সালটা ২০০৪, রোনালদিনহো তখন ফুটবলের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, ঠিক বছর দুই আগে জিতেছেন ফুটবলের সর্বশ্রষ্ঠ শিরোপা বিশ্বকাপ। ২০০৩ এ প্যারিস সেইন্ট জার্মেই থেকে বার্সালোনাতে পাড়ি জমানো রোনালদিনহো একুশে মার্চ জন্মদিনের আয়োজন করেন তিনি।
ফুটবলের অন্যতম নান্দনিক সেই খেলোয়াড়ের জন্মদিনে বাবার হাত ধরে সাত বছরের রাফিনহাও গিয়েছিলেন। ফুটবলের মহাতারকা নিশ্চয়ই তাঁকে প্রচন্ড রকমের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন।
ব্রাজিল, ফুটবলের পুন্যভুমি। এখানকার অলিতে গলিতে ফুটবলারের জন্ম হয়। শুধু ফুটবলার না ঠিক একেকজন তারকার জন্ম হয়। এ আর নতুন কি? কিন্তু কারো কারো সংগ্রাম কিংবা দেশপ্রেম হয়ে যেতে পারে আলাদা গল্প।
ঠিক সংগ্রাম পার করেই বর্তমান ইংলিশ ক্লাব লিডস ইউনাইটেডের তারকা ব্রাজিলিয়ান রাফিনহা যার পুরো না রাফায়েল দিয়াস বেল্ললি নজর কেড়েছেন ফুটবল ভক্ত থেকে শুরু করে ব্রাজিলের কোচ তিতের। এর পাশাপাশি বড় বড় ক্লাবগুলোর রাডারেও তিনি চলে এসেছেন।
রোনালদিনহোর সাথে পরিচয় থাকলেও রাফিনহার পরিবারের সমাজের বিত্তশালী কিংবা প্রভাবশালী কেও ছিল না। বরং অতিসাধারণ একটি দরিদ্র পরিবারের ছেলে ছিলেন রাফিনহা। দারিদ্রতাই কেটেছে তাঁর শৈশব। এমনকি আহারের জন্যে থাকতে হয়েছে অপেক্ষায়, অন্যের সহায়তার। সেই রাফিনহার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩২ মিলিয়ন ইউরো।
তবে খুব সহজেই তিনি চলে এসেছেন এই পর্যায়ে তা কিন্তু নয়। দরিদ্রে পরিবারের একটি ছেলের ফুটবলার হবার স্বপ্নের সাধারণত মৃত্যু হয় অঙ্কুরেই। কিন্তু বাবার ইচ্ছে আর তাঁর প্রচেষ্ঠায় এর সাথে রোনালদিনহো কিংবা রোনালদো নাজারিওদের হাতে ওঠা বিশ্বকাপ ছোঁয়ার অনুপ্রেরণায় তিনি কখনো সরে যাননি ফুটবলার হবার কণ্টকাকীর্ণ পথ।
পর্তুগিজ বন্ধু ব্রুনো ফার্নাদেজও জুগিয়েছেন ভরসা। তাইতো কোন ক্লাব না পাওয়া রাফিনহা পর্তুগালের সেরা ক্লাব স্পোর্টিং সিপি থেকে ফ্রান্সের ক্লাব স্টেড রেইনেস হয়ে জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন ইংলিশ ক্লাব লিডস ইউনাইটেডের।
২০১৯/২০ মৌসুমে লিডস তাঁকে দলে নিয়ে আসেন ১৮ মিলিয়ন ইউরোতে। তারপর থেকে তিনি রীতিমত দলের ভরসার প্রতীক বনে যান রাফিনহা। তাছাড়া সমর্থকদের চোখের মনি বনে যান তিনি। রাইট উইং পজিশনে দলের আস্থার প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়তই।
গত মৌসুমে লিগের ৩১ ম্যাচ খেলে যদিও ছয় গোল পেয়েছেন, তবে গোল দিয়ে তাঁর খেলার মান বোঝা মুশকিল। দলের প্রয়োজনে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম তিনি এছাড়াও নয়টি এসিস্ট করেছিলেন গত মৌসুমেই।
এবারের মৌসুমের শুরু থেকেই তিনি যেন আরো বেশি উজ্জ্বল আগের মৌসুম থেকে। ইতিমধ্যে খেলা লিগের সাত ম্যাচে তিনি করেছেন তিন গোল করেছেন। এছাড়াও তাঁর অনবদ্য পারফর্মেন্স অবধারিত রেখেছেন তিনি।
এতেই সুনজরে এসেছিলেন ইতালির কোচ রবার্তো মানচিনির। দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকায় সম্ভাবনার সৃষ্টি এবং গুঞ্জনের ছড়াছড়ি হয়েছিল ইউরোপ থেকে লাতিন আমেরিকা অবধি। কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন ব্রাজিলের হয়েই খেলতে চান তিনি।
অবশেষে তাঁর আসার অবসান ঘটে। অভিষিক্ত হন পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হয়ে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের ম্যাচে। ব্রাজিলের কোচ তিতে বেস চিন্তিত ছিলেন রাইট উইং পজিশন নিয়ে। তাঁর সকল দুশ্চিন্তার যেন নিরাময় হয়ে তিতের আস্থা জুগিয়ে নিলেন রাফিনহা। আসলেন, খেললেন, জয় করে নিলেন। না কোন শিরোপা নয় কোচের ভরসা, সমর্থকদের পূর্ণ সমর্থন। তিন ম্যাচ খেলে চার গোলে অবদান রেখেছেন তিনি।
প্রথম ম্যাচে ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে খেলেছেন দ্বিতীয়ার্ধে। নেমেই যেন ঘুরিয়ে দিলেন খেলার গতিপথ। ১-০ তে পিছিয়ে ছিল ব্রাজিল। ম্যাচের ৭১ মিনিটে অসাধারণ কর্ণার কিক করে গোল আদায় করে নেন তাঁরই সতীর্থ মার্কুইনহোসকে দিয়ে। তারপর নিজের স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক খেলে উপহার দিতে থাকেন তিনি। ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে আরেক বদলি খেলোয়াড় অ্যান্টনিকে সহয়তা করেন দলের হয়ে তৃতীয় গোল করতে।
তারপরের ম্যাচে ব্রাজিল ড্র করে কলোম্বিয়ার সাথে। সেই ম্যাচেও তিনি নামেন বদলি খেলোয়াড় হিসেবে। তবে দল হিসেবে অগোছালো ফুটবল খেলা ব্রাজিল পায়নি কাঙ্খিত ফলাফল। তবে রাফিনহা ঠিকই তিতের পরিকল্পনার অংশে পরিণত হন। পরবর্তী ম্যাচেই উরুগুয়ের বিপক্ষে শুরুর একাদশে জায়গা পান তিনি।
সুযোগের স্বদব্যবহার করবেন না তিনি তা কি করে হয়? ম্যাচের ১৮ ও ৫৮ মিনিটে আদায় করে নেন দুইটি গোল। ডিফ্লেক্ট হওয়া বলে শিকারি বাজ পাখির মতো সঠিক স্থানে সঠিক সময়ে উপস্থিত থেকে বল জড়ান জালে। দ্বিতীয় গোলটায় গতির ব্যবহার দেখিয়েছেন তিনি। নেইমারের বাড়ানো থ্রু পাস থেকে বাম পায়ের জোড়ালো শটে গোল করে নেন রাফিনহা।
আগামী বছরেই অনুষ্ঠিতব্য কাতার বিশ্বকাপকে সামনে রেখে দল গোছানোর কাজটা করে ফেলেছে বাকি সব দল। তবে এখন পর্যন্ত দলের বিভিন্ন জায়গায় নতুন খেলোয়াড়দের বাজিয়ে দেখছেন ব্রাজিলের কোচ তিতে। তিনি ২০২২ বিশ্বকাপটা জয়ের জন্যই দল গোছাচ্ছেন।
তবে ডগলাস কস্তার বিকল্প পেতে খুব বেগ পোহাতে হচ্ছে তাঁকে। রাফিনহার জাতীয় দলের হয়ে এমন অভাবনীয় সূচনা নি:সন্দেহে তিতের সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত দেয়। এছাড়াও আরো আশা জাগায় বিশ্বকাপ জয়ের।
শুধু যে স্বপনের জাতীয় দলের অভিষেক হলো রাফিনহার তা কিন্তু নয়। ইতিমধ্যে তাঁকে দলে ভেড়াতে বেশ কিছু দল আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইংলিশ ক্লাব পরাশক্তি লিভারপুল কিংবা স্পেনের বার্সেলোনা তাঁর প্রতি আগ্রহের কথা বেশ ভালভাবেই ছড়িয়েছে ইউরোপিয়ান ফুটবল অঙ্গনে। কিন্তু এই রাফিনহার স্বপ্নের যাত্রা কতদূর পর্যন্ত এগোবে তা সময় বলে দিবে আর ভাগ্য বিধাতা।