দ্য হিস্টোরি বয়!

১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রায়ান লারার ৩৭৫ রানের সেই ঐতিহাসিক ইনিংসটা শুধু ক্রিকেট ভক্তই নয় অনেক ক্রিকেটারের মনেও গেঁথেছিল। তক্তা পিচে ৪০০ রানের রেকর্ড গড়া ইনিংসের চেয়েও অনেকেই ৩৭৫ রানের ইনিংসটিকে সেরা মনে করেন।

১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রায়ান লারার ৩৭৫ রানের সেই ঐতিহাসিক ইনিংসটা শুধু ক্রিকেট ভক্তই নয় অনেক ক্রিকেটারের মনেও গেঁথেছিল। তক্তা পিচে ৪০০ রানের রেকর্ড গড়া ইনিংসের চেয়েও অনেকেই ৩৭৫ রানের ইনিংসটিকে সেরা মনে করেন। এর মধ্যে একজন ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার খ্যাত মোহাম্মদ আশরাফুল। ব্রায়ান লারার সেই দাপুটে ইনিংসের দিনে আশরাফুল তখন মাত্র ১০ বছরের বালক! সেদিনই মনে মনে জেদ ধরলেন তিনিও একদিন সেঞ্চুরি করবেন। অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে।

সেই জেদ পুষে রেখেছিলেন ২০০১ সাল পর্যন্ত। ১৭ বছর বয়সী তরুণ উদীয়মান হিসেবে সেদিন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সাদা পোশাকে অভিষিক্ত হন আশরাফুল। অভিষেকের আগে অ্যাশ সরল মনে চলে গেলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক নাইমুর রহমান দূর্জয়ের কাছে। দূর্জয়ের সামনে অকপটে জাহির করলেন নিজের স্বপ্নের কথা।

আশরাফুলকে তখন অধিনায়ক বললেন পজিটিভলি খেলবে তাহলেই তুমি তোমার স্বপ্নকে জয় করতে পারবে। ব্যাস, অধিনায়কের কথা মনের মধ্যে গেঁথে নিলেন তিনি। আর লঙ্কানদের ডেরায় রেকর্ড গড়ে অভিষেকেই স্বপ্নের সেই সেঞ্চুরি তুলে নেন আশরাফুল। সে সময় বল হাতে ২২ গজের রুদ্রমূর্তি মুত্তিয়া মুরালিধরনকেও পাত্তা দেননি ১৭ বছর বয়সী এই তরুণ ক্রিকেটার।

যে মুরালির বল খেলতে ভয় পেতেন ২২ গজে ব্যাট হাতে আগ্রাসী তারকা বীরেন্দ্র সেওয়াগসহ আরও অনেক তারকা ক্রিকেটার। সেই মুরালিকে অভিষেকেই এক তরুণ ছোকরা পাত্তাই দেয়নি। সিংহের ডেরায় বাংলাদেশের পক্ষে একাই গর্জন করেছিলেন আশরাফুল।

বাকিরা যেখানে মুরালির সামনে করছিলেন অসহায় আত্মসমর্পণ, সেখানে মুরালিকে সহজেই সামলেই নিয়ে বেশ কয়েকবার বাউন্ডারি হাঁকান আশরাফুল। মুরালিকে এতো সহজেই সামলে নেবার ফর্মুলাটাও অবশ্য ছিল তাঁর কাছে। সেসময় বাংলাদেশের হয়ে একজন নেট বোলার ছিলেন নাম ইব্রাহিম সাগর। যিনি মুরালির মতোই বোলিং করতেন। যাকে বলা হয় বৈধ অ্যাকশনে দুসরা বল করতে পারা প্রথম বাংলাদেশী বোলার! নেটে সাগরকে এতোবার খেলেছেন যে মাঠের মুরালিকে কখনোই থ্রেট মনে করেননি আশরাফুল।

একপ্রান্তে দলের বাকিরা আশা যাওয়ার মিছিলে থাকলেও আরেকপ্রান্তে দুর্দান্ত দাপট দেখিয়ে একক বীরত্বে সবচেয়ে কম বয়সে টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন আশরাফুল।

সেপ্টেম্বর ৬, ২০০১। এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে ইনিংস ব্যবধানে পরাজয়ের পর বাংলাদেশ তখন লঙ্কানদের ডেরায়। মাত্র দু’বছর আগে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া দলটা তখন কাগজে কলমে বেশ দুর্বল দল। প্রতিপক্ষের সামনে নূন্যতম ভিত গড়ার মতোও অবস্থায় ছিল না দলের কেউই। সে সময়ে খর্বশক্তির বাংলাদেশ দলে ভবিষ্যতে তারকা খ্যাতি নিয়ে আসেন একজন। সেই দলের আশার আলো জ্বালিয়ে বাংলাদেশের হয়ে অভিষিক্ত হন মোহাম্মদ আশরাফুল। ঠিক এর আগের টেস্টটাতেই তাঁর জায়গায় খেলেছিলেন আকরাম খান।

কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব গ্রাউন্ডে টসে হেরে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ। লাঞ্চ বিরতির আগেই মুরালির ঘূর্ণিতে দিশেহারা হয়ে ৬১ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ব্যাকফুটে তখন সফরকারীরা। লাঞ্চ বিরতির কিছু সময় পরই মাত্র ৯০ রানে গুড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। দলের পক্ষে অভিষিক্ত আশরাফুলই করেন সর্বোচ্চ ২৬ রান। মুরালি শিকার করেন মাত্র ১৩ রানে ৫ উইকেট।

এরপর নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে দিনশেষে ১ উইকেটে ২৪৬ রান সংগ্রহ করে লঙ্কানরা। প্রথম দিনেই বাংলাদেশের মামুলি সংগ্রহ টপকে ১৪৬ রানের লিড নেয় হোস্টরা। সনাথ জয়সুরিয়ার ৫৬ বলে ৮৯ সেই ব্যাটিং তাণ্ডব হয়তো বাংলাদেশের বোলাররা বাজে স্বপ্ন ভেবেই ভুলে যেতে চাইবেন! দ্বিতীয় দিনে যেন আরও ভয়ংকর রূপ নেয় লঙ্কানরা। একদিকে মারভান আথাপাত্তু, আরেকদিকে, মাহেলা জয়বর্ধনে! দুইজনের ব্যাটিং দাপটে ৫৫৫ রানের পাহাড় গড়ে শ্রীলঙ্কা।

আথাপাত্তু ২০১ রানে রিটায়ার্ড হার্ট হলেও মাহেলা জয়বর্ধনে ১৫০ রানে রিটায়ার্ড আউট হন! ক্রিকেটের ১২৪ বছরের ইতিহাসে সেবার প্রথম কোনো ব্যাটসম্যান রিটায়ার্ড আউট হন। জয়সুরিয়ার ১৫৯ স্ট্রাইক রেটের পর জয়বর্ধনে ওই ইনিংসে ১৩০ স্ট্রাইক রেটে দেড়শো করেন! জয়সুরিয়া-জয়বর্ধনেরা সেই ইনিংসে বাংলাদেশের বোলারদের সাথে একপ্রকার ছেলেখেলায় মেতে উঠেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ৫ উইকেটে ৫৫৫ রানে ইনিংস ঘোষণা করে শ্রীলঙ্কা।

দ্বিতীয় দিনের তখনও প্রায় অনেক সময় বাকি। ৪৬৫ রানে পিছিয়ে থেকে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ৮১ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে আবারও বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ। দিনশেষে আশরাফুল তখনও উইকেটে থিতু। মনে মনে হয়তো পণ করে ফেলেছিলেন এই ইনিংসেই নিজের স্বপ্নকে রূপ দেবেন বাস্তবে।

৮ সেপ্টেম্বর, ২০০১। ম্যাচের তৃতীয় দিন। আশরাফুলের ক্যারিয়ারের সেই স্বপ্ন পূরণের দিন।

প্রথম ইনিংসের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও বাংলাদেশের সামনে বল হাতে ভয়ংকর রূপ নেওয়া মুরালিকে সহজেই বাউন্ডারি মারছিলেন আশরাফুল! মুরালির লেংথ বলে স্লগ সুইপ কিংবা ড্রাইভ মারছিলেন। সেসময়ে ২২ গজে ব্যাটসম্যানদের আতংক মুরালি কিছুইতেই বশে আনতে পারেননি ১৭ বছর বয়সী এই কিশোর ব্যাটসম্যানকে। সহজেই একপ্রান্তে উইকেট পড়লেও আরেক প্রান্তে ভাস-মুরালিদের অবলীলায় খেলে দাপুটে ব্যাটিং করে আশরাফুল তুলে নেন রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরি। পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান মুশতাক মোহাম্মদের সবচেয়ে কম বয়সে করা টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ড গুড়িয়ে নতুন রেকর্ড গড়েন আশরাফুল।

১৯৬১ সালে ভারতের বিপক্ষে মাত্র ১৭ বছর ৭৮ দিনে টেস্ট সেঞ্চুরি পান মুশতাক। সেই রেকর্ড গুড়িয়ে ১৭ বছর ৬১ দিনে টেস্ট সেঞ্চুরি করেন আশরাফুল। একই সাথে টেস্ট অভিষেকে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ডও গড়েন তিনি। জিম্বাবুয়ের হ্যামিল্টন মাসাকাদজার ১৭ বছর ৩৫৪ দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষিক্ত সেঞ্চুরি টপকে অভিষেকে সবচেয়ে কম বয়সী ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন আশরাফুল।

সে সময় বয়স নিয়েও কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। আশরাফুলের পাসপোর্ট অনুযায়ী সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ বার্থ ডেট থাকলেও মূলত তাঁর বার্থ ডেট ৭ জুলাই! তাই প্রাথমিক ভাবে অনেকের মনে হয়েছিল, আশরাফুল সবচেয়ে কম বয়সে টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙতে পারেননি। অবশ্য ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে রেকর্ড তালিকায় ঠিকই শীর্ষে নাম তোলেন আশরাফুল।

রুচিরা পেরেরার বলে আউট হবার আগে ১১৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস উপহার দেন তিনি। ২১২ বলে ১৬ চারে ১১৪ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলেন তিনি। ম্যাচে ইনিংস এবং ১৩৭ রানের বড় পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়া বাংলাদেশের একমাত্র সাফল্য ছিল আশরাফুলের রেকর্ড গড়া সেই সেঞ্চুরি।

প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেটের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও ৫ উইকেট নেওয়া মুরালিধরনের পারফরম্যান্স ছাপিয়ে ম্যাচ সেরা পুরস্কার জেতেন দলের পক্ষে একাই লড়াই করা অভিষিক্ত তরুণ মোহাম্মদ আশরাফুল। পরিসংখ্যানে সেটাই লেখা আছে। তবে, আসল ব্যাপার হল মুরালিই জিতেছিলেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার। সেটা তিনি তুলে দেন আশরাফুলের হাতে। যদিও, কালক্রমে ক্যারিয়ারের সম্মান আর সম্ভাবনা কোনোটাই নিজের হাতে রাখতে পারেননি ‘আশার ফুল’!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link