জীবন যুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিক
শোনা যায় এরই মধ্যে একটি চোখের জ্যোতি হারিয়ে ফেলেছেন যা তার ক্যারিয়ারকে ছোট করে দিয়েছে। দু:খ, হতাশায় নিজেকে শেষ করে দিতেও চেয়েছেন, যা শোনা বা পরিবেশন করা একজন ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে খুবই কষ্টকর।
২০০৮ সালে ভারতে পাতা ঝরার মৌসুম তখন শেষ হয়ে আসছে। কয়েক মাস আগেই একদিনের বিশ্বকাপের এক রাশ হতাশাকে মুছে দিয়ে ক্রিকেটের নব ও ক্ষুদ্রতম সংস্করণে বিশ্ব সেরার মুকুট মাথায় তুলে নিয়েছে মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দল।
সেই সময় সীমিত ওভারের দলে নতুন রক্তের আগমন হতে শুরু করেছে যারা ওই বিশ্বকাপেই নিজেদের চেনাতে শুরু করেছে। এই সময় অস্ট্রেলিয়ায় শুরু হলো ত্রিদেশীয় কমনওয়েলথ ব্যাংক একদিনের সিরিজ, যেখানে আয়োজক অভিজ্ঞ অস্ট্রেলিয়ার সাথে দুই সফরকারী দল হলো নতুনভাবে শুরু করতে যাওয়া ভারত এবং ২০০৭ বিশ্বকাপে ফাইনালে হতাশাজনকভাবে হেরে যাওয়া শ্রীলঙ্কা দল।
ধোনির নেতৃত্বে এক ঝাঁক তরুণ মুখের মাঝে অভিজ্ঞ বলতে শচীন টেন্ডুলকার, বীরেন্দ্র শেবাগ, হরভজন সিং ও যুবরাজ সিং। যাই হোক এক মাস তিন দলের অসাধারণ লড়াইয়ের পর ফাইনালে মুখোমুখি হলো সেই সময় দুই বিশ্বকাপের দুই চ্যাম্পিয়ন দল। তবে এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রাস্তাটা একটু ভিন্ন, একটু কণ্টকিত। ফাইনালে দু’টি ম্যাচ জিততে হবে যারা চ্যাম্পিয়ন হতে চায়। বিপক্ষ দলে বিশ্বকাপ জয়ী দলের প্রায় সবাই। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ম্যাথু হেইডেন, রিকি পন্টিং, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস, মাইকেল হাসি, মাইকেল ক্লার্ক, ব্রেট লি, কিংবা ন্যাথান ব্র্যাকেন – কে নেই সেই দলে!
কিন্তু, ধোনির নেতৃত্বে সেই তরুণ দলের কিছু করে দেখানোর প্রবল ইচ্ছা সবাইকে বিস্মিত করেছিল, সঙ্গে ছিলেন বহু যুদ্ধের নায়ক শচীন রমেশ টেন্ডুলোর। প্রথম ফাইনালে পেসারদের অসাধারণ বোলিং ও লিটল মাস্টারের শতরানের উপর ভর করে ৬ উইকেটে ম্যাচটি জিতেছিল। বিপক্ষ দলকে মাত্র ২৩৯ রানে আটকে রাখতে নতুন বলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এক তরুণ খর্বকায় পেসার – প্রবীন কুমার, তিনি তাঁর অসাধারণ স্যুইংয়ে শক্তিশালী বিপক্ষ দলের শুরুর প্রধান দুই ব্যাটসম্যানকে প্যাভিলিয়নে পাঠিয়েছিলেন।
যদিও শুরুর দিকে ওই সিরিজে দলে সুযোগ পাননি যেহেতু অন্যদের তুলনায় যার অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার এবং বলের গতি দুটোই কম। ওই সিরিজে যখন সুযোগ পেলেন তখন কোনো উইকেট নিতে না পারলেও পরের ম্যাচেই তথা ফাইনালের আগের ম্যাচে কিংবদন্তী কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনে, তিলকারত্নে দিলশানদের ফিরিয়ে প্রথম বারের জন্য ম্যাচের সেরা হওয়ার সুখস্মৃতি লাভ করার সুবাদে ফাইনালে সুযোগ পান প্রবীন কুমার।
কিন্তু ফাইনালে একটি ম্যাচ জিতলেই তো হবে না, আরও একটি ম্যাচ জিততে হবে। আর প্রতিপক্ষ যেহেতু অস্ট্রেলিয়া তখন তারা মরণ কামড় কিংবা ঘুরে দাঁড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করবে তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। সেই ফাইনালে যখন আবার শচীনের ৯১ রানের অসাধারণ ইনিংসে বিপক্ষকে ২৫৯ রানের লক্ষ্য দিল তখন ম্যাচের অবস্থা যে দু’পক্ষের দিকেই সমান সমান তা আর বলে দিতে হয় না।
অস্ট্রেলিয়া দল ব্যাটে নামতেই তরুণ সুইং বোলার প্রবীনের আবার কেরামতি শুরু। আগের দিন যেমন শুরুতেই দলের দুই প্রধান স্তম্ভকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তেমনই আবার সেই দুজনকে ফেরালেন ৩ ওভারের মধ্যেই। আহা!
সেই সুইং এখনো চোখে ভেসে আছে।
এরপর যখন আরেক জন বিশ্বজয়ী অধিনায়কের স্ট্যাম্প ছিটকে দিলেন ৩২ রানের মাথায়, তখন ভারতীয় দল সহ সমর্থকরা আশায় বুক বাঁধলেন যে আজ ইতিহাস রচিত হতে যাচ্ছে। ইনিংসের ৪৯.৪ তম ওভারে যখন অস্ট্রেলিয়া ৯ রান পেছনে থেকে অল আউট হলো তখন ইতিহাস রচিত হয়েছে এবং ম্যাচের সেরাও হয়েছিলেন সেই অসাধারণ সুইং বোলার। এরপরের দুবছর ভারতীয় দলের একদিনের ক্রিকেটে নতুন বল তার হাতেই দেখা যেত।
এরপরের গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো।
মিরাটের জাদুকর থেকে ভারতের বিশ্বজয়ী দলের একজন সফল সদস্য হতে পারতেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস অন্যান্য কারণে আজ প্রবীন কুমার হেরে গিয়েছেন। যার পরিণতি তিনি একাধিকবার নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়ে বর্তমানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন।
সব সময় একজন ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতো শামলী জেলার ছোট্ট একটি গ্রামে পুলিশ হেড কনস্টেবল-চাষী পিতার ঘরের জন্মানো ছেলেটি। দারিদ্র্যতার কারণে একটা সময় ক্রিকেটের সরঞ্জাম কিংবা জুতো কিনে উঠতে পারতেন না। অনূর্ধ্ব -১৯ দলের ট্রায়াল দেওয়ার সময় সাধের সাইকেল বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেছেন কিন্তু থেমে থাকেননি।
ক্লাব ক্রিকেট খেলতে খেলতেই ২০০৫-০৬ মৌসুমে উত্তরপ্রদেশের হয়ে তাঁর রঞ্জি তথা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয়। আর অভিষেক বছরেই বাজিমাত। ওই মৌসুমেই প্রথম ও এখনও পর্যন্ত শেষ বারের জন্য চাম্পিয়ন হয় উত্তরপ্রদেশ। ব্যাটে-বলে ওই তরুণ তুর্কীর পারফরম্যান্স সবার নজর কেড়ে নেয়। যখনই উত্তর প্রদেশ বিপদে পড়তো তখনই মিরাটের জাদুকরের ডাক পড়তো। ফাইনালে বাংলার বিরুদ্ধে ওপেন করে ৪৮ কিংবা দুই ইনিংস মিলিয়ে একটি ৫ উইকেট সহ ৭ উইকেট উত্তর প্রদেশের ক্রিকেটে জোয়ার এনেছিল। গোটা টুর্নামেন্টে ৪১ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ৩৮৬ রান করেছিলেন।
এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। চ্যালেঞ্জার্স ট্রফিতে দু ম্যাচে ৯ উইকেট নেওয়ার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিষেক কিংবা পরের বছর অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে স্বপ্নের উড়ানের শুরু, মিরাটের জাদুকরের জাদু সবাইকে সম্মোহিত করেছিল।
না, এক্সপ্রেস গতির তিনি কোনোদিন ছিলেন না। কিন্তু ভারতের মাটিতে নতুন বলকে কিভাবে কাজে লাগাতে হয় তা সম্বন্ধে তার সম্যক জ্ঞান ছিল। হাওয়ায় দুদিকে সুইং কিংবা শেষের দিকে তীক্ষ্ণ ইয়র্কার দেওয়ায় কৃতিত্বেই পরবর্তী কয়েক বছর প্রবীন কুমার হয়ে উঠেছিলেন বিপক্ষ দলের কাছে ত্রাস।
কিন্তু, ২০১১ বিশ্বকাপের ঠিক আগের মুহূর্তে চোট তার জীবনটাকেই বদলে দিল। স্বপ্নের উড়ান সেই যে থমকে গেল তা আর ডানা মেলতে পারলো না। অন্যদিকে, নানা রকম বিতর্ক ও ঘটনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তাকে দূরে নিয়ে যেতে থাকলো। ঘরোয়া ক্রিকেট খেললেও নিয়মিত ছিলেন না। হতাশা, দুঃখ,বেদনায় প্রবীন কুমার মাত্র ৩২ বছর বয়সে অবসর নিয়ে ফেললেন ২০১৮ সালে।
শোনা যায় এরই মধ্যে একটি চোখের জ্যোতি হারিয়ে ফেলেছেন যা তার ক্যারিয়ারকে ছোট করে দিয়েছে।।দুঃখ, হতাশায় নিজেকে শেষ করে দিতেও চেয়েছেন,যা শোনা বা পরিবেশন করা একজন ক্রিকেট প্রেমী হিসেবে খুবই কষ্টকর। যাই হোক একটা সময় যদি ভারতীয় দলের সহযোগিতা পেতেন তাহলে আজ হয়তো এই দিন দেখতে হত না। আমরা আজও হয়তো এই মিরাটের জাদুকরের জাদুকরী সুইং এর সুধা আজও অমৃতের মতো পান করতাম।
জীবন যুদ্ধে এই পরাস্ত সৈনিক তিনি। তবে, তিনি থেমে যাননি হতাশায় ডুবে। চালিয়ে গিয়েছেন নতুন লড়াই। এখন তিনি পুরোদস্তর কোচ। হয়তো নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করবেন শিষ্যদের দিয়ে। আরও অনেক সুইং জাদুকরকে তুলে আনবেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এটাই কামনা, আর সেদিন আবার আপনি পরাস্ত সৈনিক হতে একজন স্বপ্ন দেখানোর সওদাগর হয়ে উঠবেন।