১৯৯৮। মার্চের মাঝামাঝি। শীত বিদায় নিয়েছে কিছুদিন। তবে বাতাসে হাল্কা শিরশিরানি ভাব রয়েছে তখনও। বিশেষ করে সকালে। বসন্তের মিঠে আমেজের সঙ্গে শীতের নস্টালজিয়া মিশে দিব্যি একটা আবহাওয়া। ‘এমনও দিনে কি ঘরে থাকা যায়?’ কাব্য বোঝার মতো বয়স তখনও আমার হয়নি। সবে আট। প্রেম, প্রেয়সী শব্দের মানেও তখন অভিধানে।
বেরোতে হল বাবার হাত ধরে। ডেস্টিনেশন, ইডেন উদ্যান। ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয়েছে আমার বছর দুয়েক। সেভাবে বুঝি না খেলাটা। সবে সৌরভ গাঙ্গুলি, শচীন টেন্ডুলকার, নাম দুটো মুখস্থ হয়েছে। বসলাম ক্লাব হাউসের উপরের দিকে। হঠাৎ বাবা বললো, ‘এই ছেলেটা সত্যি দুর্দান্ত।’
সেদিনই ভি ভি এস লক্ষ্মণ নামটা প্রথম শুনি। সবুজ গালিচা চিরে লাল বলটা বাউন্ডারিতে আছড়ে পড়েছে সবে। মিড অন আর মিড উইকেটের মধ্যে দিয়ে। শেন ওয়ার্নকে অফ স্টাম্পের বাইরে থেকে টেনে, ব্যাকফুটে। শুরু হল ভালোলাগার এক দীর্ঘ যাত্রা। এখনও যা একইরকম অটুট।
সেদিন ওপেন করে ৯৫ রানের একটি ঝলমলে ইনিংস খেলেছিলেন লক্ষণ। তবে জাতীয় দলে জায়গা পাকা করতে পারেননি। অপরিহার্য হয়ে উঠতে আরও বছর তিনেক সময় লেগেছিলো। ওপেনিং নিয়ে কোনও দিনই স্বচ্ছন্দে ছিলেন না। ৯৬-এ অভিষেক, অর্ধশত রান করে নিজের জাত চেনালেও, মিডল অর্ডারে সুযোগ হচ্ছিলো না। মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন, সঞ্জয় মাঞ্জরেকর, শচীনরা আগে থেকেই ছিলেন।
পরে সৌরভ, রাহুল এসে যাওয়ায় কিছুতেই শিকে ছিঁড়ছিল না। ভাগ্য দেবী সে দরজা খুললেন আজাহার ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে নির্বাসিত হওয়ার পরে। লক্ষ্মণের সঙ্গে মূলত লড়াইয়ে ছিলেন মুম্বাইয়ের অমল মুজুমদার। উত্তরসূরি আজজুর জায়গা নিতে রঞ্জিতে সেবার অতি মানব হয়ে হাজির হন লক্ষ্মণ। ৯৯-২০০০ মৌসুমে লক্ষণের ব্যাটিং ছিল হিমালয় সম।
সুবিশাল, দুর্দমনীয়, কিন্তু স্বচ্ছ। মাত্র ৯ ম্যাচে ৮ সেঞ্চুরি সহ করেছিলেন ১৪১৫ রান। গড় ১০৮। যে রেকর্ড এখনও অটুট। এরপরে আর উপেক্ষা করার সাহস হয়নি নির্বাচকদের। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে রাহুল, সৌরভরা যখন ম্যাকগ্রা, লি, ওয়ার্নদের সামনে নাকানি চোবানি খাচ্ছেন, দলে ফিরেই লক্ষণ করেছিলেন ভেরি ভেরি স্পেশাল ১৬৭। আর অস্ট্রেলিয়ার ফিরতি সফরে সেই অমর ২৮১।
ভারতীয় ব্যাটিং নিয়ে আলোচনা হলে দুটো টার্ম সমুদ্র স্রোতের মতো ঘুরে ফিরে আসে। মুম্বই ঘরানার ‘খারুশ’ ব্যাটিং আর হায়দ্রাবাদী ঘরানার ‘টাচ প্লে’। এডুলজি আইবারার হাত ধরে উত্থান যে ‘হায়দ্রাবাদী স্কুল অফ ব্যাটিং’য়ের, সেই স্কুলের লেটার মার্কস পাওয়া শেষ ছাত্র লক্ষ্মণ। আজহারের জুতোয় পা গলিয়ে যে ‘পরম্পরা’ নিঃশব্দে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
কেমন ব্যাটসম্যান ছিলেন? বড় হয়ে লক্ষ্মণ হতে চায় শুনে উঠতি এক ক্রিকেটারকে জন রাইট বলেছিলেন, ‘ভাই ওর ব্যাটিং দেখ। উপভোগ করো। কিন্তু অনুকরণ করতে যেও না। লক্ষ্মণ ছাড়া কারও পক্ষে ওভাবে খেলা সম্ভব নয়।’
ইয়ান চ্যাপেল বলেছিলেন, ‘লক্ষ্মণের মতো স্পিন সামলাতে কাউকে দেখেননি।’ প্রিয় বন্ধু সম্পর্কে দ্রাবিড়ের উক্তি ছিল, ‘লক্ষ্মণের সঙ্গে ব্যাটিং করা দারুণ উপভোগ্য। শিল্পীকে সামনে থেকে শিল্প কর্ম তৈরী করতে দেখার মজাই আলাদা।’
ড্রাইভ, কাট, পুল, সর্বোপরি ফ্লিক আর লেগ গ্লান্স, তূণীরে সব অস্ত্রই মজুত ছিল তাঁর। কভার দিয়ে মারা বলটাই স্রেফ কব্জির মোচড়ে হেলায় মিড উইকেট বাউন্ডারিতে পাঠাতে পারতেন। আজহারের বাউন্সি উইকেটে সামান্য হলেও সমস্যা ছিল। লক্ষ্মণের সে অসুবিধা হয়নি। পুল আর কাট এত ভালো মারতেন! ফ্লিকগুলি যদি তাঁর তুলির টান হয়, পুল ছিল বক্সিংয়ের আপার কাট। ভয়ংকরের মোড়কে থাকা সৌন্দর্যের আবেশ।
কোন ইনিংস ছেড়ে কোনটা বলি। ২০০১-এর পরে বিশ্বের যে প্রান্তে খেলেছেন মণি মুক্ত ছড়িয়েছেন। ২৮১ আর মোহালি তে করা ৭৩, সর্বজনবিদিত। নতুন করে কালি খরচ নিরর্থক। আচ্ছা কিংসমিড ডারবানের কথা মনে আছে। সেদিন দুই ইনিংস মিলিয়ে ৩৮-এর গণ্ডি টপকাতে পারেননি কোনও ভারতীয়। লক্ষণ প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৩৭।
ডেল স্টেন, মরনে মরকেল, সোৎসবেদের গোলাগুলি সামলে দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৬। মনে আছে ২০০৪-এর অস্ট্রেলিয়া সিরিজ। আড়াই দিনে টেস্ট শেষ হওয়া ওয়াংখেড়ের খোয়াড়। অস্ট্রেলিয়া শেষ ইনিংসে ১০৭ তুলতে নেমে ৯৩-এ অল আউট। এক দিনে পড়েছিল ২০ উইকেট। একই জায়গায় পড়ে কোনও বল বেরোচ্ছে ব্যাটসম্যানের কান ঘেঁষে, তো কোনোটা হাঁটুর নিচে। ঘুরছে এক হাত করে।
তৃতীয় ইনিংসে ভারতের জয়ের ভিত গড়ে ছিল ১২ চারে সাজানো লক্ষণের অনবদ্য ৬৯। দুর্দান্ত স্পিন খেলার আরও একটা উদাহরণ ২০১০-এর শ্রীলঙ্কা সফর। তৃতীয় টেস্টে পিঠের চোট সামলে করেছিলেন ১০৩ রান। ৬২/৪ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর ব্যাটে ভর করেই ম্যাচ বার করে ভারত।
প্রতিটা ইনিংসে একটাই জিনিস কমন। যখনই বিপন্ন ভারত আশ্রয় খুঁজেছে, নিরাপত্তা চেয়েছে, ত্রাতা হিসাবে হাজির এই সাঁইবাবার ভক্ত। কখনও সঙ্গী রাহুল, কখনও শচীন। ঠান্ডা মাথায়, হাসতে-হাসতে, শটের ফুলঝুরি ছুটিয়ে, ম্যাচ জিতিয়ে ফিরেছেন, ‘ক্রাইসিস ম্যান অফ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট’। ফ্ল্যাট পিচ, দুর্বল প্রতিপক্ষ, যেখানে বাকিরা রান করবেন, সেখানে ঢেড়াবেন লক্ষ্মণ।
কঠিন পরিস্থিতি আর সে সময়ের সেরা প্রতিপক্ষ(অস্ট্রেলিয়া) দেখলে জ্বলে উঠবেন, এটাই ছিল তাঁর ললাটলিখন। আসলে ক্রিকেট বিধাতা বোধহয় চাননি বাকিদের সঙ্গে লক্ষণকে গুলিয়ে ফেলি আমরা।
পিকাসো, ভ্যান গগের সঙ্গে কি সবার তুলনা চলে? পেলে, ম্যারাডোনা কি আমার আপনার পাড়ার ফুটবলারের সঙ্গে একই আসনে বসতে পারেন? বা, বিটোফেন, বাখকে কি আমরা বাকিদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলি? লক্ষণও তাই। স্বাধীন, স্বতন্ত্র এক জিনিয়াস। যিনি ব্যাট হাতেই নিয়েছিলেন আমাদের এক সম্মোহনী মায়া জালে মুড়ে রাখতে।