্বরাজনীতির উত্তাল সময়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল। তামিল টাইগাররা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য প্রতিনিয়ত হামলা চালাচ্ছে দক্ষিণ ভারতে। যার কিছুটা প্রভাব এসে পড়েছে লঙ্কাপুরিতেও। ক্রিকেটেও যাচ্ছে পালাবদলের সময়।

বনেদী ইংরেজ কিংবা অভিজাত ক্যারিবীয় হতে বাটনটা ধীরে ধীরে ফিরছে উপমহাদেশে। সুনীল গাভাস্কার-কপিল দেবরা বিশ্বকাপ জেতালেন ভারতকে। শ্রীলঙ্কাতেও লাগলো ক্রিকেটের সুবাতাস। ভারত মহাসাগরের তীরে বিস্তীর্ণ নারকেলগাছ দিয়ে ঘেরা মাঠগুলো মুখরিত হয়ে উঠলো ব্যাট-বল হাতে কিশোরদের পদধূলিতে।

রয় ডায়াস, আসান্থা ডি মেল, দুলীপ মেন্ডিসদের পথ ধরে উঠে আসলেন অরবিন্দ ডি সিলভা, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, হাসান তিলকারত্নে, রোশন মহানামা, রুমেশ রত্নায়েকের মতো ব্যাটসম্যানরা। তাদের ব্যাটের আওয়াজে উল্লাসে ফেটে পড়ে লঙ্কাবাসী। তাদের ধ্রুপদী ব্যাটিংয়ের মাঝে আড়ালেই থেকে যান আরেকজন, তিনি আসাঙ্কা গুরুসিনহা। শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম রূপকার।

মাত্র সাত বছর বয়সে ক্রিকেট জীবন শুরু করেন আসাঙ্কা প্রদীপ গুরুসিনহা। দশ বয়সেই স্কুল ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করেই জানান দেন নিজের আবির্ভাবের। সে ম্যাচে বন্ধু হাসান তিলকরত্নের সাথে গড়েন ২২২ রানের জুটি, সেই শুরু। দুজনের বন্ধুত্বটা চল্লিশ বছর পরও আজও অমলিন। শুরুতে ইশিপাথানা কলেজে ভর্তি হলেও পরে শ্রীলংকার ক্রিকেটার কারখানা নালন্দা কলেজে চলে যান। সেখানে নেলসন মেন্ডিসের ছায়াতলে আস্তে আস্তে বড় হতে শুরু করেন লংকান ক্রিকেটের সুপ্ত এ স্ফুলিঙ্গ।

করাচিতে উইকেটরক্ষক অমল সিলভা ইনজুরিতে পড়লে তার বদলে উইকেটরক্ষক হিসেবে অভিষেক ঘটে গুরুসিনহার। যদিও অভিষেকে আলো ছড়াতে পারেননি, আউট হয়ে যান ১৭ এবং ১২ রান করেই। একদিনের ক্রিকেটে শুরুটা হয়েছিল আরও বাজে, কোনো বল খেলার আগেই রানআউট হয়ে সাজঘরে ফেরত যান।

কিন্তু, গুরুসিনহা নিজেকে সামলে নেন দ্রুতই। ওয়াসিম আকরাম, আব্দুল কাদির, ইমরান খান, তৌসিফ আহমেদদের সামলে ১১৬ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলে বনে যান শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান।

গুরুসিনহার ব্যাটিং দেখতে তেমন সুখকর ছিল না। ডি সিলভা কিংবা রানাতুঙ্গার মতো গ্ল্যামার তার ব্যাটে ছিল না। কিন্তু ক্রিকেট মাঠে তিনি ছিলেন দৃঢ়তার প্রতীক, ফুটওয়ার্ক ছিল অসাধারণ। পেস-স্পিন দুটোর বিপক্ষেই সাবলীল, উইকেটে পড়ে থাকতেন সেশনের পর সেশন। এমন নয় যে তিনি শট খেলতে পারতেন না। নিজের দিনে তিনি ছিলেন বিশ্বের অন্যতম বিধ্বংসী এক ব্যাটসম্যান।

রানাতুঙ্গা পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন গুরুসিনহার মতো বলকে পেটাতে তিনি আর কাউকে দেখেননি। পাশাপাশি তার ডান-হাতি মিডিয়াম পেস বোলিং ছিল দারুণ কার্যকরী। মাঝের ওভারগুলোতে দল যখন একটা উইকেটের জন্য হাপিত্যেশ করছে, তখন পরম আরাধ্য সেই উইকেট এনে দিতে তার জুড়ি মেলা ভার। এছাড়া উইকেটকিপার কিংবা ফিল্ডার হিসেবেও তিনি ছিলেন দুর্দান্ত।

১৯৯০ সালে চন্ডিগড়ে ভারতের বিপক্ষে দলকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচান গুরুসিনহা। সেদিন ভেঙ্কটপতি রাজুর বোলিংয়ের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি লঙ্কানরা, অলআউট হয় মাত্র ৮২ রানে। একপ্রান্ত আগলে ৫২ রানে অপরাজিত ছিলেন গুরুসিনহা।

সেদিন তিনি রুখে না দাঁড়ালে হয়তো ইতিহাসের সর্বনিম্ন রানের লজ্জায় পড়তে হতো লংকানদের। সেদিন পাঁচজন আউট হন রানের খাতা খোলার আগেই, এক সামারাসাকিরা বাদে দুই অংকের ঘরে পৌঁছাতে পারেননি কেউই। পরের বছরই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করে দুলীপ মেন্ডিসের পাশে নিজের নাম খোদাই করেন তিনি।

১৯৯৬ বিশ্বকাপজয়ী শ্রীলঙ্কা দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। জয়াসুরিয়া-কালুভিতারানার ঝড়ো শুরুর পর ধীরস্থিরভাবে লংকানদের ইনিংসকে বড় সংগ্রহে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২৩০ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ক্যান্ডিতে ২৩ রানের মাঝেই দুই ওপেনার সাজঘরে ফিরে গেলে ডি সিলভাকে সাথে নিয়ে সেদিন লঙ্কানদের জয়ের বন্দরে ভেড়ান গুরুসিনহাই, খেলেন ১০০ বলে ৮৬ রানের ঠাণ্ডা মাথার এক ইনিংস।

এছাড়া কেনিয়ার বিপক্ষে ৮৪ রানের পাশাপাশি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ৪৫ বলে ৬৩ রানের ঝড়ো এক ইনিংস। ফাইনালেও স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন গুরুসিনহা। অরবিন্দের সাথে ১২৩ রানের জুটি গড়ে দলকে এনে দেন লড়াই করার মতো সংগ্রহ, পল রাইফেলের বলে বোল্ড হবার আগে করেন ৬৫ রান। সে বারের বিশ্বকাপে ৫১ গড়ে ৩০৭ রান সংগ্রহ করেন তিনি।

কিন্তু বোর্ডের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে মাত্র ২৯ বছর বয়সেই সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। জাতীয় দলের হয়ে ৪১ টেস্টে তার সংগ্রহ ২,৪৫২ রান। পাশাপাশি একদিনের ক্রিকেটে ১৪৭ ম্যাচে করেছেন প্রায় চার হাজার রান।

ক্রিকেট ছাড়ার পর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে চলে যান তিনি। সেখানে ক্রিকেট কোচ হিসেবে নতুন যাত্রা শুরু করেন গুরুসিনহা। মাঝে কিছুদিন যুক্ত ছিলেন ক্রিকেট শ্রীলঙ্কার (এসএলসি) সাথেও। ছিলেন জাতীয় দলের ম্যানেজার ও নির্বাচক কমিটির সদস্য। বর্তমানে নাইজেরিয়া জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নিযুক্ত আছেন এই সাবেক লঙ্কান ক্রিকেটার। এখানেও তিনি বাকিদের চেয়ে আছেন আড়ালেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link