সব খেলার সেরা জগু ডালমিয়ার এই ক্রিকেট আর সব ক্রিকেটের সেরা লাল-বল সাদা-পোশাকের টেস্ট ম্যাচ। জগু ডালমিয়া লিখলাম কেন? আরে মহায়, বাষট্টিতে এশিয়ান গেমসে ফুটবলেও সোনা পেয়েছিল ভারত।
হকিতে বিশ্বকাপ ৭৫-এ আর অলিম্পিকে ৮০-র সোনা। তাও তো ৮৩-র কপিল বাহিনীতে সওয়ার হয়ে ক্রিকেটটা ভারতের ‘সেরা খেলা’ হয়ে চলে গেল। এই কাজটা নেপথ্যে থেকে যিনি করেছেন, তাঁকে ক্রেডিট তো দিতেই হয়।
বিরাট কোহলিকে শুনতে হয় যে, সে আর বলার মতো কাকেই বা ফেস করেছে! ফুল ফর্মের মিশেল জনসন, জোনাথন ট্রটের ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছিল। জিমি অ্যান্ডারসন সর্বাধিক টেস্ট উইকেট শিকারি পেস বোলার। ঠিক তেমনই বাঁহাতি স্পিনারদের মধ্যে সর্বাধিক উইকেট শিকারি রঙ্গনা হেরাথ।
নিউজিল্যান্ডের ট্রেন্ট বোল্ট, শ্রীলঙ্কার লাসিথ মালিঙ্গা। দক্ষিণ আফ্রিকার মরকেল, ফিল্যান্ডার। এরা মনে হয় গত আট-ন বছরে টেস্ট ক্রিকেট খেলেনি। মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স, জেমস প্যাটিন্সন, স্টুয়ার্ট ব্রডও না।
সে যাকগে, আমরা আর-একজনকে ধরি, ঋদ্ধিমান সাহা। লক্ষ্মণের চোট, রোহিত ম্যাচের দিন সকালে চোট পেল, তো ২০১০-এর নাগপুরের বিদর্ভ স্টেডিয়ামেকে ব্যাটসম্যান হিসাবে খেলল? ঋদ্ধিমান সাহা। আমাদের পাপালি। বর্তমান বিশ্বের টেকনিক্যালি সবথেকে সেরা উইকেটকিপার। কিন্তু প্রথম ইনিংসে, একটা আধা আউটসুইং-এ ব্যাট ঠেকানো, তার পরেরটা অফস্টাম্পের বাইরে বিট হওয়া।
আর তার পরের বিধ্বংসী অফকাটারে পা নিয়ে আসার আগেই উইকেট ছিটকে যাওয়া। প্রথম ইনিংসে শূন্য তো গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথও করেছিলেন। কিন্তু কেউ কি কার বলে আউট হয়েছিলেন মনে রেখেছে? আমরা রেখেছি পাপালির ক্ষেত্রে, কারণ বোলারের নাম ডেল স্টেন। বিরানব্বইয়ের শ্রীলঙ্কা ম্যাচে ডোনাল্ডের আউটস্যুইং, যা বাঁহাতিদের ইনস্যুইং, গুরুসিনহার পা পেয়ে যায় উইকেটের সামনে। গুরুসিনহা তখনও ব্যাট আর পা নিয়ে আসতেই পারেননি। সেই বলটাই মনে পড়ে গেল যেন।
ডেল স্টেন। গত দশ বছরে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বের টেস্ট ক্রিকেটে এক নম্বর হওয়ার মূল কারিগর তাদের পেস বোলিং ব্যাটারি। ফিল্যান্ডার, মর্কেল, এনটিনি, রাবাদাদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সর্বকালের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার এবং আমার মতে দক্ষিণ আফ্রিকার সেরা (হ্যাঁ, ডোনাল্ডেরও আগে থাকবে, আমার মতে) ডেল স্টেন।
\কেন বললাম স্টেনকে সেরা? পাঁচ ফুট সাড়ে নয় ইঞ্চির স্টেন, অনেকটা ম্যালকম মার্শালের মতোই। লম্বা লম্বা পেস বোলারদের পৃথিবীতে একরাশ তাজা হাওয়া।
অ্যাথলেটিক ও শক্তিশালী রান আপ, কোমরের আর কাঁধের ঝাঁকুনিতে মসৃণ আউটস্যুইং, অফ কাট, ইনস্যুইং, লেগকাট, স্লোয়ার, ইয়র্কার, বাউন্সার। কী নেই তাঁর তূণীরে? জোহানেসবার্গের অস্ট্রেলিয়াকে বা প্রথম ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বা ফর্মে না-থাকা অবস্থায় শেষ ভারত সিরিজে পুরোনো বলে রিভার্স স্যুইং, এসবের ঊর্ধ্বে উঠে ডেল স্টেনকে সবার থেকে এগিয়ে রাখছে উপমহাদেশের মরা উইকেটে তাঁর সাফল্য।
মাত্র কুড়িটার মতো টেস্টে একশোটার মতো উইকেট তাকে গ্লেন ম্যাকগ্রা, রিচার্ড হেডলি, ইয়ান বোথাম, এদের থেকে এগিয়ে রাখছে। দু-একজনের হয়তো অ্যাভারেজ স্টেনের থেকে কম, কিন্তু উপমহাদেশের মাটিতে প্রতি চুয়াল্লিশ বলে একটা উইকেট তুলে নেবার এলেম মুরালিধরনেরও ছিল না। একমাত্র তুলনায় আসে বোধহয় ওয়াকার ইউনুস।
আর-একটা ব্যাপারে স্টেনকে এগিয়ে রাখব। আগ্রাসন আর না-আগ্রাসন। স্টেন মনে হয়, বর্তমান ক্রিকেট পৃথিবীর সর্বাধিক জনপ্রিয় পেস বোলার। জিমি অ্যান্ডারসনের মতো খামোখা জাদেজাকে আলতুফালতু বলা নেই, স্টুয়ার্ট ব্রডের মতো ন্যাগিং ব্যাপারস্যাপার নেই, স্টার্ক বা জনসনের বকবকানি নেই, ওদিকে ট্রেন্ট বোল্ট অবশ্য হাসিমুখে মানুষ খুন করেই চলেছে।
কিন্তু, ডেল স্টেনের একটা লাজুক লাজুক হাসি এবং সবার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার তাকে মানুষের কাছের করে তুলেছিল। অবশ্য মাঠের ভিতরে নয়। সেখানে ডেল স্টেন একটা টেরিয়ারের মতোই দ্রুত এবং ভয়ংকর।
অনেকগুলো না-পাওয়া থেকে যাবে, ২০১৫-র বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল তার মধ্যে একটা। অথবা তরতরিয়ে চলতে চলতে কাঁধ এবং ল্যাটিসের চোট বারেবারেই দ্রুতগতির ট্রেনকে হ্যাঁচকা মেরে থামিয়ে দিয়েছে। আর টেস্ট ক্রিকেট থেকে থেমে গেল তো ক-দিন আগেই। ৯৩টা টেস্ট, ৪৩৯ উইকেট, সীমিত ওভারের ম্যাচে ১৯৫টা উইকেট, এসব তো সংখ্যা।
এই সংখ্যা দিয়ে কিছুটা হয়তো বোঝা যায়। কিন্তু ওই বুলেট ইঞ্জিনের মতো ছুটে আসা, একটা লাফ, বাঁ হাতের মুঠো করে রাখা, পুরো সোজা না করে ডান হাতের তিন আঙুলের ডগা থেকে ছাড়া বিষ তিরগুলো আর সাদা জামার ক্রিকেটে কারও দিকে ধেয়ে আসবে না। স্টিভ স্মিথ, জো রুট, কেন উইলিয়ামস, বিরাট কোহলিরা একটু হলেও নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন।
তবে ডেল স্টেন বোধহয় ঘুমোবেন না। অন্ধকার রাতে মাঝে মাঝেই উঠে পড়ে মনে হবে, ‘আর-একবার যদি, আর-একবার!’
কোথাও-না-কোথাও তো থেমে যেতেই হয়। স্টেনও বিশ্বকাপের পরে বুঝতেই পেরেছেন মনে হয়। এই অব্দিই জার্নিটা ছিল। বাকিটা সাদা বলের পাজামা ক্রিকেটে। আপামর ব্যাটসম্যানসাধারণকে আরও কিছুদিন একটু অশান্তিতে রেখে দেওয়া। এতে তো ক্রিকেট জনতারই লাভ। আর কে বলতে পারে ক্রিকেট দেবতাও হয়তো মুচকি মুচকি হাসছেন, এই ভেবে যে, সাধারণ নশ্বর ব্যাটসম্যানদের ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখার জন্য তাঁর সর্বকালের অন্যতম সেরা অস্ত্রে এখনও কিছু ধার বাকি। আসলে ইডেন পার্কের সেমি ফাইনালের যে স্বপ্নভঙ্গ।
অনামী গ্র্যান্ট এলিয়টের অতর্কিত আক্রমণে হঠাৎ করে জ্যাম হয়ে যাওয়া, সে কি এক জীবনে ভোলা যায়? স্টেনগানের গুলি কি অত সহজে ফুরোয়? ফুরোয় ফুরোয়, সামান্য আইপিএল বা দক্ষিণ আফ্রিকার সুপার লিগ- রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ জর্জরিত হয়ে একসময় থাবা তুলে রাখেন, ক্ষতবিক্ষত দাঁতের বাঁধন স্থান নেয় অবসরের অ্যালবামে। কিন্তু তবু কিছু থেকে যায়, ফেলে আসা দিনের বহুব্যবহৃত জুতোয় রক্তের দাগ মেটে না কখনও!
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক