ক্রিকেটের কী এক অবিস্মরণীয় সময় ছিল তখন। নব্বইয়ের দশকের টেস্ট ক্রিকেটের সে কী রোমাঞ্চ। তাও আবার যদি করাচিতে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয় মাইটি অস্ট্রেলিয়া। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুসের গতির সাথে শেন ওয়ার্নের ঘূর্ণি। ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য এক রূপকথার গল্প। ক্রিকেটের মধুরতম সময়, মধুরতম ক্ষণ।
পাকিস্তানের তখন এক স্বপ্নের মত দল। বছর দুয়েক আগেই ইমরান খানের দলটা জয় করে এসেছে বিশ্বকাপ। ১৯৯৪ সালের শেষ দিকে টেস্ট সিরিজ খেলতে পাকিস্তান পৌঁছল ক্রিকেটের আরেক পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ায়। ঘরের মাঠে ওয়াসিম আকরামরা যে ভয়ানক হয়ে উঠবেন তা অনুমেয়ই ছিল। আবার উপমহাদেশের উইকেটে শেন ওয়ার্নের রহস্যের জলও ঘোলা হচ্ছিল ক্রমশ।
ওয়াকার ইউনুসের স্যুইং নাকি গ্লেন ম্যাকগ্রার বাউন্ড কোনটায় মুগ্ধ হবে দুনিয়া সেই আলোচনায় তখন ডুবে আছে গোটা করাচি শহর, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া ও ক্রিকেট দুনিয়া। এত জল্পনা কল্পনার মাঝেই করাচিতে সিরিজের প্রথম টেস্ট খেলতে মাঠে নামলো দুই দল।
আগে ব্যাট করতে নামা অস্ট্রেলিয়ার দুই ওপেনারই কাঁটা পড়ে ওয়াসিম আকরামের স্যুইংয়ে। অধিনায়ক মার্ক টেলর ফিরে যান রানের খাতা খোলার আগেই। ওদিকে ডেভিড বুন ও মার্ক ওয়াহও ফিরে যান দ্রুতই। মাত্র ৯৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বেশ বিপাকেই পড়ে অস্ট্রেলিয়া।
সেই সময় দলের ঢাল হয়ে দাঁড়ান সেই ম্যাচে অভিষিক্ত হওয়া মাইকেল বেভান। নিজের অভিষেক ইনিংসেই খেলেন ১৪৬ বলে ৮২ রানের ইনিংস। সাথে স্টিভ ওয়াহও করেছিলেন ৭৩ রান। তাঁদের এই জুটতে ভর করেই প্রাথমিক ধাক্কা কাঁটিয়ে ওঠে ৩৩৭ রানের সংগ্রহ গড়ে অস্ট্রেলিয়া।
ওদিকে জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা দারুণ করে পাকিস্তানের দুই ওপেনার। সাঈদ আনোয়ার ও আমির সোহেল মিলে গড়েন ৯০ রানের জুটি। তবে এরপরেই বল হাতে নিজেদের আসল রূপ দেখান শেন ওয়ার্ন ও গ্লেন ম্যাকগ্রারা। তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়তে থাকে পাকিস্তানের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপ। শেষ পর্যন্ত মাত্র ২৫৬ রানেই থামে পাকিস্তানের প্রথম ইনিংস।
দ্বিতীয় ইনিংসে লিড বাড়াতে ব্যাট করতে নামে অস্ট্রেলিয়া। তবে এবার ওয়াসিম আকরাম যেন আরো অপ্রতিরোদ্ধ। তাঁর সামনে অস্ট্রেলিয়ার নামী সব ব্যাটসম্যানরা রীতিমত অসহায় আত্মসমর্পণ করছেন। ২২ ওভার বলে করে মাত্র ৬৩ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিলেন ওয়াসিম আকরাম। তাঁর বোলিং তোপে এবার ২৩২ রানেই অল আউট হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া। করাচি শহরে এবার উত্তাপটা ফিরে এলো।
পাকিস্তান বেশ ভালো ভাবেই ম্যাচ ফিরল। তবে বাকি কাজটা একেবারে সহজ ছিল না। চতুর্থ ইনিংসে ৩১৪ রানের টার্গেট একেবারে মুখের কথা না। এখান থেকে জিততে পারে যেকোন দলই। তবে করাচির উত্তাপ নিশ্চই একটা বাড়তি সুবিধা দেয়ার কথা সাঈদ আনোয়ার, ইনজামাম উল হকদের। তবে শেন ওয়ার্ণও নিশ্চই ছেড়ে কথা বলবেন না। ওয়াসিম আকরামের জবাব দেয়ার দায়িত্ব তুলে নিলেন নিজের কাঁধেই।
চতুর্থ ইনিংসে করাচির পিচে শেন ওয়ার্নের গুগলি যেন এক বিশাল রহস্য হয়ে উঠলো পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের সামনে। ওয়ার্নের ঘুর্নিতে ১৮৪ রানেই ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলে পাকিস্তান। শেন ওয়ার্ন তখন রীতিমত এক হিংস্র বাঘ। তবুও ব্যাট হাতে একাই লড়াই করে যাচ্ছিলেন ইনজামাম উল হক। রাশিদ লতিদ, মুশতাক আহমেদদের নিয়ে প্রতিরোধটা গড়ার চেষ্টা করে গেলেন।
এরমধ্যে ওয়াকার ইউনুসের উইকেট নিয়ে নিজের ৫ উইকেট পূর্ণ করেছেন শেন ওয়ার্ন। অস্ট্রেলিয়ার জয়ের জন্য তখন প্রয়োজন মাত্র ১ টি উইকেট। ওদিকে পাকিস্তানের প্রয়োজন আরো ৫৪ রান। ইনজামাম উল হক তখনো লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন মুশতাক আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে।
শেষ উইকেটেই দু’জনে মিলকে দলকে নিয়ে গেলেন জয়ের বন্দরে। তাঁদের ব্যাটে বৃথা গেল ওয়ার্নের ম্যান অব দ্য ম্যাচ জয়ী পারফর্মেন্স। করাচিতে সেদিন একটা জোয়ার বয়ে গেল। যেই জোয়ার ছড়িয়ে পড়েছিল উপমহাদেশের প্রতিটা শহরেই।